বাঙালির অন্যতম প্রিয় ঋতু হেমন্ত। কেন প্রিয়, বলা মুশকিল। সাধারণের চোখে এই ঋতু খানিকটা শীতের মতোই। কুয়াশা, টুপটাপ শিশির। একটু অন্যরকম।
সৃষ্টিশীল মানুষদের কাছেও হেমন্তের মহিমা অপরিসীম। এটা ঠিক, তাঁদের মনের মধ্যে কখন, কীভাবে ভাবের উদয় হয় কেউই ঠিক বলতে পারেন না। লেখার জন্ম হয় আপনা আপনিই। বলা ভাল, হয়ে ওঠে। তবে বিশেষ ঘটনা, বিশেষ সময়ের প্রভাব কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
কার্তিক এবং অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল। সময়টা আপাতভাবে বিষাদময়। ঝলমলে উৎসবের মরশুমের পর যেন কিছুটা নিষ্প্রভ। অনেকটা আলোর পরে ছায়া ছায়া কালোর মতো। তবু এই ঋতুতে মজেছেন বহু কবি। তাঁদের বিভিন্ন লেখায় দেখা গেছে আটপৌরে হেমন্তের সলাজ উপস্থিতি।
বৈষ্ণব পদকর্তাদের বিভিন্ন রচনার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কবিদের কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে লেগেছে হেমন্তের ঢেউ।
আরও পড়ুন-বহুমাত্রিক লেখনীর স্রষ্টা ছিলেন উপেক্ষিত কথাসাহিত্যিক আবদুল জব্বার
শুরুতেই ফিরে যাওয়া যাক অতীতকালে। মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। তাঁর লেখা ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে পাওয়া যায় হেমন্তের নরম উল্লেখ। তিনি লেখেন :
‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ/ যগজনে করে শীত নিবারণ বাস।’
কার্তিক মাসে সূচনা হয় হেমন্তের। তখনই শোনা যায় শীতের আগমন বার্তা। চলে তার প্রস্তুতি। পদের মধ্যে দিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন কবিকঙ্কন।
লোচনদাস বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম পদকর্তা। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান তোলার উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর পদে। তিনি লেখেন :
‘অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।/ সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে।’
অন্যতম বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাসের একটি পদে দেখা যায় হেমন্তে রাস উৎসবের ছবি। কবি লেখেন :
‘আঘাণ মাস রাস রস সায়র/ নায়র মাথুরা গেল।/ পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ/ বৃন্দাবন বন ভেল।’
এই ঝলমলে রাস উৎসব যে রাধাকৃষ্ণকে ঘিরে, বিলক্ষণ বোঝা যায়।
আরও পড়ুন-জনসমুদ্রে অবরুদ্ধ রামনগর, বিরোধী দলনেতাকে চ্যালেঞ্জ বীরবাহার
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নির্ভেজাল প্রকৃতিপ্রেমী। পরিণত বয়সে তিনি ছয় ঋতুর অপার সৌন্দর্য গভীরভাবে অনুভব করেছেন। তাঁর বিভিন্ন কবিতায়, গানে অন্যান্য ঋতুর মতোই এসেছে হেমন্তের বিবিধ প্রসঙ্গ। বিশেষ এই ঋতুকে তিনি দেখেছেন নানাভাবে।
তাঁর ঋতুভিত্তিক গান তিনশো। তারমধ্যে হেমন্তের গান মোট পাঁচটি। অন্যান্য ঋতুর তুলনায় অনেকটাই কম। তবে ওই পাঁচটি গানেই হেমন্তের অপরূপ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। আছে হেমন্ত নিয়ে তাঁর বিস্তর কবিতা।
‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থের ‘বৃষ্টি রৌদ্র’ কবিতায় তিনি লেখেন :
‘কার্তিকের এই ধানের খেতে/ ভিজে হাওয়া উঠল মেতে/ সবুজ ঢেউয়ের পরে।/ পরশ লেগে দিশে দিশে/ হি হি করে ধানের শিষে/ শীতের কাঁপন ধরে।’
হেমন্তের হাওয়ায় শীতের প্রবল উপস্থিতি তিনি উপলব্ধি করেছেন। ‘সবুজ ঢেউ’-এর মধ্যে দিয়ে এঁকেছেন ধানখেতে দোলা লাগার অপরূপ ছবি। চিরকালীন বাংলার অপরূপ রূপ ধরা পড়েছে লেখাটিতে।
আরও পড়ুন-ছুটি বাতিল, রাত জেগে আবাস যোজনার কাজ
আরও একটি কবিতায় তিনি লেখেন :
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে/ জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে/ শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার/ রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার/ স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’
এই ঋতুর মধ্যে তিনি খুঁজে পান অপার শান্তি। পাশাপাশি হেমন্তকে তিনি ফসলের ঋতু হিসেবেও দেখেছেন। গানে গানে এই ঋতুকে সম্বোধন করেছেন ‘হেমন্তলক্ষ্মী’। উল্লেখ করা যাক তাঁর একটি গানের :
‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা–/ হিমেল ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা।’
এই হেমন্ত অপরূপা সুন্দরী। তবে কিছুটা লাজুক। তাই এই অবগুণ্ঠন। ঋতুর বৈশিষ্ট্যই যেন তাই। সবার মাঝে একা। এঁকে রাখে কুয়াশার পর্দা।
কবিগুরুর লেখা হেমন্তের আরও একটি মন ব্যাকুল করা গান :
‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে/ হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে/ ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো–/ দীপালিকায় জ্বালাও আলো,/ জ্বালাও আলো, আপন আলো, / সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’
আরও পড়ুন-গো ব্যাক? মন্ত্রী সুভাষের লাথি দলীয় কর্মীকেই!
গানটি বহুগীত, বহুশ্রুত। এই গানে হেমন্তের তারাভরা রাতের আশ্চর্য ছবি ফুটে উঠেছে। ‘গগনের দীপ’ আকাশপ্রদীপও হতে পারে। কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন আলোর উৎসবকে। এই আলোর উৎসব দীপাবলি।
পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় ধরা পড়েছে শ্যামল বাংলার রূপ। ধীর পায়ে এসেছে হেমন্তও। তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে পাকা ফসলের ছবি। তিনি লেখেন :
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,/ সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।/ ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু/ কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। হেমন্তের প্রতি তাঁর অনুরাগ কবিদের মধ্যে সর্বাধিক। এই বিশেষ ঋতুকে নিয়ে তাঁর মতো কেউই আবেগতাড়িত হতে পারেননি। তাঁর কবিতার রস আস্বাদন করে অনেকেই হেমন্তের প্রেমে পড়েছেন।
‘পিপাসার গান’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন :
‘এ দেহ অলস মেয়ে/ পুরুষের সোহাগে অবশ/ চুমে লয় রৌদ্রের রস/ হেমন্ত বৈকালে/ উড়ো পাখপাখালির পালে/ উঠানের পেতে থাকে কান,/ শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ/ অঘ্রাণের মাঝরাতে।’
আরও পড়ুন-কুচিপুড়ি নৃত্যে মাতিয়ে দিল ঋষি-কন্যা অনুষ্কা
অসামান্য এক প্রেমের কবিতা। একটি শান্ত ঋতুর সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় প্রেম। এই ঋতু এক এবং অদ্বিতীয় হেমন্ত।
শিশিরভেজা ঋতুকে নিয়ে কবি লেখেন :
‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে/ হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল;/ অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/ হিম হয়ে আসে/ বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা!/বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!’
হেমন্তকে আশ্রয় করে অসামান্য এক চিত্রকল্প রচনা করেছেন কবি। এই রূপে তারল্য নেই, অতি মাত্রায় গম্ভীর। শিশির-কুয়াশা-নদী মিলেমিশে একাকার। জীবনানন্দের অক্ষর সরণি বেয়ে এগোলে মনে হয়, বসন্ত নয়, হেমন্তই তাঁর ঋতুরাজ। চোখ বুজে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন বিষণ্ণ এই ঋতুর শ্বাস প্রশ্বাসের প্রতিটি ওঠানামা।
ঋতুটি নিয়ে অদ্ভুত এক ভাবনার প্রকাশ দেখা যায় তাঁর আরও একটি লেখায় :
‘অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে/ সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু।’
মাসের তুলনায় ঋতুকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। অথচ মাসটি ওই ঋতুরই জাতক।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
আরও একটি ফসলের কবিতা : ‘হেমন্তের ধান ওঠে ফলে/ দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে।’
এমন অজস্র জীবনানন্দীয় পংক্তি ছড়িয়ে রয়েছে হেমন্তের নির্জন মাঠেঘাটে। ইঁদুর জানে, শালিক জানে, লক্ষ্মীপেঁচা জানে। জানে নবান্ন পরব, কার্তিকের নীল কুয়াশা। হেমন্তের রূপসী মুখমণ্ডলেই তিনি হয়তো খুঁজে পান বাংলার মুখ।
হেমন্ত-জাতক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। দু’দিন আগেই পালিত হয়েছে তাঁর জন্মদিন। হেমন্তকাল যেন মিশে রয়েছে তাঁর চরিত্রে। কবিতার মধ্যে দিয়ে তিনি করেছেন আনমনা এই ঋতুর বন্দনা। হেমন্তের অপরূপ সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি কালোত্তীর্ণ কবিতায় :
‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক।/ তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিল ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন/ কতকালের পুরোনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে/ তাই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি/ আমি দেখেছি কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে/ বকের মতো নিভৃত মাছ।’
এক-একজন কবির চোখে এক-এক রকম ভাবে ধরা পড়েছে হেমন্তের ঝিমধরা সৌন্দর্য। এই ভাবেই এই ঋতু তীব্র নেশায় আবিষ্ট করে রেখেছে বিভিন্ন সময়ের কবিদের। আগামী দিনেও এর অন্যথা হবে না।