পার্বণী ছট
আমাদের দেশে প্রতিটা উৎসবই যেন এক-একটা মহোৎসব। তা সে গণেশ পুজো হোক বা দুর্গা, লক্ষ্মী, কালীপুজো, হনুমান জয়ন্তী থেকে ছট পুজো। বেশ কয়েকবছর আগেও ছটপুজোর এতটা রমরমা দেখা যেত না। এখন খোলনলচে পাল্টেছে এই পুজোর। রূপ, রং, বর্ণ— সবই নতুন। কাঁদি-কাঁদি কলা, ফলমূল নিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, বাজি পোড়াতে পোড়াতে বাড়ির বউ মেয়ে, পুরুষেরা ছট মাইয়ার ব্রত উদযাপনের উদ্দেশ্যে গঙ্গাযাত্রা এক চিরচেনা দৃশ্য। আর সেই দৃশ্য উপভোগ করতে রাস্তায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়েন অসংখ্য মানুষ। ‘বিহারিদের ছটপুজো’ বলে লোকমুখে পরিচিত হলেও এই প্রাচীন হিন্দু পার্বণটি আসলে উদযাপন করেন ভারতের এক বৃহত্তর অংশের মানুষ। পূর্ব ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, নেপাল তো আছেই তা ছাড়া ভারতের অন্যান্য রাজ্য, এই বঙ্গ, এমনকী বিদেশেও ছটপুজো বেশ জনপ্রিয়। ধর্ম, জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে উৎসবের বিশ্বায়ন এই দেশেই সম্ভব।
আরও পড়ুন-তদন্ত শেষ হবে কবে, প্রশ্ন আদালতের
কে এই ছটি মাই
কার্তিকমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতিথিতে ছট পুজোর উদযাপন হয়। ছট বা ছঠ, ষষ্ঠী নামের অপভ্রংশ। সূর্য ষষ্ঠী ব্রত তাই এর নাম ছটপুজো। ছটি মাইকে নিয়ে রয়েছে নানা গাথা। ঋগ্বেদের শ্লোকে সূর্যবন্দনার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। রামায়ণ অনুযায়ী কুলদেবতা সূর্যের জন্য রাম এবং সীতা ছটপুজো করেছিলেন। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে ধম্য ঋষির উপদেশ মতে সূর্যকে আরাধনা করে দ্রৌপদী অক্ষয় পাত্র লাভ করেছিলেন। আরও একটি মতে মহাবীর কর্ণ রোজ কোমর জলে দাঁড়িয়ে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য দিতেন এবং উপাসনা করতেন। তাই আজও ছট পুজোয় মানুষকে কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্যবন্দনা করতে দেখা যায়। অন্য মতে, রাজা পাণ্ডু ঋষিহত্যার পাপের প্রায়শ্চিত্তের কারণে কুন্তীর সঙ্গে বনে থাকার সময় পুত্র প্রাপ্তির জন্য সরস্বতী নদীর পারে সূর্যের উপাসনা এবং ব্রত করেছিলেন।
পুরাণ মতে, প্রিয়ংবদ নামক এক নিঃসন্তান রাজা সন্তান লাভের জন্য যজ্ঞ করান। যথা সময় রাজার পুত্র লাভ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্ত্রী মালিনীর গর্ভ হতে মৃত পুত্রের জন্ম হয়। দুঃখিত প্রিয়ংবদ পুত্রশোকে প্রাণ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। সে-সময় ব্রহ্মার মানসপুত্রী দেবসেনা প্রকট হন ও রাজাকে তাঁর পুজো করতে বলেন। দেবীর নির্দেশ অনুসারেই রাজা প্রিয়ংবদ ষষ্ঠী বা ছট বা ছটি মাইয়ার পুজো করে পুত্র লাভ করেন। অপর একটি লোককথা অনুযায়ী, সূর্যদেব ও ছট দেবী ভাই-বোন। তাই এই পুজোয় ছট দেবীর সঙ্গে সূর্যের আরাধনা ফলদায়ী মনে করা হয়।
তবে সবচেয়ে প্রচলিত যে গাথা তা হল সূর্য ও তাঁর পত্নী ঊষা যিনি ছোটি মাই নামে পরিচিত, তাঁর প্রতি সমর্পণের ভাবনা থেকে এই পুজো করা হয়। ছট পুজোতে সূর্য ও ছোটি মাই-কে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও আশীর্বাদ প্রদানের জন্য কামনা করা হয়। ছটে কোনও মূর্তি পুজোর নিয়ম নেই সূর্যই পুজোর প্রধান আরাধ্য দেবতা।
আরও পড়ুন-বাংলাদেশে ৭০০ নতুন পুজো হয়েছে: মন্ত্রী
নিয়মে-রীতিতে
ছটপুজোর ব্রত বেশ কষ্ঠসাধ্য। চারদিনের এই ব্রত শুরু হয় কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপাবলির পরে। কার্তিকের শুক্লা চতুর্থী থেকে শুক্লা সপ্তমী পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন রাত্রি হল কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী অর্থাৎ ষষ্ঠদিন। এই পুজোর দু’দিন আগে লাউয়ের কোনও পদ খেতে হয়। চারদিনের এই ব্রতের প্রথমদিন নদীতে স্নান সেরে জল এনে শুদ্ধাচারে নিরামিষ ভোজন করেন ব্রতচারী। পরের দিন থেকেই শুরু হয় উপবাস। দিনভর নির্জলা থেকে রাতে পুজো শেষ করে ক্ষীরের ভোগ গ্রহণ করেন তাঁরা। সেই রীতির নাম ‘খারনা’। এই সময় সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে পায়েস, লুচি, কলা অর্পণ করা হয়।
তৃতীয়দিনও উপবাস করে নিকটবর্তী জলাশয় বা ঘাটে গিয়ে অস্তগামী সূর্যের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য এবং দুধ অর্পণ করে। ব্রতের শেষদিনে ভোরবেলা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে সূর্যকে অর্ঘ্য দেন ছট মাইয়ার ভক্তরা। ছট পুজোর ডালাতে থাকে হলুদ গাছ, আম পল্লব, নারকেল, কলার কাঁদি, বিভিন্ন ফল, ঠেকুয়া ও খাস্তা টিকরি। সবমিলিয়ে ৩৬ ঘণ্টা কঠোরভাবে নির্জলা উপবাস করেন তাঁরা। পুজোর শেষ হলেও উপবাস ভঙ্গ হয় না পরেরদিন ভোরবেলা আবার ঘাটে যেতে হয়। অনেকে মানত করে সেখানে দন্ডিও কাটেন। প্রণাম করেন সূর্যদেবতাকে। তারপর মিষ্টি, ক্ষীর, ঠেকুয়া, নাড়ু এবং আখ, কলা, মিষ্টি লেবু প্রভৃতি ফল খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন। ছটপুজোর প্রসাদে লবণ ছোঁয়ানো হয় না। বছরে দুবার পালিত হয় ছট একটি চৈত্রমাসে চৈতি ছট এবং অপরটি কার্তিক মাসে যাকে বলে কার্তিকী ছট।
আরও পড়ুন-কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ার বুড়িমা
ছটের নির্জলা উপবাস কি স্বাস্থ্যকর?
ছটপুজোর স্নান ও কঠোর উপবাসে শরীর মন শুদ্ধ হয় এই বিশ্বাস, যাঁরা ব্রতপালন করে তাঁদের। এ তো গেল ধর্মীয় কারণ। বিজ্ঞান কী বলছে? এই দীর্ঘসময়ের নির্জলা উপবাস কতটা স্বাস্থ্যসম্মত? বিষয়টি নিয়ে বললেন কনসালটেন্ট নিউট্রিশনিস্ট মিতালী পালোধি। তাঁর মতে, ছটপুজোর উপবাস শরীর ও মনের জন্য বেশ উপকারী, উদীয়মান এবং অস্তগামী সূর্যের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভাল। সাধারণত ২৪ থেকে ৭২ ঘন্টার উপবাস হয়। ছট পালনে ৩৬ ঘণ্টা উপবাস যা মস্তিষ্কের জন্য খুব উপকারী, মাথা ভাল কাজ করে। ব্লাড শুগার কন্ট্রোল হয় অর্থাৎ ইনসুলিন রেজিসস্ট্যান্স কমায়। সহজ কথায় ইনসুলিন শরীরে কাজ করা শুরু করে ফলে ব্লাড শুগার লেভেল কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে উপবাস হল শরীরে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, বয়ঃবৃদ্ধি রোধ করে। শরীরের বিপাকীয় ক্রিয়া বা মেটাবলিজমের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। হিউম্যান গ্রোথ হরমোন (HGH) নিঃসরণ বাড়ায় যার ফলে পেশি সবল হয় ওজন কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে ২৪ ঘণ্টা উপবাস করলে রক্তে হিউম্যান গ্রোথ হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু উপবাসের কিছু কুফল আছে। যাঁরা উপোস করছেন দেখতে হবে তাঁদের কোনও ক্রনিক রোগ আছে কি না, ব্রেস্ট ফিড করাচ্ছে, সন্তানসম্ভবা, বয়স্ক মানুষের এই ধরনের কঠোর উপবাস করা অনুচিত এতে ভালর চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি। নির্জলা ছাড়া জল, ফ্রুট জ্যুস, সবজি স্যুপ খেয়েও উপবাস করা যায়। ছটপূজোর নির্জলা উপবাসের সুফল বেশি যদি শরীর নিতে পারে তবেই।
আরও পড়ুন-প্রেমিকের দেখা না পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী তিন কিশোরী
ছটে গঙ্গাদূষণ রোধের বিকল্প
গত বছর ছটপুজোর দিন একটা বিশালাকায় বাথটব কিনে, দু ড্রাম গঙ্গার জল বাড়ি এনে সেই টবের মধ্যে ঢেলে ছটপুজোর ব্রত পালন করে নজির গড়েছিলেন নিউ আলিপুরের একটি আবাসনের এক দম্পতি। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক দূরত্ববিধি মানা এবং গঙ্গাদূষণ রোধ। সত্যি এমন ভাবনা চিন্তার মানুষ কজনই বা আছেন। ছটপুজোকে ও বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে জলদূষণ নতুন ঘটনা নয়। তবে এই দূষণ রোধও করা যায় বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিষয়টিতে আলোকপাত করলেন পরিবেশবিদ ও গঙ্গাদূষণ বিশেষজ্ঞ মানস চক্রবর্তী। তিনি জানালেন গঙ্গানদী গোমুখ থেকে সূচনা হওয়ার পর নিচের দিকে নেমে একে একে উত্তরাখন, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে সুন্দরবন দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। উৎপত্তির পর গঙ্গা যখন পাহাড় থেকে নামছে শুদ্ধ, পরিস্রুত বরফগলা জল। এরপর নদীটি যখন উত্তরপ্রদেশে ঢুকল ওখানে গঙ্গা বরাবর প্রচুর ট্যানারি রয়েছে, শিল্পাঞ্চল রয়েছে যেখানকার রাসায়নিক গঙ্গায় পড়ে আর দূষিত হতে শুরু করে নদী। এই সব রাজ্যে গঙ্গার ঘাট বরাবর মিউনিসিপ্যালিটির পাইপ লাইনের এমন সংযোগ করা যে সারা শহরের বর্জ্য গঙ্গায় গিয়ে পড়ে সঙ্গে পুজোর ফুল, ফল, প্রসাদ দেবদেবীর মূর্তি সব গিয়ে পড়ছে গঙ্গাতেই। পরিণাম একটাই মাত্রাতিরিক্ত দূষণ। দূষণ দুধরনের পরিবেশগত এবং মানুষের তৈরি। যে কোনও পুজো বা উৎসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র যে দূষণ ছড়ায় তা মানুষের সৃষ্টি যা উপেক্ষণীয় নয়।
আরও পড়ুন-ন্যান্সিকেই খুনের পরিকল্পনা ছিল!
একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। গঙ্গা কতটা দূষিত সেটা মাপবার জন্য প্রত্যেক রাজ্যেই একটা করে মনিটরিং স্টেশন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এরকম আটটি মনিটরিং স্টেশন আছে। বহরমপুর, শ্রীরামপুর, দক্ষিণেশ্বর, হাওড়ার শিবপুর, গার্ডেনরিচ, উলুবেড়িয়া, পলতা, ডায়মন্ড হারবার। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জল দূষিত হচ্ছে দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায়। কলিফর্ম নামের একধরনের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যার পরিমাণ অনুযায়ী জলদূষণ কত তা বোঝা যায়। সেটা মাপার ইউনিট হল এমপিএন বা মোস্ট প্রব্যাবল নাম্বার অর্থাৎ একশো মিলিলিটার জলে সেই ব্যাকটেরিয়া কতসংখ্যক রয়েছে। এই কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া যদি পাঁচহাজার ইউনিট পর্যন্ত থাকে তাহলে সেটা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত বলা যেতে পারে কিন্তু চমকে ওঠার মতো তথ্য হল দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায় এই কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ হল দু লক্ষ আশি হাজার এমপিএন। কাজেই আটটি মনিটরিং স্টেশনে সবচেয়ে বেশি দূষিত জল দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায় আর তার একমাত্র কারণ পূজোর ফুল, ফল, পচে যাওয়া প্রসাদ, অন্য সামগ্রী এখানকার জলে সবচেয়ে বেশি পড়ে। আর ছট পুজোর মূল নিয়মরীতি পুরোটাই জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে করতে হয়।
আরও পড়ুন-লালগোলায় তাণ্ডব: বাম ছাত্র ও যুবদের
ভক্তরা স্নান করেন এবং সূর্যকে অর্ঘ্য দেন। কিন্তু তা বলে পুজো তো বন্ধ করা সম্ভব নয় কারণ পুজোকে কেন্দ্র উৎসব আমাদের সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ। দুর্গাপুজো, কালীপুজোর ক্ষেত্রেও একই। আর পুজোর ফুল সবাই গঙ্গাজলেই ফেলবে কারণ গঙ্গানদী আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রাচীন এবং পবিত্র। তাহলে দূষণ রোধের উপায় কী? উপায় একটাই ছটপুজোর সামগ্রী গঙ্গাজলে না ফেলা। মানুষই যদি পবিত্র গঙ্গাকে দূষিত হতে না দেন। এই বছরেই নামকরা একটি পুজো কমিটি গঙ্গায় তাঁদের প্রতিমা বিসর্জন না দিয়ে মণ্ডপেই জলের সাহায্যে এক অভিনব বিসর্জনের ব্যবস্থা করেছে। তেমনই ছটপুজোতেও গঙ্গার বদলে যদি লোকালয়ের মধ্যেই ছোট ছোট জলাশয় তৈরি করে দেওয়া যায় বা কোনও পুকুরকে ব্যবহার করা হয় তাহলে দূষণটা একটা জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এরপর পিউরিফিকেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে সেই জল। এই ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে খরচ সাপেক্ষ হলেও দূষণ আটকানো সম্ভব হবে। আর এই ধরনের যে কোনও উৎসব সুন্দর হয়ে উঠবে।