১ ফেব্রুয়ারি বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী (Finance Minister Nirmala Sitharaman) সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, সমগ্র বিশ্ব ভারতীয় অর্থনীতি নামক উজ্জ্বল তারকার দিকে তাকিয়ে আছে। ২০২০-এর জনসমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি জনসংখ্যার ২০.৬ শতাংশ ভারতীয়। অর্থাৎ, বিশ্বে প্রতি পাঁচজন কর্মক্ষম ব্যক্তির অন্তত একজন ভারতীয়। সুতরাং, সমগ্র বিশ্ব যদি ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
এবারের বাজেটে পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য মূলধনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। ২০২২-’২৩-এর সংশোধিত হিসাবের প্রেক্ষিতে এই বৃদ্ধি প্রায় ৩.২ লক্ষ কোটি টাকা।
ওদিকে, কর রাজস্ব বাবাদ আয়ের বৃদ্ধি তেমন কিছু নয়। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যা জিডিপি-র ৫.৯ শতাংশ।
অগত্যা খরচ কমাতেই হয়েছে। এমনকী সামাজিক ক্ষেত্রের খরচে। ২০২৩-’২৪-এ কেন্দ্রীয় বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি ৯০ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। সারে ভর্তুকি কমানো হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর বহু চর্চিত মনরেগা (MGNREGA)-তে বরাদ্দ কমেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি এবং অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে বরাদ্ধ সামান্য বেড়েছে। তবে তাতে বিশেষ কিছু হেরফের হবে বলে মনে হয় না। মুদ্রাস্ফীতি নামক দানব ওই বৃদ্ধির সুফলটুকু নিশ্চিতভাবে গিলে খাবে।
সামাজিক খাতে সরকারি ব্যয় মানে ভবিষ্যতের জন্য লগ্নি। যে দেশে তরুণের সংখ্যা এত বেশি সে-দেশের জন্য এটা তো আরও বড় সত্যি। এই যে মনরেগার কথা উল্লিখিত হয়েছে, সেটা তো আসলে গ্রামীণ কর্মসংস্থানে নিশ্চিতকরণ প্রকল্প। সেই খাতে বরাদ্দ অর্থ থেকে কোনও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা টাকা পান, তবে সে টাকাটা তিনি নিজের ও বাচ্চার পেটের জ্বালা মেটানোর পাশাপাশি বাচ্চাটিকে স্কুলে পাঠানোর ব্যয় নির্বাহের সাহস দেখাতে পারেন। বিশ্ব অর্থনীতি যখন শিক্ষা এবং জ্ঞান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তখন এরকম খাতে বরাদ্দ ছাঁটলে তা আসলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে পরোক্ষ প্রভাব ফেলতে পারে, এটা মনে রাখা জরুরি।
এই প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিসংখ্যান পরিবেশন করা যেতে পারে।
২০২২-এ এমবিবিএস-এ ভর্তির জন্য সর্বভারতীয় নিট (NEET) পরীক্ষায় ১৯ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২.৬ শতাংশ পরীক্ষার্থী সফল হয়েছিল। বাকিদের অসাফল্য কিশোর-যুব সমাজের একটা বড় অংশের জ্ঞানভিত্তিক পেশায় প্রবেশের অনধিকার পরিষ্কার করে দেয়। এটা কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।
ফি-বছর লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশাধিকার পায় না। আবার, যারা শেষ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষালাভের সুযোগ পায়, তারাও উচ্চমানের কাজ পাওয়ার সুযোগ পায় না। অর্থাৎ, তরুণের হতাশা এদেশে দ্বিমুখী। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ব্যয়-বরাদ্দ বৃদ্ধি জ্ঞান নির্ভর অর্থনীতিতে জোগান ও চাহিদার মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষায় সমর্থ হত। শিক্ষক ও ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানোর একটা সুযোগ আসত। বিশেষত মেয়েরা আরও বেশি সংখ্যায় এই দুটো পেশার সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগ ও সামর্থ্য অর্জন করতে পারত। তরুণ পেশাদারদের সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হত। নিদেনপক্ষে দক্ষ শ্রমিকের হার বাড়ত।
কিন্তু বাজেটের বরাদ্দ সেসব সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিল।
আর্থিক ঘাটতি আর সরকারি ঋণ, এই দুয়ের বহর আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কায় মোদি-নির্মলা জুটি যে অপকর্মটি করেছেন তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার। অব্যবহৃত মানব সম্পদের অপচয় একেবারে সুনিশ্চিত।
আর মোদি-নির্মলা জুটির আর্থিক ঘাটতি ও সরকারের ঋণ নিয়ে যে আশঙ্কা, সেটাই বা কতখানি সঙ্গত? সেখানেও তো বড় আকারের প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে।
আরও পড়ুন: রাতভর ধুন্ধুমার, দিল্লি পুরসভায় নতুন মেয়র শেলিকে হেনস্থা করল বিজেপি
ভারতের সরকারি ঋণের একটা ক্ষুদ্র অংশ, স্পষ্টতর ভাষায়, ২০২২-এর মোট অভ্যন্তরীণ। উৎপাদনের কেবল ৪.২ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ। এরকম ঋণের কারণে ভারতের হাল অদূর আগামীতে গ্রিস বা শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ভারত সরকারের ঋণের বেশির ভাগটাই জুগিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থা এবং ভবিষ্যৎনিধি বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো তহবিল। এ তো অভ্যন্তরীণ ঋণ। ঋণদাতা দেশীয় সংস্থা, ঋণগ্রহীতা দেশেরই সরকার, এরকম ক্ষেত্রে সরকারি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ে আশঙ্কা বহুলাংশে অমূলক। দেশের সরকার দেশের জনতার সঞ্চয়ের একটা অংশ ঋণ হিসেবে নিয়েছে, এতে শঙ্কার জায়গা কোথায়!
আসল ভয়টা তো অন্য জায়গায়। প্রকৃত আশঙ্কার কারণ তো ভিন্ন।
যদি সরকার ঋণ নিয়ে সেই অর্থ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য, আয় বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ করতেন তবে তা নিয়ে শঙ্কার কোনও কারণও ঘটত না, বরং শ্রীবৃদ্ধিচক্র গড়ে উঠতে পারত। বেশি আয় মানে বেশি সঞ্চয়, সেই সঞ্চয়ের অর্থ উন্নয়ন খাতে লগ্নি, এভাবে ঋণমুক্তির পথও উদ্ভাসিত হতে পারত। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য ঋণ নেয়। এ-কারণেই তারা এটা করে যাতে পরিবারের ছেলে বা ময়েটি যথাযতভাবে লেখাপড়া করে ভালমতো উপার্জনক্ষম হয়ে উঠবে এবং সে যখন রোজগার করবে তখন রোজগারের টাকায় পরিবারটির ঋণমুক্তি ঘটবে এবং তার পর সেই অর্থেই পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। সরকারের ক্ষেত্রেও সেই একই অঙ্ক, একটা হিসাব।
সুতরাং সম্পত্তিবিহীনতায় ভুগছে যে পরিবারগুলো, সামাজিকভাবে যারা নিরাপত্তাহীন, তারা যাতে উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, সে বন্দোবস্তটুকু করার জন্যই উল্লিখিত চক্রটি নির্মাণ করা অবশ্যক। এই চক্র পর্যাপ্ত সংখ্যক বৈজ্ঞানিক, গবেষক, প্রযুক্তিবিদ, চিকিৎসক তৈরি করতে সমর্থ হলে তারা বিশ্বের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে। আর, ভারতের তরুণরা এটা করবে বলেই তো ভারতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব।
ভারতের তরুণ প্রজন্মের কাছে সময়টা এখন, ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘মেক অর ব্রেক’ মোমেন্ট। এই সময়টাতে মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকার যদি অর্থ ব্যয় করতেন তাহলে তরুণের স্বপ্ন পূরণে এত প্রতিবন্ধকতা রচিত হওয়ার আশঙ্কা থাকত না। আজকের তরুণরা কাল বৃদ্ধ হবে। তখনও যদি তারা দরিদ্র, অদক্ষ এবং অসন্তুষ্ট থাকে, তবে সেটা ভারতের পক্ষে মোটেও মঙ্গলজনক হবে না। যে-সকল ভারতীয়র বয়স ৩০-এর বেশি জনসংখ্যায় তাদের শতাংশ ২০০০-এ ছিল ৩৭.৫ শতাংশ, ২০৪০-এ সেটা বেড় হবে ৫৮.৬ শতাংশ। এই সুবৃৎ যুবসমাজ খাদ্য- নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা হাতে সরকারি বাজেটের যথাবিহিত মদত পেলে সত্যি সত্যিই ভারতীয় অর্থনীতিকে উজ্জ্বল তারকায় পরিণত করতে পারত ।
কিন্তু কেন্দ্রীয় বাজেট অন্তত তাদের সে সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষণ দেখাল না।
এটা যতটা বিষাদের ততটাই আশঙ্কার।