বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি, শিক্ষাক্ষেত্রে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে ডবল পাল্টি খাওয়া আগমার্কা সিপিএমপন্থী (CPM) বুদ্ধিজীবীরা গলা ফাটাচ্ছেন। বলা হয়, বঙ্গজ বুদ্ধিজীবীরা বারবার পাল্টি খেতে এবং গিরগিটির তুলনায় দ্রুততর রং পাল্টাতে অভ্যস্ত। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একজনকে দেখলাম (একাধিকবার দেখেছি) যাকে পাল্টি খাওয়া বুদ্ধিজীবী বলা যায় না। তিনি বরাবরই বামপন্থী (সিপিএম) বুদ্ধিজীবী ছিলেন। এখনও রং পাল্টাননি। তাই তিনি প্রশংসার যোগ্য। টিভি চ্যানেলে বসে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় শিক্ষার দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। যেন তিনি মহা সাধু ব্যক্তি। বামফ্রন্টের শাসনকালে সিপিএমের বদান্যতায় এবং সিপিএমের (CPM) দলীয় স্বার্থরক্ষার জন্য এই বুদ্ধিজীবী অনেক বেআইনি কাজ করেছেন। এখন তৃণমূল কংগ্রেস দলের দুর্নীতি নিয়ে, যা এখনও প্রমাণিত হয়নি, বড় বড় কথা বলছেন। ভদ্রলোকের কীর্তি, কুকীর্তি নিয়ে কিছু তথ্য জানানো এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। অনিবার্য কারণে তাঁর নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কাল্পনিক নাম ব্যবহার করা যেতে পারে। ধরা যাক, তাঁর নাম বিশুদ্ধ (অবিশুদ্ধ) সরকার। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। বিশুদ্ধবাবুর কয়েকটি কীর্তিকলাপ সংক্ষেপে উল্লেখ করছি— (১) বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট এবং এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে উপাচার্য রাজ্য অ্যাকাডেমির পুরস্কার-প্রাপকদের নাম মনোনীত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, এই দুটি বিধিবদ্ধ সংস্থার অনুমোদন ছাড়া রাজ্য অ্যাকাডেমির পুরস্কার-প্রাপকদের নাম ঘোষণা করা যায় না। (২) উপাচার্য নিজের পদমর্যাদাকে ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে ব্যয়বহুল ভ্রমণের আয়োজন করেছিলেন। অধিকাংশ বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের কোনও সম্পর্ক ছিল না। অথচ যাবতীয় খরচ বিশ্ববিদ্যালয়কেই বহন করতে হয়েছে। (৩) বিদেশে গিয়ে উপাচার্য রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির ল্যামিনেটেড প্রিন্ট বিক্রি করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন, এই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। (৪) আরও অভিযোগ এসেছে, উপাচার্যের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র জন্মোৎসবের ছবি তোলার স্বত্ব একটি বিদেশি টিভি সংস্থাকে বিক্রি করা হয়েছিল এবং প্রচুর কাটমানির খেলা চলেছিল। (৫) বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একটি ঝিল সংস্কারের কাজে ১৭ লক্ষ টাকা এবং বয়স্ক শিক্ষাখাতে ৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছিল। সিএজি-র রিপোর্টে এই অভিযোগ করা হয়েছে। (৬) বিশুদ্ধবাবু অশিক্ষক পদে (দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) সিপিএমের (CPM) সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বা উক্ত দলের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কাউকেই নিয়োগ করা হয়নি। অবশ্য তখন সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য ছিল। (৭) উপাচার্যের ‘বিশেষ দাক্ষিণ্যে’ ক্লাস না করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস বিভাগের বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী (যাঁরা ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন) স্নাতক পরীক্ষায় বসার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফ্যাকাল্টি কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে উপাচার্য তাঁর বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-কমবয়সে যখন হৃদরোগ
১৯৯৪-এর প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তৎকালীন অতি-বিশিষ্ট বিরোধী নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় উল্লিখিত অভিযোগগুলি তুলেছিলেন এবং ভিজিল্যান্স কমিশনের তদন্ত দাবি করেছিলেন। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার সিপিএমের (CPM) এই বশংবদ ও তল্পিবাহক উপাচার্যের বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফেও কোনও তদন্ত হয়নি বা অভিযোগগুলি খণ্ডন করা হয়নি। সুব্রতদা মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে নিরপেক্ষ তদন্তের কথা বলেন। এই প্রবন্ধকারও সুব্রতদার সঙ্গে ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী উপাচার্য বিশুদ্ধবাবু সম্পর্কে তাঁর অসন্তোষের কথা জানান। একইসঙ্গে বলেন, তাঁর দল অত্যন্ত ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সুসংহত’। তাই তাঁর একার পক্ষে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তবে তিনি দেখবেন, যাতে ওই ভদ্রলোক দ্বিতীয়বারের জন্য নিযুক্ত না হন। আশ্চর্যের কথা হল, জ্যোতিবাবু বিদেশে থাকাকালীন আলিমুদ্দিনের নির্দেশে রাজ্য সরকার অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে বিশুদ্ধ সরকারকে দ্বিতীয়বারের জন্য উপাচার্য হিসাবে নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
বিশুদ্ধবাবু সম্পর্কে আরও গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। ডক্টরেট ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও নিজেকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্ত দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্র অতিরিক্ত সুবিধা পেয়েছন— যেমন লেকচারার থেকে রিডার এবং তারপর প্রফেসর পদে পদোন্নতি। ‘প্রফেসর’ হয়েছিলেন বলেই পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পেরেছিলেন, যদিও তাঁর নিয়োগ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শুনেছি, ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে বিতর্ক-কাণ্ডের পর চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশুদ্ধবাবু একটি সার্টিফিকেট এনেছিলেন। সে তো পরের ঘটনা। তার আগেই তিনি সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিয়েছেন। একে বলে সরকারি অর্থের নয়ছয় (defalcation of public money)। এছাড়া এই সার্টিফিকেটের বৈধতা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্ত করা প্রয়োজনে ছিল।
বিশুদ্ধবাবুর কীর্তিকলাপের শেষ নেই। কলকাতায় অবস্থিত ঐতিহ্যসম্পন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সংস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে একটি গবেষণা প্রকল্পের দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন। সেটা এই শতকের প্রথম দিকের কথা। অভিযোগ, এখনও পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। তাঁর জন্য একটা বড় ঘর বরাদ্দ হয়েছিল, অথচ কর্মচারীদের বসবার সমস্যা ছিল। ওই ঘরে ছাত্র ফেডারেশন এবং সিপিএম কর্মীদের রাজনৈতিক শলা-পরামর্শ হত। এই বিষয়ে কর্মচারী সমিতির সভাপতি হিসাবে আমি প্রতিবাদ করেছি। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে (বামফ্রন্ট) জানিয়েছি। ফল কিছুই হয়নি।
মাননীয় বিশুদ্ধ সরকারবাবু অন্যের নিন্দা করার আগে আয়নায় নিজের মুখটা দেখুন।