দি শ্রাদ্ধকর্ম কিছু করবেন?
দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে বিশুদ্ধ বাংলায় এই প্রশ্ন শুনে বেশ চমকে গিয়েছিলাম, কারণ শ্রাদ্ধকর্ম আমরা সাধারণত মহালয়ার আগে পিতৃপক্ষেই করে থাকি, কিন্তু কালীপুজোর প্রাক্কালে ধর্মশহর কাশী তীর্থযাত্রীতে পরিপূর্ণ, এক দোকানদার জানালেন কালীপুজো উপলক্ষে প্রায় ত্রিশ হাজার বাস যাত্রীদের নিয়ে এই শহরে প্রবেশ করেছে। কারণ এই সময় পিতৃগণকে জলদান প্রশস্ত কর্ম। তার সঙ্গে রয়েছে দীপাবলি ও ধনতেরাস। এবার বন্যার জলে ঘাটে সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে না। নৌকা চলাচল বন্ধ, তার সঙ্গে গঙ্গা আরতিও। দেখলাম ঘাটের সংকীর্ণ স্থানেই ছাতা রাখা হয়েছে, আর তার তলায় দু’জন দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রমহিলা মস্তক মুণ্ডন করছেন। এ শহরে ভারতের ধর্মজীবনের ধারাটি স্পন্দিত হয়ে চলে। বেশ বোঝা গেল, এ কেবল বাংলার শক্তি আরাধনা নয়, এর সঙ্গে মিশ্রিত আছে নানা ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানের সমাহার। বাস্তবিকই কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে কালী আরাধনার মহাক্ষণে আমরা বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান পালন করি, যার সঙ্গে দেবীপূজার সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু তা আমাদের মনে কোন এক যুগে একীভূত হয়ে বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে। আমরা এই ব্রত বা অনুষ্ঠানকে কালীপূজার পূর্বঅঙ্গ বলেই মনে করি। যেমন দীপাবলি, যেমন পিতৃপুরুষের আরাধনা, যেমন ধনতেরাস ব্রত।
আরও পড়ুন-গয়নাকথা
এই অমাবস্যা কেবল হিন্দুদের জন্য পবিত্র ক্ষণ রূপে পালিত নয়। এই তিথি সর্ব ধর্মের মানুষের কাছে, পবিত্র ও পালনীয় তিথি। হিন্দু মহাকাব্যে বলা হয়, শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধ করে অযোধ্যায় ফিরে এলে তাঁর বিজয় উৎসবের জন্য নগরকে আলোকমালায় সজ্জিত করে তোলেন প্রজাগণ। সেই থেকে দীপাবলি উৎসবের সূচনা। বৌদ্ধদের কাছে এই তিথি বুদ্ধের গৃহত্যাগের শুভ তিথি। জৈন পুরাণ মতে, এই তিথিতে মহাবীর মহানির্বাণ লাভ করেন। সেই কথা স্মরণ করে জৈনধর্মাবলম্বীরা সেদিন ঘর-বাড়ি আলোকমালায় সজ্জিত করেন।
আরও পড়ুন-কে যায় রে…
বেশ কিছু বছর ধরে বাংলার সংস্কৃতিতে ধনতেরাস ব্রত পালনের ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। ব্রতটির নাম শুনেই বুঝতে পারা যায় এই ব্রতের উৎস অবাঙালি অঞ্চলে। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর দিন ব্রতটি পালিত হয় বলে, ব্রতের নাম ধনতেরাস। নামটি অবাঙালি হলেও এই সময় ধন দেবীর আরাধনা বাংলাতেও প্রচলিত। আমরা সেই তথ্য বিস্তারিতভাবে মেলে ধরব। এই ব্রতপালনে গৃহস্থের ধনবৃদ্ধি হবে, এমনই বলা হয়ে থাকে। প্রতিটি ব্রতের একটি কথা বা গল্প থাকে। ধনতেরাস ব্রতেরও একটি কাহিনি আছে। এই কাহিনি অনুসারে বহু বছর পূর্বে ভারতের কোনও এক রাজার কোষ্ঠী গণনা করে জ্যোতিষী বলেন তাঁর পুত্র বিবাহের চতুর্থ দিন সর্পদংশনে মারা যাবেন। পুত্রের বিবাহের পর একথা জানলেন নববধূ। কোনওমতে সেই নব বিবাহিত বধূ, আর অন্য মতে রাজা স্বয়ং নির্ধারিত দিনে আদেশ দিলেন প্রজাদের প্রত্যেকের গৃহে আজ আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। রাজা নিজের প্রাসাদে সর্বত্র আলোর মালা দিয়ে সজ্জিত করলেন, তার সঙ্গে চাল ও ফুল চারিদিকে ছড়িয়ে দিলেন। এদিকে নব বিবাহিত যুবরানি তাঁর গহনাগুলো স্তূপ করে দুয়ারের সামনে রেখে দিলেন। ধীরে ধীরে সময় ঘনিয়ে এল, সর্পরূপ মৃত্যুদেবতা রাজ্যে প্রবেশ করে মুগ্ধ হলেন। এতসব আয়োজন তাঁরই জন্য? তুষ্ট মৃত্যুদেবতা যুবরানির রাখা গহনার সম্মুখে এসে বললেন, এই আয়োজনে আমি তুষ্ট হয়েছি। তুমি আমার কাছে বর গ্রহণ করতে পারো। নব বিবাহিত যুবরানি আর অপেক্ষা করলেন না। তিনি রাজপুত্রের আয়ুবৃদ্ধির বর চেয়ে নিলেন। সেই থেকে এই দিনটি দীপমালায় প্রজ্জ্বলিত করে রাখার বিশেষ দিন। এই দিনে রানি নিজের গহনা দিয়ে যমরাজকে তুষ্ট করেছিলেন, সেই কথা স্মরণ করে গহনা ক্রয়ের এত সমারোহ।
আরও পড়ুন-সিত্রাং : নিরঞ্জনে বিধি ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনাও
ধনতেরাসের ব্রতকথাটি আমাদের পুরাণ ও মহাকাব্য বর্ণিত রাজা সত্যবানের পত্নী সাবিত্রীর কাহিনিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দুটি কাহিনিকে বড় কাছাকাছি বলে মনে হয়। মৃত্যুর দেবতাকে জয় করার অদম্য বাসনা থেকে এই কাহিনিগুলি সৃষ্ট। প্রাক কালীপূজার আরাধনাকে একটি বিচ্ছিন্ন কোনও প্রবণতা বলে চিহ্নিত করা যায় না। এর সঙ্গে সংযুক্ত আছে পিতৃপুরুষের আরাধনা। মূলত, মহালয়ার অমাবস্যা তিথি থেকে কালীপূজার অমাবস্যা তিথি পর্যন্ত সময়টি পিতৃপুরুষের আরাধনা, জলদানের জন্য প্রশস্ত। এই সময় আমরা আকাশপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করি। যাতে পিতৃপুরুষগণ, পিতৃলোক থেকে নেমে আসার সময় আলোকোজ্জ্বল পথরেখা দেখতে পান। কিন্তু দীপাবলির মতো এই সময় ধনকামনার জন্য প্রশস্ত সময় বলেও চিহ্নিত করা হয়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি ব্রতকথার দেখা পাওয়া যায়। এই ব্রতকথা অনুযায়ী, পুরাকালে এক রাজার চার কন্যা ছিল। একদিন রাজা তাঁর প্রতি মেয়েদের আনুগত্য কতখানি তা জানার জন্য তাদের প্রশ্ন করলেন : তোমরা কার অনুগ্রহে জীবনধারণ করছ? এর উত্তরে তিন কন্যা জানাল, মহারাজের অনুগ্রহেই তারা বেঁচে আছে। কেবল ছোট রাজকন্যা বলে উঠল, “করুণাময় ঈশ্বরের অনুগ্রহেই আমরা জীবনধারণ করি।” ছোটমেয়ের মুখে এই কথা শুনে রাজা একেবারেই সন্তুষ্ট হলেন না। তিনিই ঈশ্বর, এখানে তাঁর সন্তান হয়ে তাকেই অবহেলা? রাগের চোটে দ্রুত ছোটকন্যাকে তিনি এক গরিব ব্রাহ্মণের সঙ্গে বিবাহ দিলেন এবং বিয়ের পর দু’জনকে নিজের রাজ্য থেকে নির্বাসিত করলেন। রাজকন্যা আর তার স্বামী জঙ্গলে গিয়ে কুঁড়েঘরে বাস করতে লাগল। ব্রাহ্মণ স্বামী অনেক কষ্ট করে সংসার চালায়। একদিন কোনও উপার্জন করতে না পেরে মনের দুঃখে বাড়ি ফিরছিল। পথে একটা মৃত সাপ দেখে তুলে নিয়ে ঘরে এল। রাজকন্যা সেই মৃতসাপটি ঘরের চালায় ফেলে রাখল।
আরও পড়ুন-এলিজিবিলিটি টেস্ট পাশ মানেই চাকরি নয়
এই সময় একদিন ওই রাজাই স্নানের সময় নদীর তীরে তাঁর গজমোতির মালাটি রেখে জলে নামলেন। এক চিল ছোঁ মেরে ওই মোতির মালা নিয়ে আকাশে উড়ে গেল। রাজা হায় হায় করে উঠলেন। ওই চিল মালা নিয়ে কী করবে? সেটি কোনও খাওয়ার জিনিস নয়। তাহলে এক সময় তা নিচেই ফেলে দেবে। এই কথা ভেবে রাজা রাজ্যে ঘোষণা করলেন, যে আমার গজমোতির মালা এনে দেবে তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে। বিধাতার ইচ্ছায় চিলটি রাজার ছোট মেয়ের কুঁড়েঘরের উপর দিয়েই উড়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ সেই ঘরের চালায় মৃত সাপ দেখে সে নেমে এল, গজমোতির মালা সেই চালে ফেলে মৃত সাপকে নিয়ে উড়ে গেল। মৃত সাপ তার খাদ্য। গজমোতির মালা নয়। ছোট রাজকন্যা মালাটি দেখে চিনল, এরপর যেই রাজা মালার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করলেন তখন রাজকন্যা স্বামীকে রাজার কাছে এক শর্ত রাখতে বলল। শর্ত অনুসারে, দীপাবলির দিন রাজধানী সহ সমস্ত প্রজাদের ঘর অন্ধকার থাকবে। রাজা এই শর্ত মেনে নিলেন। সেই অমাবস্যায় সমস্ত রাজ্য অন্ধকার রইল। লক্ষ্মীদেবী ধরায় নেমে চারিদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকতে দেখলেন, কেবল নির্বাসিত ছোট কন্যার ঘরে প্রদীপ জ্বলছে। দেবী তাতেই খুশি হলেন এবং ছোট রাজকন্যাকে ধনলাভের বরদান করে তিনি স্বর্গে চলে গেলেন। এরপর রাজবাড়ি অলক্ষ্মীর আবাসভূমি হল আর রাজকন্যার কুঁড়েঘরে লক্ষ্মীর আশীর্বাদ নেমে এল।
আরও পড়ুন-এলিজিবিলিটি টেস্ট পাশ মানেই চাকরি নয়
এই কাহিনি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে ধনতেরাস উৎসবের মধ্য দিয়ে ধনলাভের ইচ্ছা কেবল সাম্প্রতিক কালের ঘটনা নয়। কালীপূজার ক্ষণটিতে লক্ষ্মীদেবীর আশীর্বাদলাভের জন্য ধনদেবীর আরাধনা আমাদের বাংলার সংস্কৃতির মধ্যেই অনুস্যুত হয়ে ছিল। এখনও অনেক পরিবারে কালীপুজোর দিন লক্ষ্মীপুজো করার রীতি প্রচলিত আছে। তবে এই রীতির মূল নিহিত আছে আরও গভীরে। কারণ, কালীপূজার আগে চতুর্দশী তিথিটি হিন্দু পুরাণে এক উল্লেখযোগ্য তিথি। বলা হয়, এই দিন শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেছিলেন। নরকাসুরের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার আনন্দে দেবতারা আলোর মালা দিয়ে চারিদিক সজ্জিত করেন আর এই তিথি নরক চতুর্দশী তিথি রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আবার পুরাণ অনুসারে সমুদ্রমন্থনের সময় সমুদ্র থেকে চোদ্দোটি রত্ন উঠে আসে এবং তার সঙ্গে চতুর্দশ কলস নিয়ে আবির্ভূত হন ধন্বন্তরী এবং তার কিছুদিন পর লক্ষ্মী উত্থিত হন । তাই চতুর্দশী তিথি এত মাহাত্ম্য, আমরা অবশ্য এই তিথিকে ভূত চতুর্দশী তিথি নামে চিহ্নিত করি। মূলত, ধন্বন্তরীর দু’দিন পরে সমুদ্র থেকে উঠে আসেন লক্ষ্মীদেবী। তাই দু’দিন পর তাঁর পূজো। মূলত, কালীপুজো বা অমাবস্যার দেবী আরাধনার উৎসবটি দুর্গাপুজোর মতো পাঁচদিনেরই উৎসব। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীতে তার সূচনা আর ভাইফোঁটাতে যার সমাপ্তি। দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে আয়ুর্বেদ ঔষধির দেবতা ধন্বন্তরির স্মৃতিও এখন সংস্কৃতির আঙিনায় জেগে আছে। আমরা ভূত চতুর্দশীর দিন যে চোদ্দো শাক খাই তার মধ্যে স্বাস্থ্য ভাল রাখার কৌশল নিহিত আছে। অনেকে বলেন, বাজি পোড়ানোর মধ্যে বীজাণু ধ্বংসের কারণও নিহিত আছে।
আরও পড়ুন-আসছে ঘূর্ণিঝড়, কৃষকদের সতর্ক করে জারি বিজ্ঞপ্তি
সুতরাং, এ কেবল উৎসব নয়! ধনলাভ, স্বাস্থ্যলাভ, ও পূর্বপুরুষদের তুষ্টি প্রদান সবই এই তিথি ক’টির মধ্যে দিয়ে পূর্ণতা লাভ করে। আমরা ধ্বংসের দেবীকে বরণ করি, সুখ ও সমৃদ্ধিতে নতুনভাবে জাগ্রত হওয়ার জন্য। ধনতেরাস ব্রত তারই অংশ। তবে এই তিথিতে গহনা ও বাসন কেনার হিড়িক বোধহয় পরবর্তীকালের সংযোজন। একে আমরা লোকাচার হিসেবেই দেখতে পারি। কোনও সম্প্রদায়ের ব্যবসায়িক লাভের জন্য যেন এই প্রথার সৃষ্টি। তবে এই প্রথা মানতে অসুবিধে নেই, যদিও মনে রাখতে হবে ধনের দেবী লক্ষ্মীকে তুষ্ট করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এ ব্রত সমস্ত ভারতেই পালিত, কেবল নামের জন্য তাকে অবাঙালি বলার কোনও যুক্তি নেই।