অতীন জানা: মেট্রো রেলের গর্ত থেকে উপরের সিঁড়িতে পা দিলেই উপরের আবহাওয়াটা খানিকটা মালুম হয়। গরমের সময় একটা গরমের ঝলক উপর থেকে নেমে আসতে থাকে। উপরের হাওয়া ঠান্ডা থাকলে তা মোটামুটি সিঁড়ি থেকেই বোঝা যায়। উপরে উঠে এসে সৌরভ দেখল, নিচ থেকে যতটা মনে হয়েছিল আসলে অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। এক পশলা ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে। এবং যথারীতি রাস্তা, ফুটপাথেও গোড়ালি পর্যন্ত জল। তখনও মাঝারি রকম বৃষ্টি পড়ে চলেছে।
আরও পড়ুন-প্রবীণরা ভাল থাকুন
ভাগ্য ভাল হাতে একটা ছাতা আছে, ভাবল সৌরভ। বেরুনোর সময় বাড়ির দিকে হালকা হলেও রোদ ছিল। যদিও বাড়ি আর কর্মস্থল কলকাতার এমুড়ো-ওমুড়ো, তাই ওদিকে রোদ মানে এদিকে বৃষ্টি হতেই পারে। তবুও ফুটপাথে জল দেখে মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। এখন আবার প্যান্ট গুটিয়ে তোলো—তারপর জুতোটাও পুজোয় কেনা, মাত্র ছ’মাস হল, এখনও নতুন নতুন ভাবটা রয়েছে। সেটাকেও হাতে নিতে হবে।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এসে সৌরভ ভাবল, একটু দাঁড়িয়ে যাই। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল একটুও সময় নষ্ট করার মতো অবস্থাতে সে নেই। হাঁটা লাগাতেই হবে।
প্যান্টটাকে পায়ের গোছের একটু ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে, একহাতে মোজাসুদ্ধ জুতো, অন্য হাতে ছাতা, কাঁধে ব্যাগ, এই অবস্থায় জলে পা ডোবাল সৌরভ। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘাপটি মেরে থাকা শত্রুর মতো একটা জোল৷ ঝাপটা এসে চোখে মুখে লাগল।
মেজাজটা যারপরনাই খারাপ হয়ে গেল।
আরও পড়ুন-মশা মশাই
এমনিতেই কাল রাত থেকে মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে— এর মূল কারণ অর্পিতা, সৌরভের সঙ্গে তেরো বছর ধরে সংসার করা বৌ। তার মনোজগতের ব্যাপারটা টিভির ওয়েদার ফোরকাস্টের মতো। আজকাল অবশ্য গা-সওয়া হয়ে গেছে। কাল ছিল রবিবার। সকাল থেকে বাড়ির আবহাওয়াটা বেশ রোদ-ঝলমলে ছিল। সকালে বাজার করে, একটু ভারী জলখাবার খেয়ে, মেয়েকে নিয়ে গেছিল সৌরভ গানের দিদিমণির বাড়িতে। প্রতি রবিবার করে যেতে হয়। ফিরে এসে দেখে অর্পিতার মুখটা একটু থমথমে। সৌরভ নিজেকে একটু সামলে নিল।
এমনিতে সৌরভ সহজাত ভাবেই একটু মজা, একটু ফুর্তি করতে ভালবাসে, অর্পিতার সঙ্গে মজা করে যদিও— কখনও-কখনও সেটা আদি-রসাত্মক হয়ে যায়। এখানেই অর্পিতার আপত্তি, তুমি কি এসব ছাড়া আর কিছু জান না, অর্পিতা ঝাঁজিয়ে উঠে বলে।
সৌরভ গুটিয়ে ফেলে নিজেকে। যদিও সে নিজে মনে করে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু আদি-রসাত্মক ইয়ার্কি চলতেই পারে।
ঘরে ঢুকে সৌরভ ভাবল, আজ তো তেমন কিছুই সে বলেনি যাওয়ার আগে। তাহলে অর্পিতার মনে কোন উত্তরের হাওয়া লাগল যে ঈশান কোণের মেঘের মতো মুখটা থমথমে হয়ে আছে।
আরও পড়ুন-ভালবাসার শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস
খেতে বসে পুচকির সামনেই শুরু করল অর্পিতা, আচ্ছা তুমি আমাকে বিয়ে করলে কেন? সৌরভ দেখল পুচুকি একবার আড়চোখে তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার খেতে শুরু করল। সৌরভও চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগল। এই প্রশ্নটা ওর গা-সওয়া হয়ে গেছে। এর আগে হয়তো সাতশো ছাপ্পান্নবার বা আটশো একানব্বইবার এই প্রশ্নটা শুনতে হয়েছে। প্রথম প্রথম উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করত সে, বোঝানোর চেষ্টা করত। দু-একদিন পরে পরিবেশ অনুকূলে হলেও ক’দিন পরে আবার প্রশ্নটা ফিরে আসে।
এবং সৌরভ জানে এর পরের প্রশ্নটা কী হবে। পরের প্রশ্নটা হবে, তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করলে কেন?
সৌরভ মনে করে এ প্রশ্নের কোন উত্তর তার কাছে নেই, অন্তত তার জানা নেই। সুতরাং চুপ করে থাকাই সৌরভের নিয়তি। চুপ করে থাকার আরও বড় কারণ হল এই প্রশ্নের জন্য অর্পিতাকে দায়ী করতে পারে না সে। সে জানে, সে কী ভয়ানক আপরাধ করেছে।
আরও পড়ুন-এশিয়া কাপে নেই আফ্রিদি
এই এপিসোডে সৌরভ-অর্পিতা ছাড়াও আর এক তৃতীয়পক্ষ আছে, সে চৈতালি। সৌরভের ছোটবেলার বান্ধবী।
সৌরভের ছোটবেলা কেটেছে মফসসলে। এখনকার কলকাতার জীবনের সঙ্গে সে-জীবনের সুরের কোনও মিলই নেই— এমনকী এখনকার মফসসল জীবনও অনেক বদলে গেছে, কলকাতামুখী হয়ে গেছে।
তখন, সৌরভদের ছোটবেলায় ছেলে-মেয়ে মিলে সীতাহরণ খেলা ছিল, পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে, দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া ছিল, এক সঙ্গে পঁচিশে বৈশাখের ফাংশন ছিল। দীর্ঘদিন আর মফসসল জীবনের সঙ্গে কোনও যোগ নেই সৌরভের, কেবল মনে পড়েও পড়ে না— এরকম একটা হারিয়ে যাওয়া গানের সুরের মতো সেই ফেলে আসা জীবনের কষ্ট মাঝে মাঝে ভিতরে ভিতরে, দুঃখ জাগিয়ে রাখে মনে। তাই দীর্ঘদিন কলকাতায় থেকে পড়াশুনা করেও, চাকরিবাকরি করেও, ফ্ল্যাটে বসবাস করেও সে একজন উদ্বাস্ত। সেই ছোট মফসসল শহরটাই ছিল তার আসল জায়গা।
আরও পড়ুন-চা-শ্রমিক সংগঠনের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন
হঠাৎ একদিন চৈতালির ফোন পায় সৌরভ। কোথা থেকে কীভাবে যেন জোগাড় করে ফোন করেছে। সৌরভের মনে হল যেন একটা ফেলে আসা বিগত জীবন থেকে ফোনটা এল।
এখন তর্ক করে অর্পিতা বলে, তুমি তাকেই ভালবাসতে। —একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম এই পর্যন্ত। ভালবাসাটাসা ছিল না।
অবশ্যই ভালবাসতে, ছোট ছিলে তাই বুঝতে পারনি।
সৌরভ চুপ করে থাকে। দার্শনিক যুক্তি— একে খণ্ডন করার মতো পুঁজি তার নেই। অর্পিতা বলে, অবশ্যই ভালবাসতে, তা না হলে সে যে তোমায় ফোন করেছিল এ-কথা আমায় বলনি কেন? তারপরেই অপ্রতিরোধ্য ভাবে সেই কথা এসে পড়ে, ‘তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করলে কেন, আমার জীবন নষ্ট করলে কেন?’
এ-প্রশ্নের উত্তরে সৌরভ চুপ করে থাকে আর নিজেকে অপরাধী ভাবে, সত্যিই তো সে চৈতালির ফোনের কথা অর্পিতাকে খুলে বলেনি কেন?
চৈতালি ফোন করার পাশাপাশি মোবাইলে এসএমএসও পাঠাতে শুরু করল। প্রথমদিকে কিছুটা প্রচ্ছন্ন আবেগ থাকলেও ক্রমে তাতে একটু একটু নুন-ঝাল-টক মিশতে লাগল।
আরও পড়ুন-হাতি ও শাবকের রহস্যমৃত্যু
এরকম সময়ে একদিন অর্পিতা এসএমএসগুলো দেখে ফেলে। এবং সৌরভ-অর্পিতার সংসারে বইতে থাকে উত্তরের শৈত্যপ্রবাহ।
আর, সৌরভ চুপচাপ মুখ নামিয়ে বসে থেকে ভাবতে শুরু করে, সত্যিই তো সে ভয়ঙ্কর
অপরাধ করেছে। তার তো অর্পিতাকে সবকিছু জানানো উচিত ছিল। চৈতালীকে মুখের উপর
‘না’ বলা উচিত ছিল। সে এরকম পার্থিব জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছিল কীভাবে?
অর্পিতা বলে, ‘তুমি ওকে ভালবেসেছিলে, নিশ্চয়ই ‘ভালবেসেছিলে, ভালবেসেছিলেই।’ নির্বাক সৌরভের মুখে কোথা থেকে যেন তেতো জল উঠে এসে শুধু জিভের নয়, জীবনের স্বাদটাকেও তোতো করে দেয়।
একটা দমকা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাতাটা ডানদিকে সরে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে বেশ একঝাপটা বৃষ্টিতে বামদিকের কাঁধের কিছুটা ভিজে গেল। বামকাঁধেই ব্যাগ ঝোলানো রয়েছে। রাস্তায় নামার আগেই ঘড়ি আর মোবাইল ফোনটা ব্যাগের বাইরের দিকের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছে সৌরভ। ভাবল, বৃষ্টির ঝাপটায় ব্যাগ ভিজে গেলে যদি ঘড়ি আর ফোনটা ভিজে যায়! ছাতার স্টিলের ডান্ডাটা কাঁধটায় গাল দিয়ে চেপে ধরে ব্যাগটাকে ডান কাঁধে নিয়ে এল, তারপর ছাতাসুদ্ধ হাতটা দিয়ে ব্যাগটাকে বুকের কাছে চেপে ধরল।
আরও পড়ুন-লর্ডসেই সম্ভবত বিদায় ঝুলনের
সামনেই ফুটপাথের উপরেই একটা পাকুড় গাছ। গোড়াটা পাথর দিয়ে বাঁধানো। ঠিক গাছের গোড়াতেই একটা শিবলিঙ্গ বসানো, আর লোহার ত্রিশূল পোঁতা। দুটোতেই সিঁদুর মাখানো। গাছের গোড়াতে একটুকু জায়গায় বৃষ্টির ঝাপটা একটু কম। হাঁটতে হাঁটতে একটু ধীর হয়ে গেল সৌরভ। দাঁড়িয়ে গেলে ভালই হত, অন্তত বৃষ্টিটা না ধরা পর্যন্ত। কিন্তু সময় নষ্ট করার মতো বিলাসিতা এখন দেখানো চলবে না সৌরভের। অগত্যা একই গতিতে পা চালাল সে।
আবার একটু ঝাপ্টা দিয়ে বৃষ্টিটা জোরেই এল। নাঃ, আর হাঁটা যায় না। দু হাঁটু পর্যন্ত পা, একদিকের কাঁধ আর পিঠের দিকটা পুরোপুরি ভিজে গেছে। মাথাটা ভেজেনি ঠিকই কিন্তু শীতের ভোরের কুয়াশার মতো হালকা একটা জলকণার স্তর চুলগুলো ছেয়ে আছে।
ফুটপাত ঘেঁসে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল সৌরভ। আরও দু-তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে যে খুব একটা সুরাহা হল তা নয়, তবে হাঁটতে বড্ডই অসুবিধা হচ্ছিল। সৌরভ মনে মনে ভাবল, লেট হলে হোক, কিচ্ছু করার নেই।
আরও পড়ুন-মাঠে লিমা, এলেন ইভান
সেই সঙ্গে আর একটা ভাবনা মাথায় এল, এই ভিজে প্যাকেট আর জামা পরে সারাদিন অফিস করলে বাড়ি ফেরার আগেই সর্দি-কাশি নিশ্চিত। এমনকী জ্বরও এসে যেতে পারে। কী করবে— বাড়ি ফিরে যাবে! বাড়ি ফিরতে এখান থেকে ঘণ্টাদেড়েক লাগবে— অন্তত ভিজে জামা-প্যান্টে সারাদিন বসে থাকতে হবে না। কিন্তু অফিসের প্রায় দোরগোড়ায় এসে— হঠাৎ পিছনের দোকানের কাউন্টারে বসা লোকটা হিন্দিতে চিৎকার করে উঠল, কী করছেন কী, ঠিকভাব দাঁড়াতে পারছেন না—
চমকে উঠে সৌরভ বুঝতে পারল, কথাটা তাকেই বলা হচ্ছে। বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচতে ছাতাটা সামনের দিকে আড়াল করে রেখেছিল সে, তারই শিক বেয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি কাউন্টারের উপরে গিয়ে পড়েছে।
সৌরভের মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে উঠল, আপনা-আপনি গলা চড়ে গেল। বলল, বৃষ্টির ঝাপটায় আপনার কাউন্টার তো এমনতেই ভিজেছে।
—সে ভিজুক। হয় আপনি ছাতা বন্ধ করুন, নয়তো সরে যান—
আরও পড়ুন-অনায়াস জয়, দুই ম্যাচেই সিরিজ ভারতের
—সরে যাব কেন, ফুটপাথটাও আপনার নাকি!
—তাহলে ছাতা বন্ধ করুন—
—করব না, কী করবেন কী!
আরও উত্তেজনা ঘনিয়ে ওঠার মুখে আরও যারা দাঁড়িয়ে ছিল, সবাই যে-যার মতো বোঝাতে শুরু করল। একজন সৌরভকে বলল, ‘কী আছে দাদা, একটু সরে আসুন না—’। অন্যজন দোকানদারকে বলল, ‘বৃষ্টির দিন, উনি তো আর ইচ্ছে করে জল ফেলেননি— সৌরভ ছাতাকে সামনের দিকে সরিয়ে এনে, একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল— সরল না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা একসঙ্গে করে দোকানের ঠিক সামনেই ফুটপাতের উপর পচাত করে একদলা থুতু ফেলে দিল।