না এই ভাবনা একেবারেই অমূলক নয়। প্রমাণ হিসেবে সদ্য প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রে প্রকাশিত একটি তথ্যে সকলের মনের আশঙ্কা অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। আসলে প্রসিডিং অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এ প্রকাশিত এক পেপারে এটি দাবি করা হয়েছে যে, বেশ কয়েকটি ইঁদুর প্রজাতি, বিশেষ করে স্পাইনি র্যাট-এর ক্ষেত্রে বা বলা ভাল এই প্রজাতির পুরুষের ক্ষেত্রে Y ক্রোমোজোমটি (Y chromosome) সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়েছে এবং শুধু তা-ই নয়, এর বদলে এরা এদের দেহে এক নতুন প্রকারের জিনের আবিষ্কার ঘটিয়েছে, যারা নাকি পুরুষ সত্তার পরিচায়ক।
SRY জিন
এবার Y ক্রোমোজোমটি কেন বা কীভাবে পুরুষ সত্তার সঙ্গে যুক্ত তা প্রায় সকলেরই জানা। Y ক্রোমোজোমে থাকা SRY জিন পুরুষের সমস্ত দেহজ বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক, ভ্রূণের জন্মের পর তা ছেলে হবে না মেয়ে— তা নির্ভর করে এই জিনটির উপস্থিতির ওপর আর এটি একমাত্র দেখা যায় Y ক্রোমোজোমেই। তবে চিন্তার ব্যাপার হল এই Y ক্রোমোজোমটিই নাকি আর ৫ মিলিয়ন বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতে চলেছে। তাহলে কি এর সঙ্গেই সমস্ত পৃথিবী পুরুষহীন হয়ে পড়বে? নাকি অন্য কোনও জিন পুরুষত্বের চিহ্ন বহন করে বেড়াবে তা বোঝা বা জানা কিন্তু সময়নির্ভর, তবে আদৌ পুরুষজাতির বিলুপ্তি ঘটবে কি না তা নিয়ে আমরা কিছু বৈজ্ঞানিক কিছু ব্যাখ্যা সাজাতেই পারি।
Y ক্রোমোজোমের (Y chromosome) পূর্বকথা
আমরা সময়ের চাকা ঘুরিয়ে একেবারে বিপরীত পথে হেঁটে গেলে সম্পূর্ণ অন্য একটি চিত্র দেখতে পাই। ১৬৬ মিলিয়ন বছর আগে একেবারে প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পুরুষের ক্ষেত্রে যে Y ক্রোমোজোমটি পাওয়া গিয়েছিল যাকে আমরা সাধারণত প্রোটো-Y বলে থাকি তার মধ্যে থাকা জিনের পরিমাণ X ক্রোমোজোমে থাকা জিনের পরিমাণের সমান ছিল এমনকী উভয় ক্রোমোজোমের আকারও একই ছিল। কিন্তু গোল বাধল অন্য স্থানে। আসলে X ক্রোমোজোমের মতো Y ক্রোমোজোমটি কিন্তু দুটি নয়, মাত্র একটি যা একমাত্র পিতার থেকে তার পুত্রসন্তানের দেহেই যেতে পারে। ফলে যেটা সবচেয়ে বেশি মুশকিল তা হল এই ক্রোমোজোমের মধ্যে থাকা জিনগুলির কোনও বিনিময় সম্ভব হল না অর্থাৎ রি-কম্বিনেশন হল না। ফলে ক্রোমোজোমের খণ্ড বিনিময়ও সম্ভব হল না। তাই কালের নিয়মেই Y ক্রোমোজোমটির ক্ষয় পাওয়া অংশগুলিরও আর পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি। এভাবেই ক্ষয় পেয়ে-পেয়ে এই Y ক্রোমোজোমটির আকৃতি আগের চেয়ে অনেকটা ছোট হয়ে গিয়েছে। এসব সত্ত্বেও কিন্তু Y ক্রোমোজোমের লড়াই একটুকুও বন্ধ হয়নি। সে তার অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে গেছে বারংবার এবং তাতে সফলও হয়েছে। বর্তমানে এই ক্রোমোজোম এমন একটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে তাতে তার ভাঙন তথা তার মধ্যেকার জিনের ক্ষয় রোধ করা যেতে পারে। প্যালিনড্রোম সিকোয়েন্স (উভয় দিকেই সমান হয়, যেমন madam)-কে হাতিয়ার করে একপ্রকার তালি-তাপ্পির মাধ্যমেই Y ক্রোমোজোমের এই টিকে থাকার সংগ্রামটি চলছে।
আরও পড়ুন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডব বহিরাগতদের
অন্যান্য জীবের ওপর Y ক্রোমোজোমের (Y chromosome) অবলুপ্তির প্রভাব
মানুষের মতো অন্য প্রাণীরা কিন্তু শত চেষ্টা করেও তাদের Y ক্রোমোজোমকে রক্ষা করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ বলাই যায় পূর্ব ইউরোপের মোল ভোল ইঁদুর বা জাপানের স্পাইনি ইঁদুর— উভয়ের দেহেই আজ Y ক্রোমোজোমের বা SRY জিনের কোনও অস্তিত্ব নেই। তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, এসব সত্ত্বেও কিন্তু এদের লিঙ্গ-নির্ধারণে কোনও আঁচ পড়েনি। এই ঘটনাটির সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্যই হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসাটো কুরোইয়া ও তাঁর টিম গবেষণা করে এক অদ্ভুত তথ্যের সন্ধান পান। তাঁরা দেখেন যে, স্পাইনি ইঁদুরের দেহে Y ক্রোমোজোমের কোনও অস্তিত্ব না থাকলেও তার সমস্ত জিনগুলি অন্য ক্রোমোজোমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে, কিন্তু সেটি SRY জিন নয়। এমনকী তাঁরা এমন এক বিশেষ DNA সজ্জাক্রমের সন্ধান পান যা শুধুমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নারীদের ক্ষেত্রে এরকম কোনও সজ্জাক্রমের অস্তিত্ব নেই। লিঙ্গ-নির্ধারণের জন্য তাঁরা যেই জিনটির কথা বলেন, সেটি হল ৩ নম্বর ক্রোমোজোমে থাকা SOX9 জিন যা দ্বিত্বকরণের মাধ্যমে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে জিন ডুপ্লিকেশন— তার মাধ্যমে SRY জিনের অনুপস্থিতিতেই সক্রিয় হয়ে ওঠে যা কিনা SRY জিনের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব ছিল না। সাধারণত জিন অ্যামপ্লিফিকেশনের গুণেই SOX9 জিন লিঙ্গ-নির্ধারণের ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে।
আদপেই কি বিলুপ্তি ঘটছে
এত আলোচনা-পর্যালোচনার পরেও যে কথাটি থেকে যায় সেটি হল আদপেই পুরুষ জাতির বিলুপ্তি ঘটছে কি না? এর উত্তর আমরা দু’ভাবে দিতে পারি। এক, Y ক্রোমোজোমের বিলুপ্তি ঘটলেও সম্পূর্ণভাবে পুরুষ জাতির বিলুপ্তি না-ও ঘটতে পারে। কারণ, এমন হতেই পারে পুরুষত্ব প্রকাশের সমস্ত দায়ভার এই Y ক্রোমোজোমটি অন্য কারও ওপর অর্থাৎ অন্য কোনও ক্রোমোজোমের ওপর চাপিয়ে দিল যা আমরা অন্যান্য জীবের ক্ষেত্রে আগেই প্রত্যক্ষ করেছি। আর দুই, মানুষের জিনসজ্জার এমনই পরিবর্তন হল যে, মানুষরূপী বা মানুষের মতোই অন্য এক প্রজাতির সৃষ্টি হল যাদের লিঙ্গ-নির্ধারণে অন্য কোনও ক্রোমোজোম অংশগ্রহণ করল। তবে এই কথাটি একেবারেই অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে, প্রকৃতিতে নারী ও পুরুষ উভয়েরই প্রয়োজন আছে এবং সেটিও আবার সমান ও সঠিক অনুপাতে। কারণ তা না হলে পৃথিবীতে জীবের সংখ্যা কমবে বা এভাবে বললে ব্যাপারটি আরও যুক্তিগ্রাহ্য হবে যে, উন্নত জীবের সংখ্যা কমবে। কারণ এটি আমরা সকলেই জানি যে, একমাত্র যৌন-জননের মাধ্যমে উৎপন্ন অপত্যেই রি-কম্বিনেশন প্রক্রিয়া সম্ভব বলেই জিনগতভাবে উন্নত অপত্য সম্ভব হয় আর এই প্রক্রিয়াটির জন্য দুটি বিপরীত লিঙ্গের জীবের প্রয়োজন পড়ে। তাই বলা ভাল, প্রকৃতি কিন্তু তার স্বার্থরক্ষার্থেই পুরুষ জাতির ধ্বংস মেনে নেবে না, কোনও না কোনওভাবে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে, করবেই।