কমবয়সে যখন হৃদরোগ

বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলির অন্যতম হল হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক। শুধু বয়স্কদেরই নয়, আধুনিক লাইফস্টাইল ইদানীং বাড়িয়ে তুলছে কমবয়সেই হৃদরোগের সম্ভাবনা। এর কারণ কী? চিকিৎসাই বা কী? জানালেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ রবীন চক্রবর্তী। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

হৃদয় রোগ কখন
আমাদের হার্টে কিছু রক্তনালি রয়েছে, সেই সব করোনারি আর্টারি দিয়ে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত হার্টে পৌঁছয়। এই করোনারি আর্টারি হৃৎপিণ্ডকে সচল রাখে এবং পুষ্টির জোগান দেয়। সেই আর্টারি বা ধমনিতে যদি ময়লা জমে কোনও ব্লকেজ তৈরি হয় তখন সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে যায়, হার্টের মাংসপেশিতে রক্ত পৌঁছতে পারে না, সেই সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তখন হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক হয়। হৃদরোগ (Heart disease) হল হার্টের মাসল নষ্ট হয়ে যাওয়া। আগে পঞ্চাশের উপর যাঁদের বয়স, তাঁদের হৃদরোগ দেখা যেত এখন সেই সম্ভাবনা কমবয়সিদেরও খুব দেখা যাচ্ছে।

কখন রিস্ক
কতগুলো রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে যেটাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। ননমডিফায়েবল এবং মডিফায়েবল রিস্ক ফ্যাক্টর। যেগুলো ননমডিফায়েবল অর্থাৎ যাঁদের কোনওভাবে ঠিক করা যায় না তার মধ্যে পড়ে বংশগত বা জেনেটিক কারণ, পারিবারিক ইতিহাস, জেন্ডার, জাতিভেদ।
মডিফায়েবল রিস্ক ফ্যাক্টর হল উচ্চ রক্তচাপ এবং হাই ব্লাড সুগার, কোলেস্টেরল, ওবেসিটি। এছাড়া যাঁরা খুব তৈলাক্ত খাবার খান, পরিশ্রম বা হাঁটাচলা নেই, অ্যাংজাইটি, স্ট্রেস, ধূমপান, অ্যালকোহলে আসক্তি ইত্যাদি। অনেকেই হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ মানতে চান না বা বুঝতেই পারেন না বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগী এবং অতিরিক্ত ধূমপান করেন যাঁরা (তাঁদের নীরবেই মৃত্যু হতে পারে হার্ট অ্যাটাক জনিত কারণে)।

কমবয়সি পুরুষের বেশি
মহিলাদের তুলনায় পুরুষের হৃদরোগের (Heart disease) রিস্ক অনেক বেশি। কারণ আধুনিক জীবনযাত্রা, স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি, টেনশন। কোভিড-পরবর্তীতে হৃদরোগের প্রবণতা বেড়েছে কারণ আর্থিক অনিশ্চয়তাজনিত মানসিক চাপ, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ফলে সারাক্ষণ বসে কাজ, চোখের সামনে ল্যাপটপ অথবা কম্পিউটার মানুষকে অলস করে তুলেছে, শরীরের কোনও মুভমেন্ট আর নেই। সবাই ভীষণভাবে মোবাইলে আসক্ত। সেই সঙ্গে রয়েছে খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম, জাঙ্ক ফুড খাওয়া, অ্যালকোহলের অভ্যেস, রাত জাগার ফলে বাড়ছে হাইপারটেনশন, সুগার, ওবেসিটি যা হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে। এছাড়া করোনা ভাইরাস হার্টকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ভীষণভাবে।

কমবয়সি মহিলাদের কিছু কম
অল্প বয়সি মহিলাদের ইস্ট্রোজেন হরমোন থাকায় হৃদরোগ থেকে তাঁরা অনেক বেশি সুরক্ষিত। এই হরমোনটি আর্টারিতে ফ্যাট জমতে দেয় না। কিন্তু আধুনিককালে অল্পবয়সি মেয়েরা সেই সুরক্ষাকে উপেক্ষা করে নিয়মিত ধূমপান এবং অ্যালকোহলে অভ্যস্ত। এছাড়া বাদবাকি নানা চাপ তো আছেই, ফলে কমবয়সি মহিলাদেরও হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। তবে সাধারণত পঞ্চাশের পর মেনোপজ হলে মহিলাদের ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায় তখন সেই রিস্ক পুরুষের সমান হয়ে যায়।
যাঁদের পারিবারিক ইতিহাসে হার্ট অ্যাটাক রয়েছে, তাঁদের ডায়াবেটিস হলে অনেকটাই সতর্ক থাকতে হবে।

ধূমপান নয়
ধূমপানের ফলে করোনারি আর্টারিতে মাইক্রো ইনজুরি বা ক্ষত তৈরি হয়, যার ফলে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়া ধূমপানে রক্তে ভাল কোলেস্টেরল অর্থাৎ এইচডিএল কমিয়ে দেয়। এইচডিএল কমে গেলে খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল বেড়ে যায় যা ধীরে ধীরে হার্ট অ্যাটাককে ত্বরান্বিত করে।

আরও পড়ুন-ঋণে সমস্যা, অমিত মিত্র চিঠি দিলেন সীতারমনকে

কী করে বুঝবেন অ্যাটাক
বুকে খুব ব্যথা অনুভব করলে।
চলাফেরা করতে গেলে যদি সেই ব্যথা বাড়ে আবার থামলে দেখা গেল ব্যথা কমে গেছে।
বুকে হঠাৎ বেশ ধড়ফড়ানি
অল্প কাজ করলে হাঁপিয়ে ওঠা, খুব ক্লান্তি।
শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া একটা কমন লক্ষণ।
অনেক সময় বাম হাতে ব্যথাও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে।
হঠাৎ করে মাথা ঘুরতে পারে।
হঠাৎ করে খুব ঘাম হতে পারে।
ডায়াবেটিস মেলাইটিস থাকলে অনেক সময় এই সব কোনও উপসর্গই থাকে না। তাই সতর্ক থাকতে হবে।
সুগার বা প্রেসার রয়েছে কিন্তু ওষুধ খেলেও কমছে না, একইরকম থাকছে।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা
প্রথমে রোগী আসার পর ইসিজি করতে বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ইসিজিতে রোগ ধরে পড়ে না তখন সিরিয়াল ইসিজি করা হয়। এতেও ধরা না পড়লে ড্রপ আই এনজাইম টেস্ট করতে হয়। তাতে রোগটি (Heart disease) ধরা পড়ে।

চিকিৎসা
হার্ট অ্যাটাক হলে অ্যাঞ্জিগ্রামই মূল চিকিৎসা। প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টিতেই ৯০ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। যেসব জায়গায় বড় হাসপাতাল নেই বা অ্যাঞ্জিওগ্রাম করার ব্যবস্থা নেই সেখানে হৃদরোগ বুঝলে নিকটবর্তী হাসপাতালে গিয়ে ইন্ট্রাভেনাস স্ট্রেপটোকাইনেস অথবা এই জাতীয় রক্ত পাতলা করার ওষুধ বুকে ব্যথা ওঠার দু’ থেকে চারঘণ্টার মধ্যে নিতে পারে তাহলে ৭০ শতাংশ রোগী ভাল হয়ে যান। পরে বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অ্যাঞ্জিওগ্রাম করা প্রয়োজন। একে বলা হয় ফার্মাকোইনভেসিভ।
হৃদরোগের পর ওষুধ নিয়মিত খেতে হবে। হার্ট অ্যাটাক হবার পরেও একটা মানসিক দুশ্চিন্তা থাকে, সেটা ঠিক নয়। ভাল চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করলে রোগী স্বাভাবিক সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন।

পরামর্শ
ডায়েটেশিয়ান সোনালি ঘোষ

আধুনিক যুগে ৩০ থেকে ৫০ বছরের মানুষের মধ্যে হৃদরোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, সময় মেনে সুষম খাদ্যাভ্যাসের অভাব, ফাস্ট ফুডে আসক্তি, মেটাবলিক ডিজঅর্ডার। যা থেকে হয় হাইপারটেনশন ও ওবেসিটি, কোলেস্টেরল ইত্যাদি।
খাবারের বিপাকীয় ক্রিয়ার সময় খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস শরীরে বণ্টন হয়। এই ক্রিয়া যখন ঠিকমতো হয় না তখন ফ্যাট ডিপোজিশন হয় আর্টারিতে।
সারাদিনের মিলকে পাঁচভাগে ভাগ করতে হবে। দুটো ছোট, তিনটে বড়। কোনও মিল স্কিপ না করা যাবে না, বিশেষ করে ব্রেকফাস্ট। সঙ্গে যোগাসন বা এক্সারসাইজ, প্রাণায়াম জরুরি।
জলখাবারে দুধ বা হেলথ ড্রিঙ্ক, ডিম, দুধের পরিবর্তে ছানা, দই, ফল।
দুপুরে ভাত অল্প পরিমাণে, সঙ্গে সবুজ সবজি, ডাল বেশি করে খেতে হবে, চারা মাছ, চিকেন। এছাড়া ওটস, কর্নফেক্স, হুইটফ্লেক্স, সুজি, মুসলি, খই, চিঁড়ে খাওয়া যেতে পারে।
চিনি বা মিষ্টি বর্জন করতে হবে। মধু বা গুড় বাদ দিলেই ভাল। র-কার্বোহাইড্রেট যেমন ময়দা, বেকারির খাবার, ইনস্ট্যান্ট ফুড, ফ্যাটি ফুড, সি ফিশ সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে।
অবশ্যই স্ট্রেসমুক্ত জীবন যাপন করতে হবে। তাই মেডিটেশন করা জরুরি।

Latest article