রামেশ্বর দত্ত: আমার বরাবরের অভ্যেস প্রতিদিন সকালে বাজার করা। পাড়ার বাজারে গিয়ে টাটকা শাক-সবজি-সহ মাছ কিনে এনে সুচেতার হাতে দিই। সুচেতা তা গুছিয়েগাছিয়ে তরিতরকারি আর মাছের পদ রেঁধে দেয়। তাই খেয়ে আমি কোর্টে বেরিয়ে যাই। আলিপুর কোর্ট আমার কর্মস্থল। সেখানে ওকালতি করা আমার কাজ।
বাজারে সাধারণত জিয়ল মাছ কিনি। বড় মাছ, অর্থাৎ কাটা রুই-কাতলার দিকে বেশি ঝুঁকি না। তবে অতি সাধারণ মেছুরেদের কাছ থেকে জ্যান্ত মাছ কিনলেও আমাদের বেনেপুকুর বাজারে এক মহান হস্তি, মেছুরে আছে। তাকে রোজ দেখি। এত বছরে অনেকটা আলাপও জমে গেছে সেই মস্ত মেছুরের সঙ্গে যার নাম অধিরঞ্জন। পদবি দাস। কোনওদিন কাটাপোনা বা রুই-কাতলা নিতে হলে আমি অধিরঞ্জনের কাছ থেকেই কিনি, অন্য মেছুরেদের দিকে মন দিই না। অধিরঞ্জন বড় বিশ্বাসী। সকলেই তা বলে। আমিও ওর কাছ থেকে মাছ কিনে কোনওদিন ঠকিনি।
সেদিন হল কী, বাজারে গিয়েছি, অথচ অধিরঞ্জনকে দেখছি না। বেশ গুছিয়ে বসা অধিরঞ্জনের বড় আকারের দোকানটা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। ভাবলাম, হবে হয়তো, কোনও বিশেষ কাজে আজ আর দোকান লাগায়নি। যদিবা, আমার বারো বছরের বাজারের অভ্যাসে প্রত্যেকটা দিনই অধিরঞ্জনকে পেল্লায় পেল্লায় রুই-কাতলা সাজিয়ে, কেটে দোকান খুলে বসতে দেখায় আমার চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিশেষ করে, ওর কালো মুস্কো বিশাল চেহারায় বাঁজখাই গলার আওয়াজ আমারই মতো অনেকের খুব প্রিয়।
আরও পড়ুন-ছাঁটাইয়ের কোপে উইপ্রো কর্মীরাও
এখন তাকে একদিন না হয় বসতে দেখছি না, এমন হলে চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু পরপর পাঁচ দিন সে দোকান খুলল না। তার পরেও অবশ্য খোলেনি, তবে সে-কথায় পরে আসছি।
আমার কেমন যেন কৌতূহল হল, অধিরঞ্জনের বিষয়টা জানবার জন্যে। ওরই পাশের দোকানে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর এল, “আপনি শোনেননি কিছু?”
“না তো, ভাই। কেন, কী হয়েছে অধিরঞ্জনের?”
“অধিরঞ্জনদা এখন জেলে বসে আছে।”
“সেকি! একেবারে জেলে, কেন?”
“মানুষ খুন করেছে।”
আরও পড়ুন-নিউজিল্যান্ডের নয়া প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিন্স
আশ্চর্য হলাম! বারো বছর ধরে যে লোকটাকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে দেখে আসছি, সে কিনা, মানুষ খুন করে বসল! যাক আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। মনটা বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। বাড়ি এসে সুচেতাকে কথাটা জানালাম। অধিরঞ্জনের নামটা সুচেতারও জানা। আমার অবর্তমানে, মানে যেদিন আমি বাজার যেতে পারি না, সেদিন সুচেতাই বাজারে যায়। অতএব অধিরঞ্জনকে ওরও চোখে পড়ে। একদিন তো ও বাড়ি ফিরে আমাকে জানিয়েওছে, অধিরঞ্জন ওকে ‘বউদি’ করে ডেকে, বাজারে আমার অনুপস্থিতির খবর নিয়েছে। ভাল লোক তো একেই বলে!
এ হেন অধিরঞ্জন এখন জেলে। তার খবর এবং ব্যাপারটা বিশদে ওরই বাড়ির লোকের কাছ থেকে জানব বলে মনস্থির করে ফেললাম। জানি না, উকিল বলেই কিনা, চেনা মানুষকে জেলের গরাদের ওপারে থাকতে দেখেই পেশাগত না হলেও, মানবিকতার খাতিরে তার খোঁজ নেওয়াটা আমার কর্তব্য বলে মনে করলাম।
রবিবার সকাল সকাল চলে গেলাম। গোবরা। আমি জানি অধিরঞ্জনের বাস গোবরার রেললাইন পেরিয়ে কুষ্ঠ হাসপাতাল (পরে মানসিক রোগের হাসপাতাল এবং বর্তমানে তা-ও পরিবর্তন হয়ে অন্য হাসপাতাল হয়েছে) পেরিয়ে যেতে হয়। বেনেপুকুর থেকে গোবরা পায়ে হাঁটা পথ। রেললাইন পেরিয়ে ডানদিকে হাসপাতাল আর বাঁদিকে মুসলমানদের কবরখানাকে রেখে, সোজা পৌঁছে গেলাম বামুন পাড়ায়। ওখানে পৌঁছে নির্দিষ্ট বাসাটা খুঁজে নিতে খুব বেশি বেগ পেতে হল না। বুঝলাম, এখানেও অধিরঞ্জনের পরিচিতি ভালই রয়েছে।
আরও পড়ুন-নিউজিল্যান্ডের নয়া প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিন্স
কিন্তু একি! বাড়ির দরজায় তো তালা মারা। আবার বাড়ির রোয়াকে দু’জন পুলিশও বসা। ঘাবড়ে গেলাম। অধিরঞ্জন যদি খুন করে থাকে, তাহলে, তার বাড়ির সামনে পুলিশ থাকবে কেন? তা ছাড়াও বাড়ির মেন গেটে তালা মারা, মানে তো বাড়ির লোকজনও নেই! এখন? কী করব, কী করব, ভাবতে ভাবতে পুলিশের কাছেই আমার মনের প্রশ্নটা করে বসলাম। উত্তর পেলাম, “বাড়ির লোক অন্যত্র চলে গেছে কারণ, এখানে ওনাদের ওপরও হামলার আশঙ্কা রয়েছে।”
“ব্যাপারটা কী, তা কি আমাকে খুলে জানাতে পারবেন?”
“দুঃখিত, স্যার। আমরা হচ্ছি সিপাই। অত কিছুর খোঁজ আমাদের কাছে থাকে না। তবে, আপনি থানায় গেলে সব জানতে পারবেন। থানা, কাছেই। বেনেপুকুর থানা। চেনেন নিশ্চয়ই।”
“হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমার বাসই বেনেপুকুর লেনে। ছোটকাল থেকেই ওখানে থানা দেখে আসছি। এখন না, হয়, বিশাল বড় বাড়ি হয়ে গেছে…”
“ওখানে চলে যান। সেকেন্ড অফিসারের সঙ্গে দেখা করুন। সব জানতে পারবেন।”
রবিবারের দিন। ঘরে বাইরে সেরকম কোনও তাড়া নেই। ফিরতি পথে মিনিট কুড়ি হেঁটেই থানায় পৌঁছে গেলাম। ভিতরে প্রবেশ করে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। সেই কোন ছোটবেলা থেকে এই থানা দেখে আসছি। আর আজ কিনা…
আরও পড়ুন-মোদি জমানায় কলঙ্কিত ক্রীড়াক্ষেত্র
“স্যার, আমার নাম প্রদীপ বটব্যাল। আমি অধিরঞ্জন দাস সম্বন্ধে কিছু খোঁজ-খবর করতে এসেছি। দয়া করে যদি তা আমাকে জানান।” সেকন্ড অফিসারকে অনুরোধ করতে তিনি অনেক কিছু বলে গেলেন। শেষে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি ওনার সঙ্গে দেখা করবেন?”
“অবশ্যই, স্যার। অধিরঞ্জন দাস কি আপনাদের কাস্টডিতে রয়েছে?”
“আসুন” বলে উনি আমাকে থানার পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে একটা গরাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এ গরাদ তো আমি চিনি। ছোটবেলায় এখানে এসে গরাদের ওপারের মানুষটাকে দেখতাম। বড্ড কষ্ট লাগত। আহা রে!
আজ সেখানেই আমার চেনা লোক! ভিতরে অন্ধকারের মধ্যে বসে রয়েছে অধিরঞ্জন। বাইরের দিনের আলোয় সে আমাকে দেখেছে। চিনলও। কিন্তু মুখ নামিয়ে বসে রইল। ভীষণ কষ্ট পেলাম অধিরঞ্জনের জন্যে। গরাদের শিকে মুখ রেখে বললাম, “অধিরঞ্জন, আমি কি তোমার জন্যে কিছু করতে পারি?”
ও উঠে এল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, মানুষের যখন বিশ্বাস চলে যায়, সে মানুষের আর কী মূল্য রয়েছে?”
চোখ ছোট হয়ে এল আমার। ভ্রু কুঁচকে গেল। ‘বিশ্বাস!’
আরও পড়ুন-ইউপির কারাকর্তাকে আদালত অবমাননার নোটিশ সুপ্রিম কোর্টের
“তার মানে, কী বলতে চাইছ, অধিরঞ্জন? সব কথা কি আমাকে খুলে বলবে?”
আমি জানি, কোর্ট পারমিশন ব্যতীত কোনও আসামির সঙ্গে একজন উকিলের কথা বলার অধিকার নেই। তবু অফিসারের কাছে অনেক অনুরোধ করে পাঁচ মিনিট কথা বলবার অনুমতি পেয়েছিলাম। তবে, তা বাইরে থেকে দাঁড়িয়েই সারতে হবে। তাতেই রাজি হয়েছি আমি।
অধিরঞ্জনের কাছে ফিরে এসে তাকে বললাম, “খুব সংক্ষেপে জানাও তো তোমার কেসটা, অধিরঞ্জন।”
অধিরঞ্জন বলতে শুরু করল, “এত বছর মাছের ব্যবসা করছি, কোনওদিন কেউ এসে আমায় জানায়নি, আমি তাদের পচা মাছ দিয়েছি…”
মনে মনে বললাম, সে তো আমিও জানি।
“কিন্তু কী স্যার, গত দু’মাস যাবৎ আমার বাঁধা বহু খরিদ্দারের কাছ থেকে সেই অভিযোগ পেতে পেতে একদিন চলে গেলাম, আমার মহাজনের আড়তে। মহাজনকে গিয়ে অনুরোধ করলাম, ‘‘এভাবে আমার ব্যবসাটাকে শেষ করে দেবেন না, বাবু। আমি আপনার বাঁধা পাইকারি খরিদ্দার।”
“লোকটা করল কী জানেন, পয়সার গরম দেখিয়ে আমায় আড়ত থেকে বের করে দিল। আমার ভীষণ অপমান লাগল। মাথাটা গরম হয়ে গেল। হাতের সামনে দু’কেজি ওজনের বাটখারাটা পেয়ে গেলাম। সেটাই তুলে নিয়ে লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারলাম। কিন্তু আমি জানতাম না; আমার লক্ষ্য এত নিখুঁত। ভারী বাটখারাটা গিয়ে ওর মাথায় লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মানুষটা মাটিতে পড়ে গেল। আর উঠল না। আমি খুনি হয়ে গেলাম। আমার ওপর, আমার পুরো পরিবারের ওপর ওদের রাগ পড়ল…”
আরও পড়ুন-দূষণ : কেন্দ্রের উপর দায় কোর্টের
বলতে বলতে অধিরঞ্জন হাউ হাউ করে কাঁদছে আর অস্পষ্ট কথায় উচ্চারণ করছে, “স্যার, বিশ্বাস কি কিনতে পাওয়া যায়? আমি না হয় মুখ্যু। আপনি তো লেখাপড়া জানা মানুষ। আমাকে একঝুড়ি বিশ্বাস কিনে এনে দিতে পারেন?”
আমার বিবেক বলে উঠল, ‘সুপ্রীত সাহা, অধিরঞ্জনকে রেহা করানো তোমার কর্তব্য। তুমি না উকিল…’