সৌম্য সিংহ: বাংলা চলচ্চিত্র জগতে বিনামেঘে বজ্রপাত। আচমকাই চলে গেলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। তারপরে একটার পর একটা দুঃসংবাদ। সংগীতজগতে মহীরূহ পতন। একে একে চলে গেলেন দেবব্রত বিশ্বাস, মহঃ রফি। গুরুতর অসুস্থ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও। কিন্তু সেই অসুস্থ অবস্থাতেই কালজয়ী সুর বাঁধলেন সুরের জাদুকর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যে সুরে কিশোর কুমারের কন্ঠে প্রাণ পেল গীতিকার মুকুল দত্তর কথা— ‘সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে’। বছরটা ছিল ১৯৮০। দারুণ হিট করল হেমন্ত-কিশোর জুটির সেই লং প্লেয়িং রেকর্ডের অ্যালবাম। ‘আমার পুজার ফুল ভালবাসা হয়ে গেছে, তুমি যেন ভুল বুঝো না’, ‘চোখের জলের হয় না কোনও রং’— গানগুলোতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল পুজোর আসর। পুজোর মার্কেটে বিক্রির নিরিখে রেকর্ড গড়ল এই এলপি। ‘গোল্ড ডিস্ক’ সম্মানে স্বীকৃতি জানানো হল এই অনন্য সৃজনশীলতাকে। পরে সুস্থ হয়ে উঠে হেমন্ত রীতিমতো আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়ে বলেছিলেন, ‘সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে’— কথাটিতে সুর দেওয়ার সময় আমার মনে হচ্ছিল, তখনও আমার পাশে বসে আছেন উত্তমকুমার।
আরও পড়ুন-দুর্গাপুজো এবং একটি বেতার অনুষ্ঠান
সে এক আলাদা অনুভূতি
হ্যাঁ, পুজোর গানকে ঘিরে আবেগ, উন্মাদনা একটা সময় সত্যিই যেন পাল্লা দিত নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে। পুজোর প্যান্ডেলে মাইকে কিংবা বক্সে হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যা, লতা-কিশোর-আশা, শ্যামল-মানবেন্দ্রদের গান না বাজলে উৎসবের আলোটাই কেমন যেন ম্লান মনে হত। পুজোর রেকর্ড তৈরি থেকে শুরু করে প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই সে এক অসাধারণ অনুভূতি। বিশাল কর্মযজ্ঞ।
আরও পড়ুন-পুজোর ছবি
চিরঞ্জিতের স্মৃতিতে
কথা হচ্ছিল নায়ক-বিধায়ক চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর সঙ্গে। বললেন, ছোটবেলায় দেখতাম পুজোর গান নিয়ে দিদিদের মধ্যে, মায়ের বন্ধুদের মধ্যে সে কী তুমুল উৎসাহ। তখন ভরসা বলতে রেডিও। কারও কারও বাড়িতে রেকর্ড প্লেয়ারও ছিল। সেগুলোকে ঘিরেই গোল হয়ে বসে গান নিয়ে যাবতীয় আড্ডা, আলোচনা, তর্কবিতর্ক। যে শিল্পীর গান পুজো-প্যান্ডেলে যত বাজবে তিনি তত হিট। তখন শিল্পীদের ছবি, গানের তালিকা আর স্বরলিপি দেওয়া ঝকঝকে তকতকে পুস্তিকা বেরত প্রতিবছর পুজোর আগে। কাড়াকাড়ি হত সেই বই নিয়ে। একটা গল্প শোনালেন চিরঞ্জিত। সালটা ঠিক মনে নেই তাঁর। মুম্বইয়ে কিশোরকুমারের বাড়িতে চলছিল ‘গায়ক’ ছবির শুটিং। চিরঞ্জিতকে নিয়ে লোকেশনে অমিতকুমার। এককোণে একটা কাঁচের ঘরে বসে নিজের রেকর্ড করা গান বারবার শুনছিলেন কিশোরকুমার। আর বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করছিলেন, কেমন হয়েছে? সেই গানগুলি ছিল অমর শিল্পী কিশোরকুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত। যার অন্যতম ছিল, ‘পথের শেষ কোথায়’। সময়টা ছিল সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি। দেখেছিলাম কী অসাধারণ ডেডিকেশন, গানের প্রতি ভালবাসা। কিশোরকুমারের মতো ওই উচ্চতার একজন শিল্পী নিজের রেকর্ড করা এলপি অ্যালবামের গান বারবার শুনছেন আর বুঝতে চেষ্টা করছেন, শ্রোতার চাহিদা মেটানোর মতো তাঁর আরও কিছু দেওয়ার আছে কি না। ভাবা যায় না। তখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ গানই বাজারে আত্মপ্রকাশ করত পুজোর মরশুমে। কিছুকিছু বাংলা নববর্ষেও। যার প্রভাব মানত না কোনও সময়ের সীমানা। চিরঞ্জিতের আফসোস, সেই মনমাতানো আনন্দটা কিন্তু আজ আর খুঁজে পাই না।
আরও পড়ুন-দুর্গা ভারতমাতা নন, তবে পুজো উপেক্ষিতও নয়
প্রথম আবির্ভাবেই আলোড়ন
এমন অনেক শিল্পী আছেন যাঁরা একবার কি বড়জোর দু’বার পুজোর গান গেয়েই হারিয়ে গিয়েছেন কিংবা সরিয়েই নিয়েছেন নিজেদের। কিন্তু শ্রোতাদের হৃদয়ে থেকে গিয়েছেন চিরদিন। যেমন বাংলাদেশের রুণা লায়লা। ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’। ১৯৭৭-এর পুজোয় ইপি রেকর্ডে ঝড় তুলেছিলেন তিনি। তারপরে আর এপারের গানে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁকে। কিন্তু আজও রয়ে গিয়েছে সেই গান। যেমন রয়ে গিয়েছে স্বপ্না চক্রবর্তীর সেই মাটির গান, ‘ বলি ও ননদি আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে, ঠাকুর জামাই এল বাড়িতে’ কিংবা ‘বড়লোকের বিটি লো’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে একদিন জনপ্রিয়তার প্রবল উষ্ণতার অনুভূতি এসেছিল শ্রাবন্তী মজুমদারের জীবনেও। ১৯৭৬-এ এইচএমভি-র শারদঅর্ঘ্য, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ভি বালসারার সুরে হেমন্ত-শ্রাবন্তীর দ্বৈতকণ্ঠে ‘আয় খুকু আয়’ গানটি আজও বাবা-মেয়ের মিষ্টি সম্পর্কের বন্ধনে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে। একটা সময়ে পুজো এলেই মন ছুঁয়ে যেত সনৎ সিংহ, মৃণাল চক্রবর্তীর গানও। সায়গল, মুকেশও দু’একবার কণ্ঠ দিয়েছিলেন বাংলা আধুনিক গানে। আসলে তখন আধুনিক গান মানেই পুজোর গান। কার্তিককুমার-বসন্তকুমারের একটা গান ‘বাগবাজারের রসগোল্লা, হাসনাবাদের ছানা’ শুনে শ্রোতারা বেশ মজা পেয়েছিলেন। যে কথাটা না বললেই নয়, সত্তরের দশকের শেষে অন্তরা চৌধুরির ছড়াগান ‘ও সোনা ব্যাঙ, ও কোলা ব্যাঙ’ দারুণ নাড়া দিয়েছিল শিশুমনে। গান বাজলেই আহ্লাদে আটখানা। বাজারে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছিল অন্তরার প্রতিভা।
আরও পড়ুন-মিলার-ঝড়েও ম্যাচ ও সিরিজ রোহিতদের
হিন্দি ফিল্ম দুনিয়া মাতানো শিল্পীরাও
মুম্বইয়ের ফিল্মি জগৎ একচেটিয়াভাবে মাতিয়ে রাখলেও বাংলা আধুনিক কিংবা ছায়াছবির গানে অবাধ বিচরণ ছিল কিশোর-লতা-আশার। সেইসূত্রেই পুজোর গানে বারবারই ফিরে আসতেন তাঁরা। কিন্তু সম্ভবত একবারই পুজোর বাজার মাতিয়ে তুলেছিলেন মহঃ রফি। তাঁর কণ্ঠে নজরুলগীতির অ্যালবামে ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’, ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ আজও বঙ্গ-হৃদয়ে অম্লান। ১৯৮০-তে তাঁর প্রয়াণের পরে সম্ভবত ১৯৮১-র শরতে আত্মপ্রকাশ করেছিল রফি সাহেবের এই অ্যালবাম। সুরকার রবীন্দ্র জৈনও একবার ঝড় তুলেছিলেন শারদোৎসবে, ‘শোনো ও বকুল…মালতী আমার প্রিয় ফুল’ গানে। অমৃত সিং অরোরার ‘রূপসী দোহাই তোমায়’ আজও অম্লান। ভোলা যায় না সুবীর সেনকেও।
আরও পড়ুন-পুজোয় মাতবেন ভুটানের নাগরিকেরা
শেকড়ের খোঁজে
‘পুজোর গান’-এর রেওয়াজটা চালু হয়েছিল ১৯১৪ সালে। উপলক্ষে পুজো হলেও পুজোর গান কথাটা কিন্তু চালু হয়নি তখনও। গ্রামোফোন কনসার্ট থেকে ১৭টি রেকর্ড প্রকাশ করা হয়েছিল সেবার। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শারদীয়’। গেয়েছিলেন মানদাসুন্দরী, বেদানা দাসী, অমলা দাস, নারায়ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণভামিনী, কে মল্লিক-সহ বিভিন্ন শিল্পীরা। গান গাইতেন নামকরা বাইজিরাও। রেকর্ডে লেখা থাকত তাঁদের পরিচয়ও। আগমনি, কীর্তন, বিজয়ার গানে এঁদের প্রতিভা ছিল লক্ষণীয়। কে মল্লিকের আসল নাম ছিল মহম্মদ কাশেম। কৃষক পরিবারের সন্তান। কিন্তু আগমনি গানে ছিলেন অনবদ্য। সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা অমলা দাশ ১৯১৪-র শারদীয় রেকর্ডে গেয়েছিলেন দু’টি রবীন্দ্রসংগীত। কৃষ্ণচন্দ্র দে-র বাংলা গানে প্রথম আত্মপ্রকাশ শারদীয় গানেই। সালটা সম্ভবত ১৯১৭।
আরও পড়ুন-দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে মহাত্মা গান্ধীর ১৫৩ তম জন্মবার্ষিকী, শ্রদ্ধার্ঘ্য মুখ্যমন্ত্রীর
রোম্যান্টিসিজমের আইকন বাঙালির প্রবাদ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঠিক কবে থেকে পুজোর গানে এক ব্যতিক্রমী মাত্রা যোগ করেছিলেন তা নিয়ে দ্বিমত আছে। তবে তথ্যের দাবি, তাঁর প্রথম পুজোর গান আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৯৪৩ সালে। রোম্যান্টিকতার উষ্ণতায় ভরা দু’টি গান গেয়েছিলেন সেবারে, ‘সেদিন নিশীথে’ এবং ‘জানি জানি একদিন’। সুরের আবেগে ভেসে গিয়েছিলেন শ্রোতারা। ১৯৪৮-এর পুজোর গানে প্রেমের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন চিরবসন্ত কণ্ঠের হেমন্ত। ‘শুকনো শাখার পাতা ঝরে যায়, তবু ফোটে ফুল’, ‘প্রিয়ার প্রেমের লিপি’ প্রেমকে দিশা দেখিয়েছে যুগে যুগে। তারপরে ১৯৫১-তে কবি সুকান্তর ‘রানার’-এর হাত ধরে হেমন্ত-সলিল জুটির যুগান্তকারী সাফল্য। তার আগেই অবশ্য ১৯৪৯-এ শ্রোতাদের মনে ঝড় তুলেছে ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’। তারপরে অবশ্যই ‘অবাক পৃথিবী’-তে অবাক করা প্রতিভার অভিব্যক্তি। ১৯৫২-তে হেমন্ত-সলিল জুটির উপহার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পালকি চলে’। এরপরের অনন্য সৃষ্টি, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’।
আরও পড়ুন-পুজোয় মাতবেন ভুটানের নাগরিকেরা
এবং সন্ধ্যা
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রথম পুজোর গান গেয়েছিলেন ১৯৪৮ সালে ‘কার বাঁশি বাজে’ এবং ‘কেন তুমি চলে যাও’। দু’টি গানেই আবেগাপ্লুত সুরের পিয়াসীরা। ১৯৫৭-র পুজোয় ভালবাসার ঝড় তুললেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ গানের মধ্যে দিয়ে। ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে তখন অনেককেই নাকি গুনগুনিয়ে গাইতে শোনা যেত গানটা। পুজোর গানে রাহুল দেববর্মনের সুরকার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯৬৫ সালে। তাঁর সুরে দু’টি গান গাইলেন লতা মঙ্গেশকর, ‘আমি বলি তোমায় দূরে থাকো, তুমি কথা রাখো না’ এবং ‘আমার মালতীলতা কী আবেশে দোলে’। রাহুল নিজে গাইলেন ১৯৬৯-এ। বন্ধু শচীন গুপ্তর কথায় সুর বসিয়ে ব্যতিক্রমী কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, ‘মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি’। ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি আরডির সেই গান, ‘শোনো মন বলি তোমায়, সব কোরো প্রেম কোরো না’ আজও মনে ঝঙ্কার তোলে প্রেমের। ১৯৬৭ সালে কিশোরকুমারকে দিয়ে পুজোর গান গাইয়েছিলেন রাহুলদেবই। মুকুল দত্তর কথায় রাহুলের সুর বেঁধে খোলা আকাশের মতো গলায় কিশোর গেয়ে উঠেছিলেন ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে, যাবে যে আকাশে’। বলা নিষ্প্রয়োজন আরডির সুরে আশা ভোঁসলেও পুজোর গানে যোগ করেছিলেন এক ভিন্ন মাত্রা। ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’ তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। এই প্রসঙ্গেই মনে করা যেতে পারে, রবীন্দ্রসংগীতেও একবার পুজোর বাজার মাতিয়েছিলেন আশা।
আরও পড়ুন-অবনমন চালুর পক্ষে স্টিফেন, মিশন আইএসএল ইস্টবেঙ্গলের
অলিখিত প্রতিযোগিতা
আসলে ছায়াছবির গান আর পুজোর আধুনিক গান একটা সময় মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। পুজোর আগে মুক্তি পাওয়া সাড়াজাগানো বাংলা ছবির গান আর পুজোর রেকর্ড একাকার হয়ে যেত মিলেমিশে। বোধহয় অলিখিত প্রতিযোগিতাও চলত তারস্বরে বেজে ওঠা মাইকে। একদিকে হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, দ্বিজেন, তরুণ, মানবেন্দ্র, সতীনাথ অন্যদিকে সন্ধ্যা, আরতি, উৎপলা, নির্মলা, হৈমন্তী, অরুন্ধতীর মতো মনমাতানো শিল্পীরা হতেন সেই অলিখিত প্রতিযোগিতার শরিক। পথটা দেখিয়েছিলেন শচীন দেববর্মন, পঙ্কজকুমার মল্লিক, আঙুরবালার মতো শিল্পীরা। একই পথের পথিক অখিলবন্ধু ঘোষ, জগন্ময় মিত্র, সুধীরলাল চক্রবর্তীরা। শ্যামল মিত্রর ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’ আজও ছুঁয়ে যায় হৃদয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের, ‘না যেও না’, ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়’, ‘সেই সে ফুলের গন্ধ’, ‘গভীর রাতে হঠাৎ জেগে তোমায় মনে পড়ল’ শুনে মনে হয় এটাই বোধহয় রোম্যান্টিকতার শেষ কথা। ৭০-এর দশকের শেষে এবং ৮০-র দশকের গোড়ায় অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মান্না দে-র পুজোর গান। ‘সে আমার ছোট বোন’, ‘ নিলাম হল শুরু’, ‘দীপ ছিল শিখা ছিল’, ‘এসো যৌবন এসো হে’ কি ভোলা যায়? ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিলেন পুজোর গানে।
আরও পড়ুন-পুকুরে গড়িয়ে পড়ল ট্রাক্টর, মৃত ২৭
গানের বই
মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। পুজোর রেকর্ডের সফল বিপণনের লক্ষ্যে ‘শারদ অর্ঘ্য’ নামে একটি পুস্তিকা বের করত গ্রামোফোন কোম্পানি। রেকর্ড কিনলে পুস্তিকা ফ্রি। প্রকাশিত রেকর্ডের তালিকার সঙ্গে গানের কথাও দেওয়া থাকত এতে। ফলে সংগীতপ্রেমীদের মনে ব্যাপক উদ্দীপনা জাগাত এই পুস্তিকা। ১৯৭৭-এ প্রকাশিত ‘রেকর্ড সংগীত’-এর পুজোপ্রকাশ সংখ্যাও ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। ‘শারদীয়’ নামে একটি পত্রিকাতেও পাওয়া যেত পুজোর গান, শিল্পীদের বিস্তারিত বর্ণনা। সঙ্গে ছবিও। পরে গ্রামোফোন কোম্পানিকে দেখে মেগাফোন এবং কলম্বিয়া কোম্পানিও একইরকম বই প্রকাশ করতে শুরু করে। পুজোর গানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল এই প্রয়াস।
আরও পড়ুন-রাজ্যবাসীকে শুভ সপ্তমীর শুভেচ্ছা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
তবু এখনও
৯০-এর দশকে পুজোর গানে কিছুটা ভিন্নধারা আসে কুমার শানু, কবীর সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন, লোপামুদ্রাদের দৌলতে। শুরু হয় রিমেক কালচারও। শুরু হয় বিবর্তন। অথচ সময়ের হাত ধরে আরও প্রগতির বদলে নেমে আসে নেতিবাচক ছায়া। কিন্তু কেন? গানের প্রতি কি হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের আগ্রহ? মোটেই না। বরং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠছে মিউজিক থেরাপি। কিন্তু বাস্তবটা ক্রমশ কঠোর হয়ে উঠছে অন্য জায়গায়। ইপি, এলপি রেকর্ডের জায়গা অনেকদিন আগেই দখল করে নিয়েছিল গানের ক্যাসেট। আর্থিক সাশ্রয়ের কথা ভেবেই ক্যাসেটে গুরুত্ব দিয়েছিলেন গানের ব্যাপারীরা। কিন্তু ক্যাসেটের সাউন্ড কোয়ালিটি সেভাবে তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি গানের। তার উপরে সস্তা নকল ক্যাসেট বাজার দখল করে নেওয়ায় প্রবল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ল বড় রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো। এবং অবশ্যই শিল্পীরাও। এরপরে বাজারে এল অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সিডি। বিপণনে দারুণ লাভের মুখ দেখতে শুরু করল সিডি অ্যালবাম। উঠে এলেন অনেক নতুন শিল্পী। কিন্তু এখানেও সেই একইরকম অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত, পাইরেসি। ক্ষতিগ্রস্তর তালিকায় গানের কোম্পানি, দোকানি, শিল্পী, শ্রোতা সকলেই। আরও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে এখন হাতে এসেছে পেনড্রাইভ এবং মুঠোফোনে ইউটিউব। চাইলেই গান। কিন্তু প্রাণ? পুজোর গানের সেই আবেগ, সেই উন্মাদনা কোথায়? সত্যিই কি মানুষের মন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে একেবারেই?
মোটেই নয়, পুজোর গানের সেই হারিয়ে যাওয়া আবেগ এখনও বেঁচে আছে কফিহাউসের আড্ডায়, মর্নিংওয়াকের শেষে শালিমার কিংবা শিবপুর ব্যাতাইতলায় চায়ের দোকানে তুষারকাকা, সন্দেশদাদের গভীর আলোচনায়।