বাঘ নয় জন্মের পর বাঘিনিই করে সন্তানের প্রতিপালন। খেতে শেখানো থেকে শিকার ধরা। সেই বাঘিনির সঙ্গে বাস্তবের বাঘিনিদের এক সুন্দর সহাবস্থান গড়ে উঠেছে সুন্দরবনে। যাঁরা অনায়াসে তাঁদের বাড়ির পুরুষদের দাঁড় করায় মৃত্যুমুখে। যাঁরা সব খুইয়েও ভেঙে পড়েন না। জীবনের মর্মান্তিক দিনলিপির ইতিহাস লেখেন নিজেরাই। লড়াই আর মর্মভেদী গল্পের নায়িকা তাঁরাই। যাঁদের আরও একটা দুঃখবিদারক পরিচিতি আছে। তাঁরা হলেন বাঘ-বিধবা। যেন কোনও আলাদা প্রজাতি। কেন এমন নাম। কেন ঈশ্বরের এমন নির্মম সিদ্ধান্ত। কে এই বাঘ-বিধবা?
সুন্দরবনের বাঘ-বিধবাদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে চলেছেন বাসন্তী ব্লকের শিবগঞ্জের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অমল নায়েক। শুধু বাঘ-বিধবাই নয় সুন্দরবন এলাকার আপামর শিশু, কিশোর ও মহিলাদের তিনি দেখিয়েছেন নতুন পথের দিশা। তার বৃহৎ এই কর্মকাণ্ডের সাক্ষী গোটা সুন্দরবন অঞ্চল।
আরও পড়ুন-চলো মন সোঁদরবন
অমল নায়েক জানালেন— সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে সুন্দরবনের মানুষজন যখন বন কেটে বসতি স্থাপন করল সেই সময় চাষবাস খুব একটা হত না। ফলে এখানকার মানুষের জীবন এবং জীবিকা ছিল জঙ্গল-নির্ভর। নদী থেকে মীন ধরা এবং জঙ্গলে মধু সংগ্রহ— এটাই ছিল পুরুষের প্রধান পেশা। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ এমনই সহাবস্থান তাঁদের। কিন্তু জীবননির্বাহ তো করতেই হবে। পেতে হবে জীবিকার রসদ, তাই সুন্দরবনের জঙ্গলের মধ্যে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা খাঁড়িতে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া এবং গভীর অরণ্যে মধু সংগ্রহ করতে যায় তারা। তাই এইসব এলাকায় হামেশাই শোনা যায় বাঘে টেনে নিয়ে গেছে অমুক মৎস্যজীবী বা তমুক মধু-সংগ্রহকারীকে। বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয় যে সব পুরুষের তাঁদের স্ত্রীরাই পরিচিত হন ব্যাঘ্র-বিধবা বা বাঘ-বিধবা নামে। সুন্দরবনের একটা বড় অংশ কিন্তু এঁরাই।
আরও পড়ুন-পার্কসার্কাস ময়দানে শুরু হল মহামিলনের উৎসব
যদিও অমলবাবুর কথা অনুযায়ী এরপর সুন্দরবন কিছুটা এগিয়েছে। চাষবাস শুরু হয়েছে। কিছুটা হলেও উন্নত হয়েছে জীবন। কিন্তু সবটা নয়। এখানে যে দ্বীপগুলো আছে সেগুলো সব নদী দিয়ে পরিবেষ্টিত। একদিকে লোকালয়, একদিকে নদী, একদিকে জঙ্গল। নদী-অধ্যুষিত এলাকা সংলগ্ন গ্রামের পুরুষ এমনকী কিছু দম্পতিও প্রবল অভাবের তাড়নায় যেতে বাধ্য হয় গভীর অরণ্যে। অল্প কিছু সংখ্যকই রয়েছে যারা বংশ পরম্পরায় মৎস্যজীবী। পরিবারের পুরুষটি মারা গেলে এঁদের পরিবার অথৈ জলে পড়ে যায়। তাঁদের পরিবারের শিশুরাই পরবর্তীকালে শিশুশ্রমিক হয়ে যায়। আর মহিলাটির গায়ে ওঠে বাঘ-বিধবার তকমা।
আরও পড়ুন-সুন্দরবনের দেব-দেবীর মিথ : সম্প্রীতির প্রতীক
কেন এমন বিপজ্জনক পেশার প্রতি আকর্ষণ? এই প্রশ্নের উত্তরে অমলবাবু বললেন— সুন্দরবনের বাসন্তী, ঝড়খালি, গোসাবার বালি, আমলামেথি, মথুরাখণ্ড, পাখিরালা, লাহিড়ীপুর, চরভেরি, কুমিরমারী— এইসব অঞ্চলগুলি ব্যাঘ্রপ্রবণ এলাকা যেখানে বাঘের আক্রমণ অনেক বেশি। অভাবই একমাত্র কারণ নয় আসলে সুন্দরবনের কাঁকড়া খুবই লোভনীয় এবং দামটাও বেশি। বিশ্বের বাজারে এই কাঁকড়া আর এখানকার মধু খুবই সমাদৃত। চাহিদা রয়েছে। কিন্তু অনেকেই অর্থের লোভে মধু সংগ্রহে কোর এরিয়াতে চলে যায় বেআইনিভাবে।
আর মৎস্যজীবীরা এখানে বিভিন্ন রকম মাছ ধরে— পারশে, ভোলা, গাঙভেটকি ও নদীর কিছু স্থানীয় মাছ। নদীতে যখন ভাটা পড়ে তখন ওই কাদাতে অনেক মাছ বা কাঁকড়া পাওয়া যায় যা ধরা সহজ এবং ঠিক ওই সময় ওঁৎ পেতে থাকে বাঘ। ধীরে ধীরে পিছন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় এবং ঘাড়টা মটকে গভীর জঙ্গলে টেনে নিয়ে যায়। বাঘের বৈশিষ্ট্য হল চোখে চোখ পড়লে আর আক্রমণ করতে পারে না কারণ সে যেমন সাহসী, হিংস্র তেমনই ভিতু। তাই ওরা চেষ্টা করে পিছন থেকে আক্রমণ করতে। তখন সঙ্গীরা বৈঠা, লাঠি দিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে বাঁচানোর। বাঘ ভয় পেয়ে শিকার ফেলে পালায় তখন তারা সেই দেহ উদ্ধার করে গ্রামমুখী হয়। যারা বেঁচে যায় তাদের আর এমন অবস্থা থাকে না যে পুনরায় জীবিকায় ফিরবে। আহত হবার পরিণতি ভয়ঙ্কর। কারও চোখ নেই, কারও পেটের অর্ধাংশ নেই— প্রায় অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে থাকে। বেঁচে গেলে আর বিপদ। নার্ভাস সিস্টেমটা অনেকটাই ফেল করে যায়। চিকিৎসা করাতে জমি-জায়গা ভিটে-মাটি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। তাই তারা মনে করে মারা গেলেই বুঝি ভাল হত! বিকল্প আর্থিক সংস্থান নেই তাই দিনে দিনে এরা আরও বিপন্ন হতে থাকে এইভাবে।
লকডাউনের সময় এতটাই অভাব বেড়েছিল ছিল যে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ তখন জঙ্গলে যেত এবং কয়েক মাসে প্রায় চল্লিশজন মারা গিয়েছিল শুধু বাঘের আক্রমণে।
আরও পড়ুন-ভারতে এবার মিলল লিথিয়াম খনির সন্ধান
মধু সংগ্রহ করত বালির শ্রীনাথ। প্রতিবেশীর কাছ থেকে চাল ধার করে বাড়িতে স্ত্রী ঋতার হাতে দিয়ে সে গিয়েছিল গভীর জঙ্গলে। নৌকো ভাড়া করে যেতে হয় জঙ্গলে। সেই ভাড়ার পরিমাণ অনেকটাই। সেই ভাড়া দিলে তবেই পাওয়া যায় নৌকো। সেই অর্থের জোগাড় করতেও ধার করাটাই সম্বল। পরিবারে এবং জঙ্গলে তিন-চারদিন থাকার মতো রসদও ধার করতে হয়। দেনায় ডুবে থাকা শ্রীনাথ তিন-চারদিন পর আর ফেরে না। স্বামীর বাঘের হাতে মৃত্যুর হয়। এরপর থেকেই সদ্য স্বামীহারা ঋতার শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারের সীমা থাকে না। তাকে স্বামীর মৃত্যুর জন্যও দায়ী করা হয়। গ্রামবাসীদের ব্যঙ্গ, কটূক্তির শিকার হয় সে। বন্ধ হয়ে যায় তার সন্তানদের পড়াশুনো।
গীতা সর্দারের জীবনকাহিনিও অনেকটা এরকমই। গীতা এবং তার স্বামী দুজনেই জঙ্গলে যায় জীবিকা নির্বাহে মীন আর মধু সংগ্রহে। দুজন ছিল দুটো নৌকায়। আধ কিলোমিটারের দূরত্বে দুটো নৌকা। স্বামীকে বাঘে টেনে নিয়ে গেলেও সে টের পায় না। কিছুটা সময় পরে যখন জানতে পারে গীতা সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা যায়। গীতা কারও পরোয়া না করেই স্বামীকে খুঁজতে এগোয়। কিন্তু ততক্ষণে বাঘ সেই দেহ নিয়ে ঢুকে পড়েছে গভীর জঙ্গলে। গীতা চিৎকারও করতে পারে না। পুলিশে হাতে ধরা পড়লে বাকি জীবনটাও তো শেষ। তাই ফিরে আসে নিশ্চুপে। সে-ও পড়ে অথৈ জলে। গীতার ছেলের পড়শুনোও বন্ধ হয়ে যায়। ঋতা এবং গীতার মতো সুন্দরবনে এমন বহু বহু পরিবারের ট্র্যাজিক ঘটনা এটাই। এখানকার বাঘ-বিধবা মায়ের জীবনচিত্র একই।
আরও পড়ুন-বিজেপি হারলেই মূল্যবৃদ্ধি কমবে, ত্রিপুরায় নির্বাচনী প্রচারে বললেন অভিষেক
এমন ঘটনা চাক্ষুষ করা এবং শোনার পর ২০১০ সাল থেকে বাঘ-বিধবাদের নিয়ে কাজ শুরু করেন অমলবাবু। একটা সার্ভে করেন তিনি এবং তখন দেখেন এইসব গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ৬০০-র উপর বাঘ-বিধবা মা রয়েছেন। এই সার্ভে করতে তাঁর সময় লেগেছিল প্রায় দুবছর। প্রতিটা ঘরের দরজায় দরজায় যান এবং শুরু করেন কাজ। সংগঠিত করতে শুরু করেন বাঘ-বিধবাদের। অমল নায়েক এবং তাঁর স্ত্রী দুজনই ছিলেন সরকারি চাকুরে। প্রথম দিকে স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে নিজের বেতনের টাকা দিয়ে ওদের কাপড়, মশারি আরও প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া শুরু করেন। কারণ সামান্য মশারি কেনাও ওদের সামর্থ্যের বাইরে ছিল। ওইসব এলাকায় ভীষণ মশার উপদ্রব এবং কালাচ সাপের আধিক্য রয়েছে। ঘরে থেকেও রয়েছে জীবনহানির আশঙ্কা। তাঁদের নেই শীতবস্ত্রও। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় হল লাইসেন্স ছাড়া বেআইনিভাবে মধু সংগ্রহে গিয়ে যখন শ্রীনাথ এবং তার মতো আরও মৎস্য এবং মধু-জীবীরা মারা যান তখন তাঁদের দেহ বাড়িতে আনলে সদ্যবিধবারা কাঁদতেও পারেন না কারণ আইন রক্ষকের কানে গেলে আইনের প্যাঁচে একবার পড়লে হয়তো স্বামীর দেহটাও আর হাতে পাবেন না। তাই গোপনেই সৎকার করে দিতে হয়।
আরও পড়ুন-প্রবল কটাক্ষ সমালোচনায় প্রত্যাহার গরু আলিঙ্গন দিবস
এরপর তিনি ঋতা এবং গীতার ছেলেমেয়ের পড়াশুনো, স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। ধীরে ধীরে প্রতিটা বাঘ-বিধবা মায়ের মাসিক রেশন, শাড়ি, মশারি, কম্বল আরও অনেককিছুর বন্দোবস্ত করেন। প্রতিবছর পুজোর আগে একটি মিলনোৎসবের আয়োজন করেন তিনি ব্যাঘ্র-বিধবাদের জন্য, যেখানে তাঁদের হাতে খাদ্যসামগ্রী বস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। যাঁরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরাও আসেন এবং বাঘ-বিধবারাও আসেন। কিন্তু শুধু তো দান করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। চাই রোজগার। নিজের মায়ের নামে গড়েছিলেন চম্পা মহিলা সমিতি যার অন্তর্গত এই সব বাঘ-বিধবা মায়েদের নিয়ে গড়ে তোলেন বিভিন্ন স্বনির্ভরগোষ্ঠী। আজ সুন্দরবনে এমন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৮০০। বাঘ-বিধবাদের নিয়ে তৈরি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নামগুলো জঙ্গলের নামেই, যেমন— পিরখালি স্বনির্ভর দল, নেতিধোপানি স্বনির্ভর দল, বিদ্যাধরী নদীর নামে বিদ্যাধরী স্বনির্ভর দল ইত্যাদি। প্রায় ১০ হাজার মহিলা এখন নিযুক্ত। প্রাণিসম্পদ পালন থেকে বাড়ির সামনে বাগান করে ঋতুভিত্তিক চাষবাস— পুকুরে ছোট ছোট মাছচাষ সবটাই করছে এই সব বাঘ-বিধবারা। এই বিষয়ে রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তাঁরা। মহিলা সমবায়ের মাধ্যমে তাঁরা ব্যবসার জন্য টাকা ঋণ নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করে পরিবারের দুর্দশাকে দূর করার নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন। বাঘ-বিধবাদের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা স্কুলও গড়েছেন অমল নায়েক। সেই শিশুরা-কিশোরেরা তো আসছেই সেই সঙ্গে ড্রপ-আউট ছেলেমেয়েরাও আসছে।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় বিজেপির সংকল্পপত্র-এ ‘বাংলা-মডেল’, গেরুয়া শিবিরকে ধুয়ে দিলেন অভিষেক
সম্প্রতি সুন্দরবনে শুরু হয়েছে সেফ টাইগার অ্যাফেক্টেড ফ্যামিলি বা (স্টাফ) নামক একটি টাইগার অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম। অমল নায়েকের তৈরি এই প্রোগ্রামের আসল উদ্দেশ্য হল যাঁরা এখানে বেড়াতে আসছেন, তাঁদের শুধু এসে বাইরে থেকে ঘুরে-ফিরে দেখে চলে গেলে চলবে না, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এমন একটা বিষয়ে সব মানুষকে সংগঠিত করে তোলা খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টায় অনেকটাই সাড়া মিলেছে। কারণ সুন্দরবনের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে যথেষ্টই জনপ্রিয়। হাজার হাজার মানুষ এখানে আসেন প্রতিবছর। সরকার থেকেও শুরু হয়েছে অনেক কর্মসূচি। বাঘের আক্রমণ কমিয়ে আনার জন্য রয়েছে পরিকল্পনা। খোঁজা হচ্ছে বিকল্প আয়ের পথও। সেই সঙ্গে যাঁরা অর্ধমৃত অবস্থায় ফিরে ধনেপ্রাণে মারা যাচ্ছেন তাঁদেরও বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন অমল নায়েক।