পুজোর ছবি

তখন শারদোৎসবে নতুন জামা-জুতো ও নতুন গানের সঙ্গে পুজো উপলক্ষে মুক্তি পাওয়া ছায়াছবি দেখতে মুখিয়ে থাকতেন জনগণ।

Must read

উৎপল সিনহা:

‘মওত তু এক কবিতা হ্যায়
মুঝসে এক কবিতা কা
ওয়াদা হ্যায় মিলেগি মুঝকো
ডুবতি নবজো মে যব
দর্দ কো নিন্দ আনে লগে
জর্দ সা চেহেরা লিয়ে
চাঁদ উফক তক্ পঁহুছে
দিন আভি পানি মে হো
রাত কিনারে কে করিব
না আন্ধেরা না উজালা হো
না আভি রাত না দিন
জিস্ম যব খত্ম হো…
ঔর রুহ্ কো সাঁস আয়ে
মুঝসে এক কবিতা কা
ওয়াদা হ্যায় মিলেগি মুঝকো’
(কবি : গুলজার, আবৃত্তিকার :
অমিতাভ বচ্চন, ছবি : আনন্দ)

আরও পড়ুন-বাংলা সিনেমায় দুর্গাপুজো

এরপরেই তো রাজেশ খান্না তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বলে উঠবেন সেই কালজয়ী সংলাপ : বাবুমশাই…
কয়েকটা প্রজন্মকে বুঁদ করে রাখা এইসব ছবি নিয়ে কথা বলতে গেলেই মনে পড়বে জীবনানন্দ কবির সেই অবিস্মরণীয় পঙ্‌ক্তি, ‘পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল…’।
আমাদের এক বন্ধুর মুখে সবসময় লেগে থাকে একটা গান : পৃথিবী বদলে গেছে, যা দেখি নতুন লাগে। সত্যিই তো।
বদল তো বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়ম। জীবনের অমোঘ ধর্ম। তুমি চাও বা না চাও বদল হবেই। আজ থেকে বছর কুড়ি আগেও পুজো উপলক্ষে বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবি রিলিজ হওয়ার যে উন্মাদনা ছিল এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে। মুঠোফোন, বিশেষ করে অ্যান্ড্রয়েড আসার পরে শুধু ফিল্ম নয়, সারা দুনিয়ার সমস্ত রকমের বিনোদন মানুষের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। তাই মানুষকে হলমুখী করা আজ আর খুব সহজ নয়।
কিন্তু একসময় এমন ছিল না। রেডিও-যুগ পেরিয়ে টেলিভিশন-যুগ আসার পরেও পুজোর ছবি নিয়ে মাতামাতি দেখা গেছে। তখন শারদোৎসবে নতুন জামা-জুতো ও নতুন গানের সঙ্গে পুজো উপলক্ষে মুক্তি পাওয়া ছায়াছবি দেখতে মুখিয়ে থাকতেন জনগণ।

আরও পড়ুন-দুর্গা ভারতমাতা নন, তবে পুজো উপেক্ষিতও নয়

বিশেষ করে যুব সমাজ নতুন ছবি দেখার জন্য ভিড় জমাতেন প্রসিদ্ধ সিনেমা হলগুলির সামনে। কলকাতা তো বটেই, শহরতলিতে, মফসসলে এবং সারা বাংলার প্রতিটি জেলায় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ও হিন্দি ছবিগুলি দেখার জন্য তুমুল আলোড়ন আজও অনেকের স্মৃতিতে অমলিন। মেট্রো, গ্লোব, উত্তরা, পূরবী, অরুণা, প্রাচী, ছবিঘর, গোধূলি, চিত্রা কিংবা শংকর টকিজ— সর্বত্রই বিশাল লম্বা লাইন পড়ত পুজোর সময়। আর টিকিট পাওয়া ছিল লটারির প্রথম পুরস্কার পাওয়ার মতোই মূল্যবান। প্রাণপণ লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত টিকিট হাতে পেলে বীর, না পেলে ফকির। আর টিকিট ব্ল্যাক? পাঁচ টাকার টিকিট দশ টাকা, কুড়ি টাকার টিকিট পঞ্চাশ টাকা, পঞ্চাশ টাকার টিকিট তিনশো টাকা! তবুও খদ্দেরের অভাব হত না। ব্ল্যাকারদের সেই রমরমা আজ উধাও। হলের বাইরে বাঁ-হাতে একগোছা টিকিট আর ডান-হাতে পাইপগান ধরা ব্ল্যাকার আজ সম্ভবত বিলুপ্ত প্রজাতি।

আরও পড়ুন-আমার বলার কিছু আছে

এ-সব তো হলের বাইরের কথা। হলের ভেতরে? ম্যাটিনি, ইভনিং ও নাইট শো পরিবৃত সে আরেক রোমাঞ্চকর নস্টালজিয়া। হলের বাইরে বিশাল বোর্ডে লেখা ‘হাউসফুল’ দেখতে দেখতে গর্বিত পদক্ষেপে হল-এ প্রবেশ। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে বিশাল পর্দায় চলছে বিজ্ঞাপন। কখনও সাদাকালো কখনও রঙিন। টর্চের আলোয় সিট নাম্বার দেখাতে তৎপর হলকর্মীর মৃদু তিরস্কারও বড়ই মধুর লাগত সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত। থার্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাস, ব্যালকনি ও বক্স। বিরতিতে পটেটো চিপস, বাদাম ও ঝালমুড়ি। কেউ কেউ একছুটে বাইরে গিয়ে ভাঁড়ে চা। যাদের পকেট গড়ের মাঠ তারা ঈষৎ গাম্ভীর্যে যেন সিটবেল্ট বেঁধে আপনভোলা। ছবি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই গুরু গুরু চিৎকারে গুরুবন্দনা শেষ না হতেই সুঁই সুঁই সিটির শিৎকার। ‘আজকে যে শিস দিয়ে গান গায়, কোন্ গান গাইবে হে কাল সে…’

আরও পড়ুন-অবনমন চালুর পক্ষে স্টিফেন, মিশন আইএসএল ইস্টবেঙ্গলের

আসলে নায়ক-নায়িকার পর্দায় আবির্ভাব, ভিলেনের প্রাদুর্ভাব, আইটেম গার্লের লাস্যনৃত্য এবং শেষে খলনায়কের পতন ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ের জন্য আবেগমথিত দর্শকদের উচ্ছ্বাস, বিদ্রুপ ও ধিক্কার একেবারে যথাযথ পরিমাণে বরাদ্দ থাকত তখন।
এর মধ্যে আবার বুক ভাঙার কেসও ঘটত মাঝেমাঝে। মানে হৃদয় ভেঙে চুরমার হওয়ার কেস। সেটা কী রকম? ধরা যাক, পুজোয় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা বা হিন্দি ছবি দলবেঁধে দেখতে যাওয়ার প্ল্যান করল অরূপ, সুশান্ত, বিলু, মানিক ও জয়ন্ত। সেইমতো ম্যাটটিনি শো-এর টিকিটও কাটা হল প্রায় প্রাণ হাতে করে দুর্ধর্ষ ব্ল্যাকারদের এড়িয়ে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানা গেল জয়ন্ত দলছুট হয়েছে। সে মনীষার সঙ্গে সিনেমা দেখবে ব্যালকনিতে বসে। মুহূর্তের মধ্যে বাকিদের মুখে নেমে এল রাতের চেয়েও অন্ধকার। মনীষা তাদের কেউ নয় অথচ সবারই বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা। আর মুখে গালাগাল। শালা বিশ্বাসঘাতক জয়ন্ত! ব্যাটা হাড়বজ্জাত আসুক না একবার আড্ডায়, ওর বিচার হবে। সে বিচার আজও হয়নি।
ভাঙা বুকে রাঙা ব্যথার কথা থাক। আজ থেকে ৬২ বছর আগে পুজোতেই মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’। ৫৪ বছর আগে পুজোর সময় মুক্তি পেয়েছিল ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’।

আরও পড়ুন-ইন্দোনেশিয়ায় মেঠো হাঙ্গামা: ফুটবল ম্যাচে হিংসা, হত ১৭৪

সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’, ‘মহানগর’, ‘চিড়িয়াখানা’ ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ মুক্তি পেয়েছিল পুজোতেই। উত্তমকুমারের বহু ছবিও রিলিজ হয় পুজোর সময়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সোনার হরিণ’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘দুই ভাই’, ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘শঙ্খবেলা’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘তিন অধ্যায়’, ‘মন নিয়ে’, ‘কমললতা’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মেমসাহেব’, ‘অমানুষ’, ‘রৌদ্রছায়া’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘ধনরাজ তামাং’, ‘শ্রীকান্তের উইল’ ইত্যাদি। পুজোয় মুক্তিপ্রাপ্ত সব ছবিই যে হিট করত এমন নয়। ১৯৫৩ সালের পুজোয় রিলিজ হওয়া ছবি ‘বউ ঠাকুরানির হাট’ বক্স অফিসে ঝড় তুলতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৯৫৪ সালে পুজোয় মুক্তি পাওয়া ছবি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ হয়েছিল সুপার হিট। সত্তর দশকের একেবারে গোড়ায় পুজোয় মুক্তি পাওয়া ‘রাজকুমারী’ ফ্লপ হলেও একই সময়ে মুক্তি পাওয়া ‘নিশিপদ্ম’ সুপার হিট। নবীন নায়ক ও নায়িকার অভিনয়ে সমৃদ্ধ তরুণ মজুমদারের ছবি ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ বিশাল ব্যবসা করে ১৯৭৩ সালে।

আরও পড়ুন-গুড়াপে কেদারনাথ দর্শন

এখনও পুজোর সময় বেশ কয়েকটি বাংলা ছবি রিলিজ হয়। কিন্তু ছবিগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকেন প্রযোজক ও পরিবেশকেরা।
‘হম তুম এক কমরে মে বন্ধ হো ঔর চাবি খো যায়…’, গানটি একসময় যুব সমাজের মুখে মুখে ফিরেছে। শুধু তাই-ই নয়, একটা গোটা যুগ আচ্ছন্ন হয়েছিল যে হিন্দি ছবিটিতে তার নাম ‘ববি’। ঋষি ও ডিম্পল অভিনীত এই ছবিটি সুপার ডুপার হিট হয় পুজোর সময় ১৯৭৩ সালে।
১৯৭১ সালে নির্মিত ‘গুড্ডি’ ছবিটিও বক্স অফিসে ঝড় তুলেছিল। পরে তামিল ভাষাতেও এই ছবির রি-মেক হয়। ১৯৯৫ সালে পুজোর সময় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বরসাত’ বিপুল বাণিজ্য করেছিল। এই ছবিতে ছিলেন ববি দেওল, রাজ বব্বর, টুইঙ্কল খান্না, মুকেশ খান্না, ড্যানি প্রমুখ কলাকুশলীবৃন্দ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালে তৈরি ছবি ‘তিসরি মঞ্জিল’ পুজোয় রিলিজ হয় এবং সুপারহিট হয়। এই ছবিতে সুরকার রাহুল দেববর্মনের অসাধারণ সুরগুলি তাঁকে সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা দেয়। এই ছবির গানগুলো অমর হয়ে আছে।

আরও পড়ুন-দুর্গাপুজোয় মেতে উঠেছে অসুর সম্প্রদায়

ও মেরে সোনা রে, আজা আজা ম্যায় হুঁ প্যায়ার তেরা, ও হসিনা জুলফোঁ ওয়ালি, তুমনে মুঝে দেখা হো কর মেহেরবান ইত্যাদি জনপ্রিয় গানগুলিতে কণ্ঠ দিয়েছেন মহম্মদ রফি ও আশা ভোঁসলে।
১৯৮৪ সালে পুজোর সময় মুক্তি পায় ‘জাগির’। যার বাংলা ডাবিং ‘তিন মূর্তি’। এই ছবিতে অভিনয় করেন ধর্মেন্দ্র, মিঠুন, জিনাত, প্রাণ, ড্যানি, সোমা আনন্দ, অমরীশ পুরি, রণজিৎ প্রমুখ। এই ছবিটি ভারতে তো বটেই, এমনকী সোভিয়েত দেশেও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
আজও নতুন ছবি মুক্তি পায় প্রতিবছর পুজোয়। কিন্তু পুজোর ছবি নিয়ে সেই বিরাট উন্মাদনা উধাও। হারিয়ে গেছে সেই আবেগ, সেই উচ্ছ্বাস।

Latest article