হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী বা চতুর্দশীর রাতই হল বাঙালি-অবাঙালি সবার মহাশিবরাত্রি। কথিত আছে এই দিন নাকি শিব আর পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল। শিব নিজে উমাকে বলেছিলেন এই তিথি পালন করলে সমস্ত পাপের ফল থেকে নিষ্কৃতি মেলে এবং মোক্ষলাভ হয়। প্রতি বছর এই দিনে দেশ, বিদেশ, রাজ্য— সর্বত্র মহাসমারোহে শিবরাত্রি পালিত হয়। এই বাংলার পবিত্র, জাগ্রত শিবমন্দির এবং শিবের থানগুলি তার ব্যতিক্রম নয়। যেখানে শিবরাত্রি উপলক্ষে উৎসব তো হয়ই, বসে মেলাও। স্থানীয় মানুষ ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত-সমাগম হয়। সাড়ম্বরে বা ঐতিহ্যের অনাড়ম্বরে পালিত হয় মহাশিবরাত্রি।
আরও পড়ুন-রানি রাসমণি ও নবালোক
নকুলেশ্বর শিব, কালীঘাট
কালীঘাট মন্দিরের নিকটেই পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর শিবের মন্দির। কালীঘাট শক্তিপীঠের পীঠ অধিষ্ঠাতা, পীঠরক্ষক ভৈরব হলেন নকুলেশ্বর। জনশ্রুতি রয়েছে শ্রীব্রহ্মানন্দ গিরি যিনি পঞ্চদশ শতাব্দীতে কালীঘাটের কালীক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই নকুলেশ্বর ভৈরবের প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীতে ১৮৫৪ সালে তারা সিং নামে জনৈক পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী বর্তমান নকুলেশ্বর মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। আগে মন্দিরটির চারধার খোলা ছিল। মন্দিরের ঠিক মাঝ-বরাবর রয়েছে ভৈরব নকুলেশ্বরের স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ। খুব জাগ্রত এই শিব। নিত্যপুজো তো হয়ই তা ছাড়া প্রতি সোমবার, প্রত্যেক অমাবস্যা, পূর্ণিমা, একাদশী তিথিতে সন্ধ্যা ছ’টায় বাবার বিশেষ পুজো, আরতি হয় এবং অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। শিবরাত্রি এবং নীলষষ্ঠী উপলক্ষে এই মন্দিরে প্রচুর ভক্ত-সমাগম হয়। মহাসমারোহে দেবাদিদেবের অর্চনা করা হয়।
আরও পড়ুন-মহাশিবরাত্রি
বাবা তারকনাথ, তারকেশ্বর
বঙ্গদেশের অন্যতম বিখ্যাত তীর্থস্থান তারকেশ্বর। বছর বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত তারকনাথ দর্শনে খালি পায়ে বাঁক নিয়ে যাত্রা করেন, ডন্ডি কাটেন, হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন শুধু পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে। এই জাগ্রত শিবস্থানের মাহাত্ম্য অপরিসীম। তারকেশ্বরে বাবা তারকনাথের মন্দিরের বয়স প্রায় তিনশো বছর। ১৮৮৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়েজ শেওড়াফুলি-তারকেশ্বর লাইনের সূচনা করে তার আগেও অগণিত যাত্রী এই শিবতীর্থে আসতেন। কথিত আছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা শিবভক্ত বিষ্ণুদাস স্বপ্নাদেশ পেয়ে এখানে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হুগলিতেই থাকতেন। মতান্তরে ১৭২৯ সালে স্বপ্নাদেশ পেয়ে জঙ্গল কেটে মন্দির তৈরি করেন রাজা ভারামল্ল। মন্দিরের সামনে নাটমন্দির এবং উত্তরে দুধপুকুর। কথিত আছে এই পুকুরে স্নান করলে ভক্তদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। দূর-দূরান্ত থেকে পদব্রজে আসেন ভক্তরা। এখানে স্নান করেন। পুজো দেন। মহাশিবরাত্রি ও চৈত্রসংক্রান্তির দিন এখানে বিশেষ উৎসব হয়।
আরও পড়ুন-৫ বছরে মেঘালয়ে দুর্নীতির তদন্তের কথা বলেননি কেন শাহ-নাড্ডা? প্রশ্ন অভিষেকের
কলেশ্বর-কলেশনাথ, বীরভূম
বীরভূমের নানা প্রান্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বহু ঐতিহাসিক শিবমন্দির। তার মধ্যে অন্যতম হল কলেশ্বর-কলেশনাথ মন্দির। এই মন্দিরের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী। এই মন্দিরের উচ্চতা একশো ফুটের বেশি। দেওয়ালে রয়েছে নানাধরনের নকশা—দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। বহু মুনি ও ঋষিদের সাধনার ক্ষেত্র ছিল কলেশ্বর ধাম। শোনা যায়, পর্বত নামের এক ঋষি এখানে দেবী পার্বতীর তপস্যায় রত ছিলেন। অনেকে মনে করেন তাঁরই নাম অনুসারে এই গ্রামের নাম ছিল পার্বতীপুর। ফাল্গুন মাসের শিবচতুর্দশী তিথিতে শৈবতীর্থ কলেশ্বরধামে শিবরাত্রি উৎসব পালন করা হয়। একই সঙ্গে ৭ দিন ব্যাপী এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এই ব্রত-উৎসব চলাকালীন হাজার হাজার দর্শনার্থীর জন্য ভোগ-প্রসাদের আয়োজন করা হয়।
আরও পড়ুন-৫ বছরে মেঘালয়ে দুর্নীতির তদন্তের কথা বলেননি কেন শাহ-নাড্ডা? প্রশ্ন অভিষেকের
এক্তেশ্বরের মন্দির, বাঁকুড়া
শিবরাত্রি ব্রত রাঢ়বঙ্গের এক বিশেষ ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় লৌকিক উৎসব। বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর শিব স্বয়ম্ভূ। মন্দিরের কুণ্ডের মধ্যে যে শিবলিঙ্গটি রয়েছে, সেটি নাকি দেখতে অনেকটা মানুষের পায়ের মতো। এই জেলায় প্রায় শতাধিক শিবমন্দির রয়েছে। মল্লেশ্বর, বহুলাড়াতে সিদ্ধেশ্বর, জয়পুরে গন্ধেশ্বর, ভুবনেশ্বর, পাত্রসায়রে কালঞ্জয়-শিব বিখ্যাত। শৈবতীর্থ এক্তেশ্বরে প্রতিদিনই পুজো হয়। ফাল্গুন মাসে, শিবচতুর্দশী তিথিতে এক্তেশ্বর মন্দিরে শিবরাত্রি উৎসব উপলক্ষে কয়েক হাজার নর-নারীর সমাগম হয়। এখানে ব্রতীরা আগের দিন নখ কেটে নিরামিষ আহার করেন। শিবরাত্রির দিন উপবাস করেন। এক্তেশ্বর নাগমণি মহাদেবের জয়ধ্বনি করেন। শিবরাত্রি উপলক্ষে মেলা হয়, বাউল গান ও রামায়ণ গানের আসর বসে। এক্তেশ্বরে পাথরের শিবমন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে তৈরি এই মন্দির বেশ সুন্দর।
আরও পড়ুন-বিজেপিকে বসন্তের কোকিল বলে কটাক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর
১০৮ শিবমন্দির, বর্ধমান
বর্ধমানের ১০৮ মন্দিরের খ্যাতি এখন ভারতজোড়া। সারা বছর দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ভক্তরা এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। বর্ধমানের নবাবহাটে প্রায় ২৩০ বছর আগে বহু অর্থ ব্যয় করে এই মন্দির গড়েছিলেন মহারানি বিষণকুমারী। সারা ভারতে ১০৮ শিবমন্দির মাত্র দু’টি জায়গায় আছে। এই দু’টিই রয়েছে পূর্ব বর্ধমানে। প্রথমটি বর্ধমানের নবাবহাটে এবং দ্বিতীয়টি কালনাতে। মূল মন্দিরের ভিতরে ১০৮টি শিবমন্দির। কিছুটা দূরে রয়েছে আরও একটি শিবমন্দির মোট ১০৯টি শিবমন্দির রয়েছে। প্রতিটি মন্দির নির্মিত হয়েছে ওড়িশার বালেশ্বরের শিবমন্দিরের আটচালা নকশার আদলে। মহাশিবরাত্রির দিন এখানে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাগম হয়। সবাই প্রতিটি শিবলিঙ্গের মাথায় দুধ ও গঙ্গাজল ঢেলে বেলপাতা দিয়ে পুজো করেন। এই সময় এখানে সাতদিন ধরে মেলা চলে। বসে গানের আসর। হয় নানাধরনের অনুষ্ঠান।
আরও পড়ুন-দেউচার কাজ হচ্ছে পুরোদমে : প্রশাসন
জপেশ্বর মন্দির, বীরভূম
বীরভূম জেলার কীর্ণাহারে জুবুটিয়া গ্রামে অবস্থিত জপেশ্বর মন্দির। রোজ মন্দিরে নিত্যপুজো হয়। পাশাপাশি শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে অসংখ্য ভক্তদের সমাগম হয়। বিরাট করে শিবের অর্চনা করা হয়। মন্দিরের চারপাশে পরিবেশ খুব সুন্দর— যেন গাছ দিয়ে সাজানো বাগান। প্রায় ১৫০০ বছর ধরে এখানে পুজো হচ্ছে মহাদেবের। বাইরে রয়েছে রক্ষাকালীর থান। অনেকেই বিশ্বাস করেন, মহাজাগ্রত শিবের কাছে পুণ্যার্থীদের করা মনস্কামনা পূর্ণ হয়ে যায় অলৌকিকভাবে।
লোকেশ্বর শিব, ময়নাগড়
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় যেসব প্রাচীন রাজবংশ এক সময় রাজত্ব করে গেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হল ময়নার রাজপরিবার। ময়নাগড় বর্তমানে হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। এই স্থানটি ধর্মমঙ্গলের লাউসেন বা লবসেনের জন্য বিখ্যাত। এই ময়নাগড়ের ভেতরে রয়েছে বর্তমান বাহুবলীন্দ্র রাজপরিবারের কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জিউর মন্দির আর ময়নাগড়ের উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে লোকেশ্বর শিবমন্দির। এই মন্দিরের বর্তমান বয়স অনেক যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। ১৯০৯ সালে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়। পুনর্নির্মাণ করেন বর্তমান রাজবংশের পূর্বপুরুষ। এটাই এখন রয়েছে। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ রয়েছে। আটচালা রীতির মন্দির। চারপাশে ঘিরে রয়েছে দালান। টেরাকোটার কাজগুলি পুরনো মন্দির থেকে এনে এখানে বসানো হয়েছে। লোকেশ্বর শিবের অদ্ভুত মহিমা। জোয়ারের সময় শিবলিঙ্গটি উপরে উঠে আসে। ভাটার সময় মাটির তলায় প্রবেশ করে। কথিত আছে এই মন্দিরের সঙ্গে কাঁসাই নদীর যোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন-মহিলাদের ক্ষমতায়নে বাংলা বিশ্বে ১ নম্বর: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
বড়কাছারি মন্দির
দক্ষিণ ২৪ পরগনার দ্বিতীয় বৃহত্তম তীর্থ বাবা বড়কাছারি শিবের মন্দির। জায়গাটা বাখরাহাট থেকে অটোয় দশমিনিট। বহু দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ আসেন বাবা বড়কাছারির কাছে পুজো দিতে। এর আরেক নাম হল ভূতের কাছারি। এখানে শিব হলেন ভূতনাথ। মন্দিরটি অবস্থিত একটি বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে, আর গাছটির গায়েই রয়েছে একটি শিবলিঙ্গ। সব ধর্মের মানুষ এখানে পুজো দিতে পারেন। ভক্তরা এক ছোট কাগজের দরখাস্তে নিজেদের মনস্কামনা লিখে বেঁধে দেন মন্দিরের গায়ে। কথিত আছে বাবা নাকি কাউকে ফেরান না। খুব জাগ্রত এই শিবের থানে শনিবার-মঙ্গলবার বহু ভক্ত সমাগম হয়। সঙ্গে চৈত্রমাস, ফাল্গুন মাসে, শ্রাবণ মাসের শিবপুজোর দিনগুলোতে চলে উৎসব।