মৃত্যুঞ্জয় পাল: আলোয় ভাসছে শহর, পুজো আসতে তখনও মাস দেড়েক দেরি। ১৫ অগাস্টে পতাকা উত্তোলন আর তারপরেই বাঙালি দিন গোনা শুরু করে দেয়। কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যায়। বয়স বাড়ে। চুলে পাক ধরে। চোখে ওঠে হাই পাওয়ারের চশমা। কিন্তু বাঙালির এই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম নেই। বরং বছর বছর আরও উদ্দীপনার সঙ্গে উৎসবের অঙ্গন সাজিয়ে নিচ্ছে বাঙালি। দুর্গাপুজো মানেই যে ছবিগুলো আমাদের মাথায় আসে।
আরও পড়ুন-স্বৈরতান্ত্রিক পথে বিজেপি, সংসদীয় কমিটি নিয়ে কেন্দ্রের নোংরা রাজনীতি
চিত্র ১ : হাতিবাগান থেকে গড়িয়াহাট, মানুষের ঢল। শপিংমল থেকে ফুটপাতের দোকান, কোত্থাও কমতি নেই। ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-দলিত এমনকী হিন্দু-মুসলমান, সাধ্য ও সামর্থ্য অনুসারে সকল বাঙালির মিলনতীর্থ হয়ে উঠেছে এই দোকানগুলি।
চিত্র-২ : উত্তর থেকে দক্ষিণ, থিকথিক করছে প্রতিটি মণ্ডপ। ছোট ছেলের আইসক্রিম বা দোলনায় চড়ার বায়না থেকে শুরু করে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের কিঞ্চিৎ বিলাসিতা প্রদর্শনে রেস্তোরাঁয় ভিড় জমানো।
চিত্র ৩ : বুকভরা আনন্দ-উল্লাস নিয়ে হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার গ্রামে প্রত্যাবর্তন দশমীর শেষে। হাতে সন্তানের জন্যে জামা-কাপড়, বাবা-মায়ের শাড়ি-ধুতি, স্ত্রীর জন্যে কাপড় বা গহনাও। এঁরা কেউ ঢাকি, কেউ পুরোহিত, কেউ-বা মণ্ডপ নির্মাণে যুক্ত কর্মী বা আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা তরুণ-তরুণী।
আরও পড়ুন-স্টল নিয়ে কুৎসার কড়া জবাব তৃণমূলের, মণ্ডপের ভিড়কে কাজে লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা
এ-ছবিগুলোর কোনওটাই আমাদের অচেনা, অজানা নয়। বহুকাল ধরেই তা আমরা দেখে-শুনে এসেছি। তবুও ক্রমানুসারে বিন্যাসের কারণ একটাই, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর সুদূরবর্তী স্থানিক ও কালিক বিস্তৃতির দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা। আর এই প্রভাব এতটাই বিস্তৃত যে, আমাদের মুখে মুখে সমগ্র বৎসরটিই ‘পুজোর আগে’ বা ‘পুজোর পরে’ এই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে পুজোকে ছাপিয়ে এই ‘ইভেন্ট’ আজ উৎসবের রূপ নিয়েছে। পুজোতে বহুজাতিক সংস্থার বিপুল পুঁজির বিনিয়োগ থেকে শুরু করে প্রান্তিক মানুষের সমগ্র বৎসরের আয়ের একটি বড় অংশ সব প্রাপ্তি, প্রত্যাশার আকাঙ্ক্ষার মূলেই রয়েছে দুর্গোৎসব।
আরও পড়ুন-বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিতে ভিজল বাংলা
বাঙালি সমাজে, জীবনে একের পর এক প্রতিকূলতা এসেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালকেই যদি হিসাব করি, তাহলে লক্ষ্য করা যায় দেশভাগ, উদ্বাস্তু স্রোত, খাদ্য আন্দোলন, ওপার বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ এবং তার প্রভাবে আবারও এ-বাংলায় লক্ষাধিক শরণার্থীর আগমন, নকশালবাড়ি আন্দোলন, বন্যা-খরা, আয়লা, আমফানের মতো বিপর্যয়, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব, নোট বাতিলের মতো তুঘলকি সিদ্ধান্তের পরিণাম— কিন্তু এই সকল বিপর্যয়েও কখনও দুর্গাপুজোর রোশনাই বাঙালির সমাজ ও জীবনে এতটুকু ম্লান হয়ে যায়নি, বরং তা হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের সোপান। দুর্গাপুজোর উৎসবকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি কীভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছে, তা নিয়ে ২০১৩ সালে অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অব ইন্ডিয়া বা ‘অ্যাসোচ্যাম’ একটা রিপোর্ট বার করেছিল। তাতে পশ্চিমবঙ্গের পুজোর অর্থনীতির বহরটাকে হিসেব করা হয়েছিল ২৫ হাজার কোটি টাকা। মনে রাখা প্রয়োজন, সে কিন্তু বিশ্ব জুড়ে এক সার্বিক মন্দার বা তার ঠিক পরের সময়কাল। যার আঁচ থেকে বাঁচতে পারেনি ভারতের অর্থনীতিও। তাই সার্বিক ভাবে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমেছিল। অ্যাসোচ্যামের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দুর্গাপুজোর অর্থনীতির বার্ষিক বৃদ্ধির হার নাকি ৩৫ শতাংশ। যা সত্যিই বিস্ময়কর, সমগ্র দেশ তো বটেই, বিশ্বের মধ্যেও এরসঙ্গে তুলনীয় হাতেগোনা। তবে এই হিসেবে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল, প্রতিমা, আলো, সাজসজ্জাতেই খরচ হাজার হাজার কোটি। আর রয়েছে কেনাকাটা, খাবারদাবার, বেড়ানো, কী নয়! একবার ভাবুন, কলকাতার একটা ছোট মণ্ডপেও যদি সারাদিনে হাজার লোকের সমাগম হয় তাহলে মণ্ডপের বাইরে ফুচকা বা ঘুগনি নিয়ে বসা মানুষটির কত রোজগার হবে! আর বড় মণ্ডপে তো লক্ষাধিক জনসমাবেশ হয়। তাহলে শুধু মণ্ডপ-কেন্দ্রিক ব্যবসাটা ভাবুন।
আরও পড়ুন-লন্ডন ম্যারাথনে মৃত্যু প্রতিযোগীর
অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, যত বেশি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হবে দেশে— ততই দেশীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। একজনের ব্যয় অপরজনের আয়ে পরিণত হয়, মুনাফা সৃষ্টি হলে তা বিনিয়োগ হয়, তার থেকে আবার আয়-ব্যয়-কর্মসংস্থান ইত্যাদি। এইভাবে ‘সার্কুলেশন অফ মানি’ যতই বিস্তৃত হবে তা ধনী থেকে প্রান্তিক মানুষ সকলকেই সমৃদ্ধ করবে। আর বাংলার অর্থনীতিতে এই কার্যকলাপ চূড়ান্ত রূপ নেয় দুর্গাপুজোর সময়ে। ধনতান্ত্রিক কাঠামোয়, পুঁজিপতিদের বিজ্ঞাপনে হওয়া পুজোর টাকা সরাসরিভাবে প্রায় পুরোটাই চলে যায় প্রতিমা শিল্পী, আলোকশিল্পী, মণ্ডপসজ্জায় নিযুক্ত শিল্পী-কারিগর, ঢাকি, পুরোহিত, ফুল বিক্রেতাদের কাছে বিভক্ত হয়ে। সরকারি, বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের মেলে ‘বোনাস’। মধ্যবিত্তের এই ‘বোনাস’ই আবার হয়ে ওঠে বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের আয়ের বড় উৎস। তবে এর আগে কোনও সরকারই উদ্যোগ নেয়নি এই দুর্গোপুজোকে কেন্দ্র করে ঠিক কত টাকার ব্যবসা পশ্চিমবঙ্গে হয় তার একটা তথ্য তুলে ধরার। ২০১৮ সালে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছায় রাজ্যের পর্যটন দফতর এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের যৌথ উদ্যোগে একটি চমৎকার গবেষণাধর্মী সমীক্ষা ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে হয়। ‘Mapping the creative economy around Durga Pujo in 2019’ এই রিপোর্টে বিস্তারিত এর উল্লেখ আছে। এই রিপোর্ট অনুসারে বাংলার বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে প্রায় ৩০,০০০ দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। শুধুমাত্র কলকাতাতেই সেই সংখ্যা তিন হাজারের অধিক। মহিলা পরিচালিত পুজো ১৫০০। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এই রাজ্যে ৩২,৩৭৭ কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। যা রাজ্যের মোট জিডিপির প্রায় আড়াই শতাংশ। ব্রিটিশ কাউন্সিলের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু প্রতিমা প্রস্তুতিতেই₹২৬০-২৮০ কোটির ব্যবসা। বিজ্ঞাপন বাবদ₹৫০৪ কোটি এবং খাওয়াদাওয়ার বাজার প্রায়₹২৮৫৪ কোটির। এ-ছাড়াও আলো, স্পনসরশিপ, পাবলিকেশনের মতো ক্ষেত্রের ব্যবসার তথ্যও জানানো হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে দুর্গাপুজোর সময় পর্যটনবাবদ ব্যবসার তথ্য।
আরও পড়ুন-বড় চুলই ‘লাকি ম্যাসকট’ কাপ জিততে চমক ধোনির
পৃথিবীর যেকোনও উৎসবকে কেন্দ্র করেই অর্থনীতি জড়িয়ে আছে। সে ব্রাজিলের রিও কার্নিভাল হোক বা স্পেনের টোম্যাটিনা ফেস্টিভ্যাল। তবে এদের জিডিপিতে ১.৫% – ২% অবদান। সেখানে আমাদের দুর্গাপুজোয় প্রায় ৩% অবদান জিডিপিতে। আরও অনেক হিসেব যেমন পুজোতে অনলাইন কেনাকাটা, সিনেমার মুক্তি, নতুন বইয়ের প্রকাশ। সব ধরলে এটা ৫% ছুঁয়ে যেতে পারে। এইক্ষেত্রে বাংলার দুর্গাপুজোর সঙ্গে একমাত্র বিদেশের ক্রিসমাসের তুলনা চলতে পারে।
আরও পড়ুন-মহানবমী উপলক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছাবার্তা
বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্টে আপনারা খুঁজে পাবেন সারা দেশে বেকার সমস্যা কীভাবে বাড়ছে। সেই জায়গায় একটু হিসেব করলে বোঝা যায় যে আমাদের রাজ্যে দুর্গাপুজোর অর্থনীতি ২০১৩ সাল থেকে গড়ে ৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে কোভিডের দু’বছর বাদ দিলে। তাই আগামী পাঁচ বছরে পুজোর অর্থনীতি এক লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর ইউনেস্কোর স্বীকৃতি সেটাকে আরও ত্বরান্বিত করবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাক, রাজ্য সরকারের অনুদান (৬০ হাজার) উৎসাহ দিচ্ছে এই জায়গাতেই। সরকারের কাজ যেমন শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষাকে এগিয়ে দেওয়া, আমাদের পুজোও তেমনই সমাজের অংশ, সকলের উৎসব। গোটা দেশে যখন আট শতাংশের কাছাকাছি বেকারি বাড়ছে, সেক্ষেত্রে পুজো যদি অর্থনীতির একটি দিক নির্ণয় করে, তাকে সঠিক দিশা দেখানোই জনমুখী সরকারের কাজ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেই জায়গাতে নজর রেখেছেন। পুজো অনুদান কাজ করছে এক অণুঘটকের, যা গোটা রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে। বিশ্ব জুড়ে যিশুর জন্মদিনের আগে-পরে যে বিপুল ব্যবসা বাড়ে সেকথা সকলেই জানেন। পশ্চিমবঙ্গ এবং বিশ্ববঙ্গ সমাজের উৎসবে অর্থনীতিকে সঠিকভাবে বুঝে নেওয়াই একটি বুদ্ধিমান সরকারের কাজ। তাই মা দুর্গার ন্যায় রাজ্যের অভিভাবিকা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক মানুষের রোজগার, সুরক্ষার জন্যে অসুররূপ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করবেনই এবং ফি-বছরে দুর্গোৎসব এইভাবেই ঘরে ঘরে সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীর আগমন ঘটাবে।