অকৃতদারের অক্ষমতাজনিত হতাশার বহিঃপ্রকাশ! নাকি রাজ্যের বিরোধী নেতার শিশুবিরোধী মনোভাবের প্রতিফলন? বিশ্লেষণে অশোক মজুমদার
বেশ কিছুদিন আগে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট্ট তিন বছরের শিশুপুত্র সম্মন্ধে অশালীন ট্যুইট করে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তৃণমূল ছাড়ার পর থেকেই দেখছি যত দিন যাচ্ছে ততই ও অধঃপতনের এক ধাপ করে সিঁড়ি নিচে নামছে।
আরও পড়ুন-সুন্দরবনে সামুদ্রিক প্রাণী শিকার রুখতে কড়া পদক্ষেপ
ঘটনা হয়েছে… কিছুদিন আগে তাজবেঙ্গল হোটেলে ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাব যা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংসদীয় এলাকার মধ্যে পড়ে, সেই ক্লাবের প্রথম ডিভিশনে খেলার যোগ্যতা অর্জনের জন্য একটা মিটিং ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের অনুষ্ঠান ছিল। সেটাকেই অভিষেকের ছেলের জন্মদিনের পার্টি উল্লেখ করে বিরোধী দলনেতা কিছু নোংরা ট্যুইট করে ওই ছোট্ট বাচ্চাটির নামে। সঙ্গে এও অভিযোগ করে যে ওখানে নাকি পাঁচশো পুলিশ, ডগ স্কোয়াড মোতায়েন থাকার ফলে পুলিশের অপব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু দেখা যায় রাজ্যের দায়িত্বশীল বিরোধী দলনেতার বক্তব্য সর্বৈব মিথ্যা।
আরও পড়ুন-লক্ষাধিক টাকার গয়না-সহ ব্যাগ ফেরাল পুলিশ
এহেন পরিস্থিতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হবেই স্বাভাবিক। ঘটনাটি নিয়ে শিশু কমিশন পর্যন্ত মাথা ঘামিয়েছে। এমনকী মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত নিন্দা করেছেন। তবুও আমাদের বিরোধী দলনেতার কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। ও দেখছি যা বলেছি বেশ করেছির দর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর দল থেকেও আজও কোনও প্রতিক্রিয়া শোনা যায়নি।
তৃণমূল কংগ্রেসে থাকতে বিশাল ক্যারিশমা নিয়ে চলা শুভেন্দু অধিকারী আজ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া। নন্দীগ্রামে আদৌ জিতেছে কি সন্দেহ। ওর ভরসায় একুশের ভোটে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো দূর শুভেন্দু ওর হাঁটুর বয়সি অভিষেককেই সামলাতে পারছে না। ফলে এখন ওর রাগ, হতাশার শিকার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের তিন বছরের বাচ্চাটাও। এত অসহিষ্ণু অবস্থা যে ছোট শিশুকে আক্রমণ করার মতো চূড়ান্ত পর্যায়ের নৈতিক অবনতি হয়েছে ওর। বুক বাজিয়ে বিরোধী দলনেতা বলে গর্বিত শুভেন্দু অধিকারী আজ অথর্ব রাজার মতো শুধু গর্জন করে চলে। অদৃষ্টের পরিহাস বোধহয় এটাই। রাজনীতিতে আপন স্বার্থ সবাই দেখে। কেউ একশো শতাংশ সাধু নয়। কিন্তু কুকথা কটুকথা, হিংসায় জ্বলেপুড়ে রাজনীতির তরী বেয়ে রাজা হয়ে যাব, এটা কল্পনাতেই হয়।
আরও পড়ুন-ম্যান ইউয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ রোনাল্ডোর
বিষয় হচ্ছে, শুভেন্দু অধিকারী কোনওদিনই তথাকথিত নেতা ছিল না। নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকেই ওকে চিনল বাংলা। যে নন্দীগ্রাম আন্দোলন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই প্রত্যক্ষ নেতৃত্বদানের একটি জীবন্ত দলিল। জেলায় বাড়ি হবার সুবাদে শুভেন্দু ও ওর বাবা শিশির অধিকারীর উপর দায়িত্ব ছিল দেখাশোনার। আমি নিজে সাক্ষী সেসব দিনের।
শুভেন্দুর সঙ্গে কিন্তু আমারও ভাল আলাপ ছিল। যদিও শিশির অধিকারীকে (আমি শিশিরদাই বলি) আগে থেকেই জানতাম কিন্তু নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় শুভেন্দুকে ভালভাবে চিনলাম। তারপর তো রাজ্যে পালাবদলে ও হেভিওয়েট মন্ত্রীদের পর্যায়ে পড়ত। দিদি অর্থাৎ আমাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেছি ওকে অসম্ভব স্নেহের চোখে দেখতেন। শুধু তাই নয়, শিশিরদার গোটা পরিবারের প্রতিই দিদির একটা ভালবাসা ছিল।
আজ যে জায়গায় ও দাঁড়িয়ে আছে তার সবটার ভিত্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওদের বাড়ির মশা, মাছি, টিকটিকির পর্যন্ত যে রাজনৈতিক পরিচিতি তার সবটাই ওই কালীঘাটের ষাটোর্ধ্ব মেয়েটির জন্য। শুধু শুভেন্দু কেন, ওঁর দয়াতেই শিশির অধিকারীর অন্যান্য ছেলেরাও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছে অনায়াসেই। নাহলে দিব্যেন্দু অধিকারী, সৌমেন্দু অধিকারীদের ক্ষমতা জনমানসে জিরো বললেও বেশি বলা হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহছায়ায় থাকতে থাকতে শুভেন্দুর রাজনীতির ময়দানে চকমকি আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাবার ফলেই নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে ধারণাটাই ভুলে গেছিল। ফলে সবটাই পেয়ে পাওয়া চোদ্দো আনার ঔদ্ধত্য। অথচ কার্যক্ষেত্রে সবাই দেখলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছত্রছায়া ছাড়া শুভেন্দু অধিকারী স্রেফ একটা ফাঁকা টিনের আওয়াজ। একটা বড় পরিবারে থাকলে অনেক ঠোকাঠুকি হয়। সেই জায়গায় শুভেন্দুর তৃণমূল ত্যাগ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজনীতিতে এরকমটা আকছার হয়েই থাকে। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তো এর সেরা উদাহরণ। কিন্তু উনি কংগ্রেসের কোনও নেতাকে নিয়ে কখনও কটূক্তি করেননি। পাশাপাশি যাঁর হাত ধরে আজ তুমি শুভেন্দু অধিকারী হলে সেই দিদিকে তো গালি দেবার আর বোধহয় কোনও ভাষা বাকি নেই বাংলা শব্দকোষে!! অথচ এখনও পর্যন্ত দিদি কিন্তু তোমার পরিবারের অন্য সদস্যদের তো বাদই দিলাম, শিশিরদাকে উদ্দেশ্য করেও একটা কথাও উচ্চারণ করেননি। সেখানে তুমি অভিষেকের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে ওর তিন বছরের বাচ্চাকে আক্রমণ করছ…??
আরও পড়ুন-‘নাগরিকত্ব নিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে’ নেতাজি ইনডোর থেকে সরব মুখ্যমন্ত্রী
আমার মনে হয়, তুমি তো বিবাহ করোনি তাই সন্তান এই অনুভূতিটা ঠিক কেমন তোমার ধারণা নেই। বাবা হলে বুঝতে সন্তান, সে নিজের হোক বা পরের, তার প্রতি বিদ্বেষ আসে না। অভিষেকের বাচ্চা তো সেখানে দুধের শিশু। তুমি ওকে যা বলেছ তার জন্য শিশু কমিশন তোমায় নাকি ক্ষমা চাইতে বলেছে। সে আইনের কথা আইন বলবে। তোমার আসলে ক্ষমা চাওয়া উচিত অভিষেকের স্ত্রী রুজিরার কাছে। কারণ তুমি ওই ছোট্ট শিশুটিকে আঘাত করেছ শুধু নয়, অপমান করেছ একজন মাকেও। আমি জানি না শুভেন্দু, বাড়িতে তোমার মা এসব দেখেন কি না… দেখলে নিশ্চয় কষ্টই পাবেন।
ব্যাপার হচ্ছে, রাজনীতির তর্ক-বিতর্ক আজ নতুন নয়। একে অপরকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করে কথা সর্বদাই শুনে আসছি একে অপরের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই ইস্যুভিত্তিক দলীয় রাজনীতিতে মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানদের টেনে আনাটা কী ধরনের রুচির মধ্যে পড়ে ? যদিও ঠাকুর ঘরে কে আমি তো কলা খাইনির বর্তমান সংস্করণ শুভেন্দু অধিকারী তথা বিরোধী দলনেতা নতুন ট্যুইট করে প্রশ্ন তুলেছে, অভিষেকের ছেলেকে আক্রমণ করেছি এটা কোথায় দেখলেন?? ওই দুর্জনের ছলের অভাব হয় না আর কী।
আরও পড়ুন-‘নাগরিকত্ব নিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে’ নেতাজি ইনডোর থেকে সরব মুখ্যমন্ত্রী
সাংসদ তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্তানকে নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যের জন্য তার বর্তমান দলেরও কিন্তু কোনও হেলদোল নেই। বিজেপির এখনও কেউ ওকে সতর্কটুকুও করেনি। অবশ্য বিজেপি দলের ক্ষেত্রে সেটা আশা করাই অন্যায়। এই দলের সংস্কৃতির মধ্যেই পড়ে এটা। নারী, শিশু, বৃদ্ধদের সম্মান দিয়ে যে কথা বলা উচিত সেটা এই দলের কালচার নয়। শুভেন্দু কথাবার্তা যা বলছে, দেখতে গেলে ও ঠিক দলেই এন্ট্রি নিয়েছে।
বিজেপি দলের সভ্য সমাজের ডেকোরাম মানার কোনও নৈতিকতা কোনওকালেই নেই। ওরা যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতা হস্তগত করে কী করে রাখব সেইটাই একমাত্র বিবেচনায় রাখে। রাজনীতির সভ্যতা, ভদ্রতা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা— এসব ওরা জানে না। ফলে শুভেন্দু অধিকারীও গোবলয় সংস্কৃতির সেই ধারার ব্যাটন হাতে তুলে অভিষেকের ছেলেকে আক্রমণ করে ভাবছে কী দুরন্ত লড়াই সে করছে মাঠে-ময়দানে।
শুভেন্দু আসলে বোকা। নাহলে একুশের ভোটে মানুষ ওকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ওর আদতে পাড়ার বুথ সামলানোর মতো রাজনৈতিক বোধটুকুও নেই। বিজেপি দলের ছাতাটুকু আছে বলে বিরোধী দলনেতা হয়ে এখনও প্রচারের আলো পড়ছে, যেদিন সেটাও থাকবে না ওর ভবঘুরের ঠিকানাও জুটবে না। ও এখন প্রচারের আলোয় ভেসে থাকার চেষ্টা করছে এলোমেলো কথা বলে। শুভেন্দু ঠিক এখানেই ফেঁসে গেছে। শুধুমাত্র ক্ষমতার ক্ষীর খাওয়ার স্বার্থ ওকে মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এখন ওর রাজনীতি একটি পরিবারের প্রতি সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়ে পাঁকের মধ্যে পাক খাচ্ছে। ও সেটা থেকে বেরোতে পারছে না। ফলে মুখে যা আসছে তাই বলে আরও বেশি করে গায়ে কালি মাখছে। মানুষ এখন ওকে দেখে জোকারের মতো মজা নেয়। কী আশ্চর্য সমাপতন ছেলেটিকে মাত্র এই ক’দিনে দেখে আমার নিজেরই হাসি পায়। যাইহোক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনীতির কৌশলে গো-হারা হেরে নিজের রাজনৈতিক অস্থিরতা ঢাকতে যতই তুমি ওই বাড়ির কচিকাঁচাদের সম্বন্ধে খারাপ মন্তব্য করবে, ততই তুমি আরও মানুষের চোখে নেমে যাবে। তাই এই বাঁদর নাচে মানুষের মনোরঞ্জন হয়তো হবে কিন্তু ভোটের ময়দানে কেউ পাত্তা দেবে না। মানুষ অত বোকা নয় যে কিছু না ভেবেই আসন পেতে রাখবে যার তার জন্য। রাজনীতিতে ভরসা- ভালবাসা, বিশ্বাসই একমাত্র মূলধন। যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্জন করেছেন। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আর বহু বছরের তিতিক্ষার ফলে আজ উনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পড়ুন-ফের বিরোধী দলনেতাকে কড়া নোটিশ
কেন্দ্রের শাসক দল করলেও শুভেন্দু অধিকারী এই রাজনৈতিক রেসে একজন সামান্য প্রতিযোগী হবার যোগ্যতাও রাখে না। বারবার প্রমাণিত বাস্তব এটা। নাহলে একটা শিশুকে ঢাল করতে হয় প্রচারে টিকে থাকার জন্য! ওর বিবেক বুদ্ধির জলাঞ্জলি বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোর দিনই অবশ্য হয়ে গেছে। তাই এখন ওর অবস্থা না ঘরকা- না ঘাটকা। ফলে সারাদিন যা মনে হয় বকেই যায় প্রলাপের মতো। আজ যতই বিরোধী দলনেতার মুখোশ আর বর্মের সুরক্ষায় লাফাক শুভেন্দু অধিকারী… প্রতিহিংসা, কুকথা ছেড়ে রাজনীতির মূলস্রোতে না ফিরলে একটি অক্ষম নেতা হয়ে থেকে যাবে আজীবন, এটা ও ছাড়া বাংলার সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বিলক্ষণ জানে। বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি এই ধরনের অসভ্য বর্বরদের প্রশ্রয় দেয় না। ফলে বাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিল, আছে, আগামিদিনেও থাকবে।