‘‘If the roads becomes silent, Parliament becomes awry.”
‘‘যদি রাস্তা চুপ করে যায়, তবে সংসদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।”
— রাম মনোহর লোহিয়া
ডবল ইঞ্জিন সরকার। ডবল ইঞ্জিন সরকার। ডবল ইঞ্জিন সরকার।
রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের বাদ্য বেজে উঠলেই, এই কথাটা শুনে শুনে কান ঝালাপালা। ২০২১-এ আমাদের পশ্চিমবঙ্গে শুনেছিলাম। এখন গত কয়েকমাস ধরে ভোটমুখী গুজরাতে অহরহ শোনা যাচ্ছিল।
মোরবিতে সেতুভঙ্গের পর এক লহমায় সেই কুৎসিত মিথ্যা নিনাদ বন্ধ হল কি?
গুজরাতে ডবল ইঞ্জিন সরকার বহুদিন থেকে বহাল। সেই সরকারের বদান্যতায় প্রায় দেড়শো মানুষের লাশ হয়ে যাওয়া। ডবল ইঞ্জিন সরকার সে পাপের দাগ ধুয়ে ফেলবে কোন নদীর জলে?
আরও পড়ুন-শোক ভুলে ক্ষোভ হাবিবুলের গ্রামে
একবারও কি গুজরাতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির সরকার, শেক্সপিয়রীয় ম্যাকবেথের দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে ম্যাকবেথ স্বয়ং যে কথাটা বলেছিল, সে কথাটা আয়নায় নিজেদের বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে বলবে? বলার হিম্মত দেখাতে পারবে? ম্যাকবেথের আত্মগ্লানি মাখা প্রশ্ন ছিল, ‘‘নেপচুনের বিরাট সমুদ্রের সমস্ত জলেও কি আমার হাতের রক্ত ধুয়ে ফলা সম্ভব হবে? নাকি আমার হাতটাই অসংখ্য সমুদ্রকে করে তুলবে রক্তিম, সবুজকেও রক্তের রঙে ছুপিয়ে দেবে?”
প্রশ্নটা মনে আসা স্বাভাবিক। কারণ, আত্মবীক্ষণ, আর যাই-ই হোক, বিজেপির স্বভাবধর্ম নয়। বরং, নিজেদের দোষ পরের কাঁধে চাপিয়ে, কুমিরের কান্নার নাট্যাভিনয়েই তারা সিদ্ধহস্ত। অতীতে এমন প্রমাণ আমরা অসংখ্যবার পেয়েছি। এবারও, তেমন হওয়ার সম্ভাবনার সিঁদুরে মেঘ দেখেই সম্ভবত, একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় উন্নির ব্যঙ্গচিত্র।
আরও পড়ুন-মন্ত্রীর দাদার বাড়িতে গড়ে উঠল পাঠাগার
তাতে সর্দার প্যাটেলের সুউচ্চ স্ট্যাচুটি সেটির নির্মাণ নিয়ে উৎসাহী গৈরিক পক্ষকে বলছেন, শোনো বাপু! সেতুটা জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঢের আগে তৈরি হয়েছিল। তাই এখন (ওটা ভাঙার দায় নেহরুর কাঁধে না চাপিয়ে) তোমরা বরং উদ্ধারকাজে মনোনিবেশ কর।
আচ্ছা সখী! দিবসরজনী তোমরা যে বল ‘ডবল ইঞ্জিন, ডবল ইঞ্জিন’, সখী ডবল ইঞ্জিন কারে কয়? সে কি কেবলই প্রহেলিকাময়?
কথাটা উঠছে এইজন্য যে প্রশাসনিক দক্ষতা, শাসন পরিচালনায় গতিময়তা আনার যুক্তিতে ডবল ইঞ্জিনের পক্ষে সওয়াল আমরা অযুতবার শুনেছি। আর গুজরাতে যা দেখেছি, তা হল, ডবল ইঞ্জিন সরকারের সুবাদে ২০১৪ থেকে বারংবার সেরাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল, রাজ্য মন্ত্রিসভায় কথায় কথায় পরিবর্তন। সৌজন্যে দিল্লিস্থ ইঞ্জিনের রিমোট কন্ট্রোল। সেজন্যই দুই ভূমিপুত্র, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, গুজরাতের মাটিতে পদার্পণ করলেই সমগ্র রাজ্য প্রশাসন তাঁদের সন্তুষ্টিকরণে নিয়োজিত হয়। এবারেও দেখা গেল, মোরবিতে সেতুভঙ্গে আহতদের দেখতে মঙ্গলবার মোদি হাসপাতালে যাবেন, এ খবর পাওয়ামাত্রই হাসপাতালের দেওয়ালে রঙের প্রলেপ পড়ছে। ডবল ইঞ্জিন শাসিত গুজরাতের বেহাল দশা যাতে ঘোমটার আড়াল থেকে বেরিয়ে না-পড়ে, সেজন্য রাতারাতি তৎপরতা। আক্ষেপ হয়, প্রধানমন্ত্রীর মোরবির ভাঙা সেতু পরিদর্শনকালে যত পুলিশ গুজরাত রাজ্য প্রশাসনের তরফে সেখানে মোতায়েন করা হবে, তার অর্ধেকও যদি সেতুভঙ্গের দিন সেখানে হাজির থাকত! কড়া পুলিশি নজরদারি থাকলে কি এড়ানো যেত না এই দুর্ভাগ্যজনক বিপর্যয়?
আরও পড়ুন-লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আওতাভুক্ত হতে মহিলাদের উপচে পড়া ভিড় শিবিরে
একটা কথা আর দুটো দৃষ্টান্ত আজ খুব মনে পড়ে যাচ্ছে। আর, মনে পড়ে যাচ্ছে বলেই ‘পার্টি উইথ ডিফারেন্স’ বলে নিজেদের জাহির করা দলটিকে মনে করিয়ে দেওয়ার বাসনা তীব্রতর হচ্ছে।
কথাটা হল ‘রেজিপ্সা লোকুইটার’ (resipsa loquitur)। অর্থ, নির্দিষ্ট ধরনের দুর্ঘটনা অবহেলা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। আইনি পরিমণ্ডলে সাধারণভাবে এই নীতি নির্যাতন নিপীড়নের জন্য দায়ী কে তা সাব্যস্ত করার জন্য প্রয়োগ করা হয়। মোরবির সেতুভঙ্গের ক্ষেত্রেও এই নীতিটি সমভাবে প্রযোজ্য। প্রযোজ্য কারণ, সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের জীবনরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর বর্তায় এবং মোরবিতে রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালনে সর্বৈবভাবে ব্যর্থ।
আরও পড়ুন-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্য ৩০ কোটি টাকা দেয়নি কেন্দ্র, বললেন ব্রাত্য, যাদবপুরকে ২৮ কোটি দিয়েছে রাজ্য
মাচ্ছু নদীর ওপর সেতুটি প্রাচীন। সেকথা কারও অজানা নয়। জরাজীর্ণ ‘ঝোলতা পুল’-এর মেরামতির কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছিল। এই মেরামতির কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এমন একটি সংস্থাকে, যাদের ঘড়ি বা বাল্ব তৈরির কাজে নাম থাকলেও সেতু সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও অভিজ্ঞতা নেই। রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ছ’মাস বন্ধ ছিল সেতুটি। কোনও ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া গত ২৬ অক্টোবর সেটা খুলে দেওয়া হল। পুরসভা আর পূর্ত বিভাগের কর্তারা কি জেগে ঘুমোচ্ছিলেন? নাকি সব দেখেও না-দেখার জন্য তাঁদের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও বন্দোবস্ত হয়েছিল?
ব্রিজের কাজে অনভিজ্ঞ একটি সংস্থাকে ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মাচ্ছু নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতুর দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিল রাজ্য সরকার। আর ২০২২-এ তাদের সঙ্গেই ফের ২০৩৭ পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চুক্তি করে মোরবি পুর কর্পোরেশন। অথচ, এদের কাজের গুণগত মান নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। দু-তিন মাস পূর্ত দফতরের পক্ষ থেকে সেতুটার সুরক্ষা খতিয়ে দেখার কথা। সেকাজ সরকারি দফতর করেছে বলে কখনও শোনা যায়নি। এখন রক্ষণাবেক্ষণের ভারপ্রাপ্ত সংস্থার বেশ কিছু কর্মচারীকে গ্রেফতার করে কাদের আড়াল করার তোড়জোড় চলছে?
সেতুতে তো কোনও অবস্থাতেই ৩০০-৪০০ লোক ওঠার কথা নয়। তাও কেন অত লোক উঠল? পুলিশ কেন অতিরিক্ত জনসমাগম ঠেকাতে সময়োচিত ব্যবস্থা নেয়নি? সেটা কি বেশি টিকিট বিক্রি করে বেশি টাকা কামানোর লোভাগ্নিতে ঘি ঢালার জন্য?
আরও পড়ুন-উপনির্বাচনের আগে বিজেপি প্রার্থীকে নোটিশ কমিশনের
এটা তো আর উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোনের আমল নয় যে ‘রাজা কোনও ভুল করতে পারেন না’ বলে সবাই রেহাই পেয়ে যাবে আর জাস্টিস হোমস-এর মতো মানুষ সেটাকে দু’হাত তুলে সমর্থন করবে। এযুগে, এই ভারতেই দু’জন মানুষ বিপর্যয়ের দায়ভার নিয়ে ইস্তফা দিয়েছিলেন। রেল দুর্ঘটনার পর লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং বিমান দুর্ঘটনার পর মাধবরাও সিন্ধিয়া। স্বঘোষিত ‘পার্টি উইথ ডিফারেন্স’-এর হিম্মত আছে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার?
জানি, এসব প্রশ্ন করা বৃথা। বধির কর্ণ কিছুই শোনে না। কুম্ভীরাশ্রু ফেলে যাবতীয় দায় সারার আয়োজন করে।
তখনই জেগে ওঠে রাম মনোহর লোহিয়ার কথাগুলো। যেগুলো দিয়ে শুরু করেছিলাম।
রাস্তাকে এবার প্রতিবাদে প্রতিরোধে গণকল্লোলিত করে তুলতেই হবে। নইলে সংসদ বিপ্লুত হয়ে পড়বে।
২০২৪-এ একথাটা মনে রাখতেই হবে। এটাই সেতুভঙ্গের সূত্রে আগত দৈবাদেশ।