চাইলেই সব অধিকার মেলে না। অধিকার অর্জন করে নিতে হয়। এই সম্পর্ক অনেকটা শিশুর ক্রন্দনের সঙ্গে মাতৃদুগ্ধ দানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পশ্চিমবাংলার পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শিক্ষার অধিকার অর্জনের লড়াইটাও ঠিক তেমনই ছিল।
বিশ বছর ধরে এই লড়াইটা লড়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুর থানার একটি শিক্ষা ও সমাজসেবী সংস্থা। তাদের লড়াইয়ের কুড়ি বছর পর জয় হয়। জয় হয় বাংলার সংখ্যালঘু সমাজের। রাষ্ট্রের দেওয়া সাংবিধানিক অধিকার অর্জনের সেই লড়াই এককভাবে লড়েছিলেন সংস্থার প্রধান আইনজীবী মুন্সি আবুল কাশেম।
আরও পড়ুন-বেঁচে থাকো ভাষা
বাম সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সংখ্যালঘু সমাজের যে করুণ দশা হয়েছিল তা সাচার রিপোর্ট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়৷ শেষ দিকে বামফ্রন্ট সরকার খানিক নিজেদের শোধরানোর চেষ্টা করলেও ততদিনে ক্ষমতাচ্যুত করে জনসাধারণ৷ সংখ্যালঘুরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তাদের থেকে৷ পালাবদল হল রাজ্যে৷ ২০১১–য় ক্ষমতায় এল তৃণমূল কংগ্রেস সরকার৷ নতুন সরকারে সংখ্যালঘুরা প্রথমেই তাদের আত্মপরিচয় ফিরে পায়। পূর্বতন সরকারে সংখ্যালঘুরা আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগত। তৃণমূল সরকারে তা নেই। ক্ষমতায় এসেই সরকার শিক্ষায় অনেকগুলো নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সংখ্যালঘু ছাত্রবৃত্তি বৃদ্ধি, নিউটাউনে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের নয়া ক্যাম্পাসে গড়ে তোলা, সংখ্যালঘু মিশনারিগুলোকে অনুমোদনের সুযোগ করে দেওয়া, আন–এডেড মাদ্রাসাগুলোকে অনুমোদন-সহ নানা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সরকার৷ সম্প্রতি ঐক্যশ্রী প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু দফতর ‘স্কচ অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেছে৷
আরও পড়ুন-মহাসমারোহে অমৃত মহোৎসব, সংখ্যালঘু অধিকাররক্ষা আজও সেই তিমিরে
তখন রাজ্যে ক্ষমতায় বামফ্রন্ট সরকার। ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গায়ে সংখ্যালঘু তকমা লাগাতে চায়নি। সরকারের সেই ভাবনায় খর্ব হচ্ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সমাজের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার। কারণ, সংখ্যালঘু সমাজের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা যে অধিকার প্রথম থেকেই ভোগ করে আসছিল। সাংবিধানের সেই অধিকার ফিরে পেতেই লড়াই শুরু হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে চলে আসা অধিকার আদায়ের আন্দোলনে দোসর হয়ে যায় কেন্দ্র সরকারের সাচার কমিটির রিপোর্ট। তখন নতুন করে দাবি ওঠে সংবিধানের ৩০ ধারায় সংখ্যালঘুর শিক্ষার অধিকার আইনটি ফেরানো হোক। ফলে, স্বাধীনতার পঞ্চান্ন বছর পর তৎকালীন সরকার রাজ্যে সংবিধানের ৩০ ধারায় বর্ণিত সংখ্যালঘুর শিক্ষা অধিকারের সুযোগ সুবিধে দেওয়ার কথা ভাবনায় রাখে৷
আরও পড়ুন-তিনটি ছোটদের পত্রিকা
দীর্ঘ আন্দোলন এবং সাচার রিপোর্টের নির্দেশিকা আসার ফলে ৩১ বছর পর বাম সরকার তাদের নীতিগত অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। ২০০৮ সালের ২৭ জুন মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীদের দ্বারা পরিচালিত স্ব–উদ্যোগের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বীকৃতি দেবার কথা জানানো হয়। যদিও সেখানে বলা হয় অনুমোদন মিলবে, কোনওরকম আর্থিক অনুদান মিলবে না। তাতে নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়েছে।
জানা যায়, রাজ্যের বাম সরকারের নীতিগত অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসার উপায় ছিল না। কারণ, আন্দোলন ততদিনে গড়িয়েছে দিল্লির ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর মাইনোরিটি এডুকেশন’ পর্যন্ত। যাদের অধীনে থাকা দেশের কয়েকটি প্রদেশে এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। এর অধিকাংশই ছিল খ্রিস্টান মিশনারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পশ্চিমবঙ্গেও ছিল এ ধরনের স্কুল। ছিল না সংখ্যালঘু মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিত কোনও শিক্ষাকেন্দ্র। এ রাজ্যেও ৩০ ধারা লাগু করা জরুরি ছিল। কিন্তু তা করেনি রাজ্য সরকার। সরকারের গড়িমসির ফলেই ওই সংস্থা দিল্লি সরকারের দ্বারস্থ হয়। সংবিধানের ৩০ ধারা মেনে তারা অনুমোদন পেয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম সংখ্যালঘু মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিত ‘সোসাইটি ফর ইসলামিক এডুকেশন’ যারা কেন্দ্রের সংখ্যালঘু তকমা পায় ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর। এই সংস্থার অধীনে ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিশু বিকাশ একাডেমি৷
আরও পড়ুন-ব্যবস্থাপনায় খুশি শাহ, মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দফতরে
দিল্লি থেকে অনুমোদন আসার ফলে চাপে পড়ে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় তৎকালীন বাম সরকার। কিছুটা অপবাদ ঢাকতেই ২০০৮ সালে সরকার মন্ত্রিসভা বৈঠক ডেকে ৩০ নং ধারাকে কার্যকরী করার উদ্যোগ নেয়। বাম সরকার বাধ্য হয় আবেদন গ্রহণ করতে৷ ওই পর্যন্ত শেষ৷ তারপর তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে এসে ২০১২-তে মাধ্যমিক এবং ২০১৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক বোর্ডের অনুমোদন দেয়৷ যদিও সংখ্যালঘু তকমা পায়নি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি৷ এ বিষয়ে নতুন করে আবেদন করতে বলে সংশ্লিষ্ট দফতর৷
দীর্ঘ দুই দশকের চেষ্টায় কীভাবে লড়াইয়ে সফল হলেন সেকথা জানতে সরাসরি কথা বলেছিলাম মুন্সি আবুল কাশেমের সঙ্গে। প্রবীণ শিক্ষাবিদ আইনজ্ঞ কাশেম সাহেবের অভিজ্ঞতা পাঠককে জানানোর আগে আমরা বরং জেনে নিতে পারি সংবিধানের ৩০ নং ধারাটি। যে ধারার বলে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সমাজের শিক্ষার পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আরও পড়ুন-নীতি আয়োগের কথা বলে আরতি কটন মিল বিক্রির চেষ্টা
সংবিধানের ৩০(১) নং ধারা এবং ৩০(২) নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধর্ম বা ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি নিজেদের পছন্দ মতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবেন’ এবং ‘এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সাহায্য প্রদানের বিষয়ে রাষ্ট্র কোনওরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ করবেন না।’
সংখ্যালঘুদের স্কুলমুখী করে তুলতেই স্কুল গড়ার কথা ভাবেন কাশেম সাহেব। স্কুলের মডেল অনুধাবন করতে গিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন রাজ্যে গঠিত স্ব-উদ্যোগের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন ও খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলের একাধিক শাখাগুলোতে। মহারাজ ও পাদ্রিদের সঙ্গে কথা বলে স্কুল গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা নেন।
আরও পড়ুন-জলঙ্গির কৃষক পাবেন বিনামূল্যে সেচের জল
রাজ্যে কয়েকশো খ্রিস্টান মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের পরিচালন ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করেন খ্রিস্টান সমাজের কোনও ব্যক্তি। ৩০ নং ধারার অনুমোদন রয়েছে অনেকের। বাঙালি মুসলিমরাও এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে শুরু করে গত শতকের আটের দশক থেকে। ১৯৮৫ সালে সোনারপুর থানার চাকবেড়িয়া মকরমপুরে অবস্থিত ‘সোসাইটি ফর ইসলামিক এডুকেশন’–এর অধীনে ‘শিশু বিকাশ একাডেমি’ পশ্চিমবঙ্গের প্রথম স্ব-উদ্যোগের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠান ১৯৮৭ সাল থেকে সংবিধানের ৩০ ধারার অনুমোদন পেতে শিক্ষা দফতরের সমস্ত শাখায় ঘুরতে থাকে। যদিও শিক্ষা দফতর তাদের সাফ জানিয়ে দেয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেবে না রাজ্য সরকার। উল্লেখ করা যেতে পারে, স্বাধীন দেশের সংবিধানে বর্ণিত সংখ্যালঘু শিক্ষার অধিকারটিকে এ রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার লাগু করেনি। যদিও তার তোয়াক্কা না করে কেন্দ্রীয়ভাবে ২০০৭ সালে সেই অধিকার অর্জন করেন কাশেম সাহেব৷ স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর বাংলার সংখ্যালঘু সমাজের মুসলিমরা সংবিধান প্রদত্ত স্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মৌলিক অধিকার ফিরে পায়।
কাশেম সাহেব জানান, মুসলিমদের শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার বিষয়টি প্রথমে সরকার মানতে চায়নি। শাপে বর হয় ২০০৬ সালের সাচার রিপোর্ট। সেই রিপোর্টে আমরা প্রথম জানতে পারি, পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণ শিক্ষায় ও আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। তাদের এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা সাচার রিপোর্টে প্রকাশ পায়। সাচার রিপোর্টের পরামর্শ মেনে ২০০৮ সালে রাজ্যের তৎকালীন বাম সরকার সংবিধান প্রদত্ত ৩০ নং ধারায় শিক্ষার অধিকার বিষয়ে বিশেষ কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। সেদিন প্রবীণ আইনজীবী ও সমাজকর্মী মুন্সি আবুল কাশেম তাঁর লড়াইয়ে জয়ী হন।
আরও পড়ুন-লালনের শ্বশুরবাড়ি তদন্তে সিআইডি
সংখ্যালঘু মুসলিমদের শিক্ষার অধিকার প্রাপ্তি এ রাজ্যে একটা নজির। আগামী প্রজন্ম এই ইতিহাসকে স্মরণ করবে। স্মরণ করতে হবে তাঁর আরও কিছু কাজ। রাজ্যে পিছিয়ে পড়াদের শিক্ষার জন্য প্রথম আবাসিক কলেজ গড়ে উঠছে তাঁর হাত ধরেই। যে কলেজের শিলান্যাস করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ ও সংগীত জগতের দিকপাল ‘নাগরিক কবিয়াল’ কবীর সুমন। সাংসদ থাকাকালীন তাঁর আর্থিক অনুদানে গড়ে ওঠে পৃথক এক গার্লস হোস্টেল। কবীর সুমনের পর দাতা ব্যক্তি হলেন শিল্পপতি মোস্তাক হোসেন। তাঁর আর্থিক অনুদানে গড়ে উঠেছে আরও একটি পৃথক হোস্টেল।
নতুন একটি তথ্য দিয়ে জানান, শিশু বিকাশ একাডেমিতে পড়ানো হয় নার্সারি থেকে। তিনি মনে করেন একজন অভিভাবক তাঁর সন্তানকে আবাসিকে রেখে যাবেন নার্সারিতে। সেই বাচ্চা ধাপে ধাপে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ ডিগ্রি অর্জনের পর বিএড ও ডিএলএড শেষ করে বাড়ি ফিরবে। একই ক্যাম্পাসে এতগুলো শিক্ষার পরিবেশ। যা পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও নেই।
আরও পড়ুন-শুধু এমবাপে নয়, ফ্রান্স ভয়ঙ্কর: স্কালোনি
সমগ্র রাজ্যে ইতিহাস সৃষ্টিকারী মুন্সি আবুল কাশেম। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুর চাকবেড়িয়াতেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। পার্থিব জীবন শেষ করে মাটিতে আশ্রয় নেবেন চাকবেড়িয়াতেই। বয়সের আট দশক পেরিয়ে আজও তিনি ভুলে যাননি মানুষের দানের কথা। ভুলে যাননি বর্তমান সরকারের ভূমিকাও। সরকার কর্তৃক শিক্ষায় বৃত্তি, কন্যাশ্রী, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, বই-খাতা, ব্যাগ ও সাইকেল প্রদানের মতো সবরকম সরকারি সুবিধা পায় শিশুবিকাশ একাডেমি। এত সুবিধার পাশাপাশি তাঁর স্কুলও একদিন সংখ্যালঘু তকমা পেয়ে যাবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যালঘু শিক্ষার অগ্রগতিতে আগ্রহী। কাশেম সাহেবের কথায়, দীর্ঘমেয়াদি একটা পথ৷ সেই পথ ধরে গুটিগুটি পায়ে একদিন শিশুবিকাশ একাডেমি সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তকমা পেয়ে যাবে। আশা করছি, তা ২০২৬ সালের মধ্যে হয়ে যাবে৷ তিনি মনে করেন, ভালবাসার জামা খুলে ফেললে মানুষ স্বার্থপরতায় আচ্ছন্ন হয়। সেই স্বার্থত্যাগ করে আগামীতে শিশু বিকাশ একাডেমি তৃণমূল সরকারের থেকে সংখ্যালঘু তকমা অর্জন করে পিছিয়ে-পড়া সমাজের কাছে নজির হয়ে থাকুক।