মহাশিবরাত্রি

জ্ঞান যখন আধার গ্রহণ করে, সত্তা যখন শক্তিকে আশ্রয় করে, পুরুষ যখন প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হয়, সেই পরম ক্ষণকে বলে মহাশিবরাত্রি। এই রাত আসলে শিব-পার্বতীর বিয়ের রাত। লিখলেন চৈতালী সিনহা

Must read

সারা ভারতে দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল শিব। বিশেষত মহিলামহলে। হবে না-ই বা কেন? শিবের ম্যানুয়াল-এ ‘মন্দিরের ভেতরে ঢুকতে নেই’, ‘বামুন ছাড়া পুজো হবে না’ এসব নেই। তা ছাড়া তিনি আপন ভোলা, বউকেয়ারিং, নারীশক্তির পৃষ্ঠপোষক, অল্পে তুষ্ট। কখনও বউকে মাথায় রাখেন, কখনও এক শরীর হয়ে মিশে থাকেন, কখনও পায়ের তলায় গড়াগড়ি খান ইমেজের তোয়াক্কা না করেই। সাধ করে কখনও ভিখারি হন কখনও বা নৃত্যবিশারদ নটরাজ আবার কখনও বহ্নিমান চিতার সামনে চণ্ডাল। এমন ভার্সেটাইল দেবতার সবচেয়ে পছন্দের ব্রত শিবরাত্রিকে ঘিরে তাই সারা ভারত জুড়ে চলে এক মহা- উন্মাদনা। আর যেহেতু শিবের কাছে মেয়েরা ব্রাত্য নয়, প্রতিমা ছুঁয়ে নিজে নিজে আনন্দে পুজো করা যায়, মনের সব কামনা তাঁর কাছে নির্ভয়ে নিবেদন করা যায়, সামান্য উপকরণেই সাজানো যায় শিবের পুজোর ডালি তাই শিবরাত্রিকে ঘিরে মেয়েদের উৎসাহ-উদ্দীপনা এক চরম মাত্রা ছুঁয়ে যায়। সেই মহাশিবরাত্রি ব্রত এবং ভগবান শিবের খোঁজে সিন্ধুসভ্যতা হয়ে বেদ উপনিষদ পুরাণ পথে এই ভ্রমণ।

আরও পড়ুন-ক্ষুদ্রশিল্প-রাস্তা-জলপ্রকল্প-চাষে নজর, বাঁকুড়ায় তোপ মুখ্যমন্ত্রীর

মঙ্গলাচরণ
‘ওরে তোরা উলু দে, রাঙা বর এলো যে
টোপর মাথায় দিয়ে ছাদনা তলাতে…।’
হিমালয় পুরীতে আজ বড় উৎসব। গিরিরাজের মেয়ে পার্বতীর বিয়ে। যদিও মেয়ে নিজে ছেলে পছন্দ করেছে, বাবা-মা মত দিয়েছেন সানন্দে। আগের পক্ষের বউটা মরে যেতে কেমন যেন উদাসীন হয়ে ছিল। পার্বতী অনেক সাধ্যসাধনা করে তাকে বিয়েতে রাজি করিয়েছে। নারদ নিজে মা মেনকাকে বলে গেছেন বর শিব নাকি সব দেবতার সেরা। সন্ধে হতে সব দেবতা বরযাত্রী আসছে : আহা কী সব অপরূপ দেখতে তাদের, মেনকা যাকেই দেখছেন তাকেই ভাবছেন এই বোধহয় পাত্র। নারদ হাসছে, আহা এরা কেন শিব হবে, সে যে সবার চেয়ে সুন্দর গো। সবার শেষে এক বয়স্ক দেবতা, ছাই মাখা, হাড়মালা গলায়, বাঘছাল পরা আবার ষাঁড়ের পিঠে চেপে এসেছে। এটাই শিব শুনে পার্বতীকে গাল পাড়তে-পাড়তে মা মেনকা অজ্ঞান। বর বেচারি জল ঢেলে শাশুড়ির জ্ঞান ফেরাল। এবার মেনকার শুদ্ধ দৃষ্টিতে সত্যসুন্দর রূপ ধরে শিব ধরা দিলেন। দেবতার সসীম সত্তা তো ভক্তের অন্তরের ভক্তিতে সৃষ্টি হয়। অনন্ত হলেন শান্ত, অরূপ এলেন রূপের মধ্যে। শিব-পার্বতীর বিয়ের রাতটা শিবরাত্রি নামে বিখ্যাত হয়ে রইল। জ্ঞান যখন আধার গ্রহণ করে, সত্তা যখন শক্তিকে আশ্রয় করে, পুরুষ যখন প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হয় সেই পরম ক্ষণকে বলে মহাশিবরাত্রি।

আরও পড়ুন-সমবায় ভোটে জিতল তৃণমূল

সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
তিনি এক এবং অনন্ত একমেবাদ্বিতীয়ম। তিনি অবাঙমানসগোচর বাক্য ও মনের অতীত। তিনি অণুর থেকেও ক্ষুদ্র। তিনি সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ভাবলেন বহু হবেন মূর্ত হবেন ব্যক্ত হবেন। এল সৃষ্টি কল্প জন্ম হল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের জীবকুলের মানবের আর মানুষের জন্য সৃষ্টি হল দেবতার। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালন কর্তা বিষ্ণু আর সংহার কর্তা রুদ্র। ঋকবেদের সেই বিখ্যাত রুদ্র মন্ত্র ‘উর্বারুক্রমিব বন্ধনাৎ মৃত্যোরমক্ষীয় মাম্মৃতাৎ’ পরবর্তীতে শিবের নামে। শিব এই বৈদিক চিত্রনাট্যে অনুপস্থিত অর্থাৎ আর্য সভ্যতা শিম্নপূজক নয়। কিন্তু তার আগে হরপ্পা সভ্যতায় তিনি আছেন সোচ্চারেই। সৃষ্টি ও কৃষ্টির ধারক হয়ে লিঙ্গ প্রতীক হয়ে আছেন, পশুপতি রূপে আছেন আর আছে বলীর্বদ শিবের অনন্ত বাহক। কালক্রমে শিব মিশে যাবেন রুদ্রের সঙ্গে, ভারতের ইতিহাসচক্রে জড়িয়ে যাবেন দেবাদিদেব মহাদেব হয়ে। তার পর যথারীতি শুরু হবে দেবতার মানবায়ন।

আরও পড়ুন-৫ বছরে মেঘালয়ে দুর্নীতির তদন্তের কথা বলেননি কেন শাহ-নাড্ডা? প্রশ্ন অভিষেকের

জটাধারী গলজ্জলপ্রবাহ
শিব সংহার করেন সৃষ্টির পথ সহজ করতে। শিব প্রজ্ঞার তৃতীয় নয়ন খুলে ভস্ম করেন কামকে। শিব তাণ্ডব নৃত্য করেন সংহারের পথে আবার শক্তি রূপে লাস্য করেন সৃষ্টির পথে। তাই শিবের আরেক নাম নিত্যনর্ত। শিব নৃত্যকলার দেবতা। শিবের পরম ভক্ত রাবণের লেখা বিখ্যাত শিব তাণ্ডব স্তোত্র জটাধারী গলজ্জলপ্রবাহ সর্বসেরা শিববন্দনা। শিবের ধনুকের নাম পিনাক, আর ধ্বংসের অস্ত্র পাশুপাত। শিবের হাতে ত্রিশূল সত্ত্ব রজ ও তম গুণকে অতিক্রম করে গুণাতীত হবার কথা বলে। আর ডমোরু যা কিনা ইনফাইনাইট বা অসীমের প্রতীক। গলায় সাপ জাগরণের প্রতীক। অঙ্গের ভস্ম মোহমুক্তির ইঙ্গিত দেয়। শিবের বহুল প্রচলিত যে প্রতীক পূজিত হয় সেই শিবলিঙ্গ ও তাকে ঘিরে বেড়টি যা গৌরীপট্ট ভাবা হয় তা সৃষ্টির প্রতীক, কৃষ্টির বাহক। আসলে শিব শব্দের অর্থ মঙ্গলময় আর লিঙ্গ শব্দের অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। তাই শিবলিঙ্গকে মঙ্গলময় বিশ্বদেবতার প্রতীক হিসেবেও ভাবা যেতেই পারে। তাঁর তাণ্ডবনৃত্যের প্রথম প্রদর্শনের দিনকে শিবরাত্রি রূপে পালন করা হয়। সারা রাত্রি ব্যাপী দেবতার উদ্দেশ্যে নৃত্যপ্রদর্শন করা হয়। শিব তখন পুজো পান নটরাজ মূর্তিতে।

আরও পড়ুন-শাহর চাপেই কি নির্বাচক প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা চেতন শর্মার?

আমরা চাষ করি আনন্দে
সভ্যতার শুরুতে কিছু সময় পেরিয়ে এসে মানুষ শিখেছিল চাষ করতে। ঠিক সেই সময় থেকেই মানুষের যাবতীয় আনন্দ, উৎসবের সাথে চাষ আর ফসল মিশে গেছে। ভারতের মতো কৃষিপ্রধান দেশে সব অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল চাষের সাথে সময় মিলিয়ে। বর্ষায় মাটি ভিজে চাষের উপযোগী হওয়ার সময় অম্বুবাচী, সোনালি ফসল পাকলে নবান্ন, বাড়তি শস্যে মকর সংক্রান্তিতে পৌষ পার্বণ, জমির আগাছা দমনে নেড়াপোড়া সবই আমাদের ফসল-কেন্দ্রিক। জমির ফসল শেষ, নতুন করে চাষ করতে লাগবে বীজ। সংহার শেষে যেন নতুন সৃষ্টির দিকে নজর ফেরাতে হবে, তাই বীজপ্রদ পুং দণ্ডের সেবা। সৃষ্টির সকল প্রাণীকুলের আগমনের যোনিপথ যদি পরব্রহ্ম মহাশক্তি হন তাহলে পরমেশ্বরেরকে তো বীজপ্রদ পিতা হতেই হয়। হে লিঙ্গ, ওঠো, জাগো সৃষ্টির বীজ দিয়ে পুনরায় করো ধরিত্রীকে শস্যগর্ভবতী। এই ভাবে আসে শিবরাত্রির এক ভাবনা।
নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতিং পরমেশ্বরম্
সাধকের প্রথম পরীক্ষা সাধন মার্গ নির্বাচন। ভক্তিমার্গের পথ সরল, শরণাগতি একমাত্র পদ্ধতি। শিব ভক্তদের কাছে সাধনা আরও সহজ। তিনি আশুতোষ, একটি মাত্র বেলপাতাতেই তুষ্ট।
তাঁর প্রিয় পঞ্চাক্ষরি মন্ত্র ‘নমঃ শিবায়’। প্রিয় ব্রত শিবরাত্রি পালন। প্রতিমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী হল শিবরাত্রি। আর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী হল মহাশিবরাত্রি। প্রিয় ফুল মাঠে ঘাটে অনাদরে ফোটা ধুতুরা, কলকে, আকন্দ। বর্ণ লিঙ্গভেদ নেই। আড়ম্বরহীন আসলে শিবসাধনা যে শুদ্ধ সত্ত্বার জাগরণ।

আরও পড়ুন-শাহর চাপেই কি নির্বাচক প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা চেতন শর্মার?

শিবরাত্রি পালনের বিধি
মহাশিবরাত্রির আগের দিন হবে পালন। গঙ্গাস্নান করতে পারলে উত্তম। হবিষ্যান্ন বা একপাকে রান্না কিংবা নিরামিষ ভাত একবেলা। রাতে দুধ খই, ফল ছানা। রাজসিক ভক্তিতে লুচি পরোটা চললেও রুটি কিন্তু চোঁয়া পোড়া দোষে দুষ্ট। রাত্রে শয্যা কিন্তু কম্বলে কিংবা খড়ে, উপাধান ছাড়া, অনাড়ম্বর এবং সংযমী। সকাল থেকে উপবাস। নিত্য পুজো জপ চলবে বিধিমতো। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে চার প্রহরে চারবার গঙ্গা মাটির শিব গড়ে পুজো করতে হবে নয়তো বাড়ির কালো পাথরের শিবলিঙ্গটিতেও পূজা হবে অথবা প্রতিষ্ঠিত কোনও শিবমন্দিরে গিয়ে। দুধ দই ঘি ও মধু চার প্রহরের শিব স্নানের উপাচার, এর পর গঙ্গাজলে জলাভিষেক। শিবলিঙ্গে মাখানো হবে হলুদ ও কুমকুম এবং অঙ্গরাগ হবে ভস্মের, আঁকতে হবে ত্রিপুণ্ডক। বেলপাতার মালার সাথে সাজানো হবে নীল অপরাজিতার বা আকন্দের মালা। নিবেদন করতে হবে সাধ্যমতো ফল মিষ্টি। কর্পূরের প্রদীপ ধূপ দিয়ে আরতি করতে হবে মহাদেবের শিবরাত্রির মহাব্রত পালনের বিধিতে রাতে ঘুমানো নিষেধ। রাত্রি জাগরণ হবে শিবের নামগান ও মহিমা কীর্তনের মাধ্যমে। কোনও কোনও স্থানে শিবের তাণ্ডব নৃত্যের স্মরণে রাতভর দেবতার নাটমন্দিরে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে শিবরাত্রি পালিত হত। রাত্রি জাগরণ পর সকালে স্নান সেরে আবার বিধিমতো পজো। এবার দক্ষিণা-সহ ব্রাহ্মণভোজন করিয়ে হবে ব্রতের পারণ। অনেক ক্ষেত্রে এই দিনেও নিরামিষ খাওয়ার রীতি আছে।

আরও পড়ুন-ফাটাফাটি ভালবাসার গল্প

শিবরাত্রি ব্রতের ফল
অনেক যুগ আগে বারাণসীতে এক ব্যাধ ছিল। সারাদিন শিকার না মেলায় বাড়িও ফেরা হয়নি, খাবার ও জোটেনি। রাত্রে নিরাপত্তার জন্য গাছে উঠেছে, নিচে শিবলিঙ্গ আর গাছটাও বেলগাছ। অজান্তেই ব্যাধের নড়াচড়ায় শিবলিঙ্গের উপর বেলপাতাও পড়েছে চারবার। সকালে বাড়ি ফিরেছে, খেতে বসার সময় দেখে অতিথি হাজির। সে তার খাবারের অগ্রভাগ অতিথিকে খাইয়ে তবে নিজে খেল। এভাবেই উপবাস, রাত্রি জাগরণ আর বেলপাতা দেওয়া আর পারণের মাধ্যমে অজান্তেই ব্যাধের শিবরাত্রি পালন হয়ে গেল। সেই পুণ্যে মৃত্যুর পর শিবলোকে ঠাঁই হয়, পরজন্মে নিষাদরাজ গুহক হয়ে তার জন্ম হয়, পুরুষোত্তম শ্রীরাম যাকে মিত্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন। এরপর শিবরাত্রি ব্রত সবার কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠে।
শিবরাত্রি ব্রত পালনের দ্বারা শিবকে সন্তুষ্ট করলে মানুষ শরীরের রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পায়। দারিদ্র্য দুঃখ কাটে শিবের বরে। আর সর্বোপরি কুমারী কন্যাদের জন্য আছে শিবের বরে শিবের মতো সৎপাত্র। একমনে শিবের মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপে কেটে যায় মৃত্যুভয়। তাই সত্য ও সুন্দররূপ শিবের মহাশিবরাত্রি ব্রত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা উচিত।

আরও পড়ুন-বিজেপিকে বসন্তের কোকিল বলে কটাক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর

পুজোপাঠের সহজপাঠ
শিবপুজোর ফলে অশিবের বা অমঙ্গলের বিনাশ হয়। সঠিক সাধনা হল নিষ্কাম সাধনা। ঈশ্বরের কাছে যুক্তকরে একমনে সর্বৈব মঙ্গল কামনা করতে হয় আর মনের মধ্যে তাঁর নিত্য ধ্যান করতে হয়। বাকি সব পুজোপদ্ধতি সকাম সাধনায় সাধকের জন্য। নিষ্কাম সাধনায় সাধকের অন্তরের ভক্তিতেই দেবতা প্রীত হন আর সেটাই সাধকের সিদ্ধিলাভ। এতে উপাচার নেই, আড়ম্বর নেই, উপোস নয় আছে উপবাস— উপকণ্ঠে বাস অর্থাৎ মনের গভীরে তাঁর নিরন্তর ধ্যান, জপ ঈশ্বরের স্তব কীর্তন ইত্যাদি। যে যথা মাম প্রপদ্যন্তে ত্বাম তথৈব ভজাম্যহ্যম… যে আমাকে যেভাবে অর্চনা করে আমি সেভাবেই তার ভজনা করি। মনের গ্লানি সরিয়ে প্রজ্ঞার তৃতীয় নয়ন উন্মুক্ত করতে পারলেই মদন ভস্ম অর্থাৎ জ্ঞানের সাহায্য কামনা বাসনার দহন মনের মধ্যে অশিব নাশন শিবের আসন হোক চিরন্তন।

Latest article