জন্মেই কেউ যৌনকর্মী হয়ে যান না। এই পথে আসার পিছনে আছে নানা কারণ। কারও সঙ্গে তঞ্চকতা হয়েছে, কাউকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনা হয়েছে। আর একটা শ্রেণি আছে, যাঁরা অর্থনৈতিক সমস্যার ফলে সংসার প্রতিপালনের জন্য জেনে বুঝেই এই পেশায় এসেছেন। একেবারে স্বেচ্ছায়। এই সংখ্যাটা ইদানীংকালে বাড়ছে।
আরও পড়ুন-উপেক্ষিত এক আগুনের ফুলকি প্রয়াণের ৯০ বছর পরেও
অভিযোগ, বিভিন্ন ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে যৌনকর্মীদের। সমস্যায় পড়ছেন তাঁরা। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জন্ম হয়েছে একটি সংগঠনের। দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি। পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীর সমষ্টিগত দল। ১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় সবচেয়ে বড় নিষিদ্ধপল্লি সোনাগাছিতে শুরু হয়েছিল একটি প্রোজেক্ট। এর পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন কলকাতার অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড পাবলিক হেলথের জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ড. স্মরজিৎ জানা। প্রোজেক্টে নারী অধিকার, যৌনকর্মীদের অধিকার সমর্থন, মানব পাচার বিরোধী এবং এইচআইভি বা এইডস প্রতিরোধ নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়ে। একটা সময় প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় একটি সংগঠনের। ১৯৯৫ সালে জন্ম নেয় দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি।
আরও পড়ুন-কলেজিয়াম বৈঠকের তথ্য প্রকাশ নয় : সুপ্রিম কোর্ট
দুর্বার-এর জনসংযোগ আধিকারিক মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়। যৌনকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে তিনি ঘুরে বেড়ান সারা রাজ্যে। মহিলাদের কথা শোনেন, চেষ্টা করেন সমস্যা সমাধানের। কথা হল তাঁর সঙ্গে। জানতে চাইলাম, কীভাবে যৌনকর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে? তিনি বলেন, অনেকরকম ভাবে তঞ্চকতা করা হয়। কেউ তাঁদের নিয়ে আসে কাজ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, কেউ ভালবাসার অভিনয় করে। মহিলাটি দেখলেন একা থাকলে খেতে পাব না। তার চেয়ে যদি একটা কাজ পাওয়া যায় তো ভালই। তাই তাঁরা পুরুষ সঙ্গীর উপর চোখ বুজে বিশ্বাস করেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই ঠকে যান। আসলে সাধারণ মেয়েদের সোনাগাছি বা রেড লাইট এরিয়া সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা থাকে না। তাই সহজেই তাঁদের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। এমন ঘটনাও ঘটেছে, একসঙ্গে ১০ দিন ১৫ দিন থাকার পর একদিন হঠাৎ দেখলেন পুরুষ সঙ্গীটি উধাও। পরে জানা গেল, লোকটি তাঁকে বিক্রি করে দিয়ে পালিয়েছে। মেয়েটি বাধ্য হয়ে জড়িয়ে পড়ছেন দেহ ব্যবসার কাজে। এটা এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির আসার পরে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে।
আরও পড়ুন-রাজ্যসভায় পেশ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল, তৃণমূলসহ বিরোধীদের ক্ষোভের মুখে সরকার
যৌনকর্মীরা কি চান, সন্তানরা এই জগতে আসুক? তিনি বললেন, কোনও যৌনকর্মী মা চান না তাঁর সন্তান এই পেশায় আসুক। তাঁরা চান সন্তানরা পড়াশোনা করুক, শিক্ষিত হোক, আর পাঁচজনের মতো নিজের পায়ে দাঁড়াক। ডাক্তার, উকিল, স্কুল টিচার, সরকারি চাকরির মতো পেশা বেছে নিক। আমরা অনেক বাচ্চাকে দেখেছি, যারা বড় হয়ে পুলিশ হতে চায়। কেন? এর পিছনে আছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটা বিশেষ দিক। কারণটা হল, নিচুতলার কিছু পুলিশ কর্মী মাঝেমধ্যেই যৌনপল্লিতে এসে অত্যাচার করেন, ভয় দেখান, কাস্টমারদের তুলে নিয়ে যান, কেস দেন। এমন কোনও কাস্টমার, যাঁকে সেই বাচ্চাটি কাকু ডাকে, যাঁর কাছে উপহার পায়, চোখের সামনে তাঁকে নিচুতলার পুলিশ কর্মীদের হাতে হেনস্তা হাতে দেখে বাচ্চাটির পুলিশের উপর একটা আক্রোশ জন্মায়। এই আক্রোশ থেকেই মনের মধ্যে জাগে পুলিশ হওয়ার ইচ্ছে। ঘটনা হচ্ছে এই ধরনের নিচুতলার পুলিশের সংখ্যা হাতেগোনা। তাঁদের কাছে কিন্তু উপরমহলের নির্দেশ থাকে না। স্বেচ্ছায় তাঁরা এমন কাণ্ড করেন। প্রতিদিন তাঁদের নির্দিষ্ট পরিমাণ কেস দিতে হয়। তাই অনৈতিকভাবে বেশিরভাগ টাকা পতিতাপল্লি থেকে তুলে নিয়ে যান। বিষয়টা হল, রেড লাইট এলাকা থেকে যখন কাউকে ধরা হচ্ছে সেটা কিন্তু রেডের নামান্তর। সেখানে কিন্তু নিচুতলার পুলিশকর্মী যেতেই পারেন না। তাঁদের এক্তিয়ারই নেই। যেতে হবে উপরতলার পুলিশকে। কিন্তু নিচুতলার কিছু পুলিশ অন্যায় ভাবে প্রবেশ করে সমস্যার সৃষ্টি করছেন যৌনকর্মীদের কাজে। এইভাবেই লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। যদিও এই সরকার আসার পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার দিন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যৌনকর্মী সংগঠনকে। এটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তিনি এঁদের প্রতি যথেষ্ট সহমর্মী। তবু উপরতলার পুলিশের নির্দেশ ছাড়াই নিচুতলার হাতেগোনা কিছু পুলিশ অনৈতিকভাবে কাজ করে চলেছেন। আশাকরি অচিরেই এই সমস্যার সমাধান হবে।
আরও পড়ুন-রাজ্যসভায় পেশ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল, তৃণমূলসহ বিরোধীদের ক্ষোভের মুখে সরকার
এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, হাতের পাঁচটা আঙুল সমান নয়। বেশিরভাগ পুলিশ অফিসার বিভিন্ন ভাবে যৌনকর্মীদের সাহায্য করেন। সমস্যা দেখা দিলে যৌনকর্মী সংগঠনের পাশে দাঁড়ান। লকডাউনের সময় তাঁরা পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেখা গেছে তাঁদের মানবিক রূপ। খাবার পৌঁছে দিয়েছেন কর্মহীন দিদিদের ঘরে ঘরে।
একটা সময় যৌনকর্মীদের সন্তানের বিভিন্ন ভাবে হেনস্তা করা হত। দেখা হত নিচু চোখে। দেওয়া হত গালিগালাজ। অসহায় বোধ করত বাচ্চারা। অনেক সময় ভর্তি নেওয়া হত না স্কুলে। এইভাবেই লঙ্ঘিত হত তাদের মানবাধিকার। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এর পিছনে কাজ করেছে দীর্ঘ আন্দোলন এবং কিছু সহৃদয় মানুষের সহযোগিতা। এই বিষয়ে মহাশ্বেতা বললেন, একটা বাচ্চা ফুলের মতো। সে কোথায় জন্মেছে সেটা বড় কথা নয়। তার অধিকার আছে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার। সেটা কিছুতেই করতে দেওয়া হত না। মানসিকভাবে হেনস্তা করা হত। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক মস্তবড় উদাহরণ। স্কুলে ভর্তি নিয়ে সমস্যা দেখা দিত। চাওয়া হত বাবার নাম। সহপাঠীরা পাশে বসত না, কথা বলত না। একটি ঘটনার কথা বলি। একটি বাচ্চা ছেলে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠছিল। যাচ্ছিল স্কুলে। ছিল বন্ধু-বান্ধব। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় যখন বন্ধুরা জানতে পারল সে যৌনকর্মীর সন্তান, মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেল পরিস্থিতি। এক সময় যাদের সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খেত, খেলাধুলা করত, তারা সরে গেল দূরে। বন্ধ করে দিল কথা বলা। ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলেন শিক্ষকরাও। বাচ্চাটা একেবারে একা হয়ে গেল। বেড়ে গেল ভয়ঙ্কর মানসিক চাপ। এর থেকে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর কী হতে পারে?
আরও পড়ুন-১৫ বছর পলাতক থাকার পর দিঘা থেকে গ্রেফতার খুনি
একটু থেমে মহাশ্বেতা যোগ করলেন, সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা বদলে গেছে। এখন যৌনকর্মীদের সন্তানরা অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। উচ্চশিক্ষা লাভের পর গ্রহণ করছে উল্লেখযোগ্য পেশা। মায়ের পেশা নিয়ে তাদের কোনও অভিযোগ নেই। তারা মাকে একজন কর্মী হিসেবেই দেখে। বোঝার চেষ্টা করে তাঁর লড়াইয়ের দিকটা। যৌনকর্মীদের সন্তানদের একটি সংগঠন আছে। নাম ‘আমরা পদাতিক’। ২০০৬ সাল থেকে এই সংগঠন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। এই সংস্থার উদ্যোগে প্রতি বছর মানবাধিকার দিবসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। হচ্ছে এবারও। একটা সময় নিজেদের পেশার কথা মাথা উঁচু করে বলতে পারতেন না যৌনকর্মীরা। লজ্জা পেতেন, নিজেদের গুটিয়ে রাখতেন। দিন বদলেছে। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। এই প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, রাজ্য জুড়ে আছেন অসংখ্য যৌনকর্মী। মহামান্য আদালত তাঁদের পেশাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বেশিরভাগ যৌনকর্মীই এখন নিজেদের পেশার কথা প্রকাশ্যে বলতে পারেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অথবা টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে। খবরের কাগজেও বিভিন্ন সময় যৌনকর্মী হিসেবে অনেকের ছবি ও নাম ছাপা হয়। মানসিকতার এই বদল ঘটিয়েছে আমাদের সংগঠন। সংগঠনের কর্মী হিসেবে আমি নিজে ছুটে গেছি বিভিন্ন জায়গায়। যেখানেই গেছি কমিউনিটি মেম্বারদের সঙ্গে নিয়ে গেছি। তাঁদের লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেছি জনসমক্ষে। কথা বলেছি নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কদের সঙ্গে। তাঁদের জানিয়েছি কীভাবে যৌনকর্মীদের রুটিরুজির ওপর আঘাত হানা হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তাঁরা সমস্যার কথা শুনেছেন এবং সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এই ক্ষেত্রে মহামান্য আদালতের ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না।
আরও পড়ুন-বিয়েবাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, মৃত একাধিক, আহত ৬০
করোনা পরিস্থিতির ফলে মহাসংকটে পড়েছিল এই পেশা। একটা সময় প্রায় দশ হাজার যৌনকর্মী ছিলেন সোনাগাছিতে। ব্রথেল এবং ফ্লাইং মিলিয়ে। সারা রাজ্যে সংখ্যাটা আরও বেশি। লকডাউনের পরে অনেকেই বাধ্য হয়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কেউ মাছ বিক্রি করেন, কেউ সবজি বিক্রি করেন, কেউ করেন ঘরে ঘরে বাসন মাজার কাজ। যৌনকর্মীদের পাশে জন্মলগ্ন থেকেই ছিল দুর্বার। আজও আছে। সমিতির পরিচালনার কাজে যুক্ত করার জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে যৌনকর্মীদের মধ্যে থেকেই তুলে আনা হচ্ছে প্রতিনিধি। এই সংগঠনের জন্য আজ কিছুটা হলেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছেন যৌনকর্মীরা। কিছুটা হলেও আটকানো গেছে বহিরাগতদের অন্যায় অত্যাচার। যাতে কোনওভাবেই যৌনকর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা না হয় সেই দিকে রাখা হচ্ছে কড়া নজর। যেটুকু সমস্যা আছে, আশা করা যায় আগামী দিনে সমাধান হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, যৌনকর্মীরা এই সমাজের অংশ। সমাজে আর পাঁচজনের মতো তাঁদেরও স্বাভাবিকভাবে বাঁচার অধিকার আছে।