রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রিয়তমার কত কাছে গেলে পাওয়া যায় তার চোখের চাওয়ার হাওয়া? এই প্রশ্ন পৃথিবীতে শুধু একজন পুরুষকেই করা যায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ। কারণ একমাত্র তিনিই ভাবতে পেরেছেন এবং লিখতে পেরেছেন, ‘কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায় দোলায় মন।’ অথচ এমন বাঙালিও লেখেননি তেমন কোনও প্রেমপত্র যা মনে রাখার মতো! বাংলায় প্রেমের কবিতা, প্রেমের গান, প্রেমের গল্প, প্রেমের উপন্যাসের তো মহাসমুদ্র! আদিগন্ত বিস্তারে থইথই করছে। অথচ বাংলায় প্রেমপত্র মরা গাঙ! বাংলা গান চায়ের কাপ থেকে কড়িকাঠ, সর্বত্র ‘তোমাকে’ চাইছে! কিন্তু বাঙালির প্রেমপত্রে সেই তোলপাড় নেই।
আরও পড়ুন-আকবরেরও পূর্বে বাংলা সনের অস্তিত্ব ছিল?
স্ত্রীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি চিঠির ভাষা পড়লে প্রশ্ন জাগে মনে, এই একই রবীন্দ্রনাথ কি লিখেছিলেন, ‘হে বিরহিণী, আপন হাতে তবে বিদায় দ্বার খোলো।’ কেন রবীন্দ্রনাথও লিখতে পারলেন না সেই আবেগ, সেই আদর, সেই অভিমান ও আশ্লেষের প্রণয়পত্র, যে আদর, আবেগ, আশ্লেষ, মিলনেচ্ছা তিনি রেখে গেছেন তাঁর গানে, গল্পে, কবিতায়? এই প্রশ্নের আশ্চর্য অকপট উত্তর রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিয়েছেন ভাইঝি ইন্দিরাকে লেখা একটি চিঠিতে : ‘তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি, তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনও লেখায় হয়নি। তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে তুই আমার কোনো কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে। আমরা দৈবক্রমে প্রকাশ হই; আমরা ইচ্ছে করলে চেষ্টা করলেও প্রকাশ হতে পারি নে— চব্বিশ ঘণ্টা যাদের সঙ্গে থাকি, তাদের কাছেও আপনাকে ব্যক্ত করা আমাদের সাধ্যের অতীত। তোর এমন একটি অকৃত্রিম স্বভাব আছে, এমন একটি সহজ সত্যপ্রিয়তা আছে যে, সত্য আপনি তোর কাছে অতি সহজে প্রকাশ পায়। সে তোর নিজের গুণে। যদি কোনও লেখকের সবচেয়ে ভাল লেখা তার চিঠিতেই দেখা দেয়, তা হলে বুঝতে হবে যে যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখাবার ক্ষমতা আছে।’ রবীন্দ্রনাথ যে তেমন কোনও প্রেমপত্র লিখতে পারলেন না, যে পত্র হতে পারে কিটস বা কাফকার প্রেমপত্রের সঙ্গে তুলনীয়, তার একটি কারণ তাঁর জীবনে সেই নারীটি আসেনি যে তাঁকে দিয়ে প্রেমপত্র লিখিয়ে নিতে পারে। আরও একটু বিস্তৃত ভাবে ভাবলে একটি বিষণ্ণ সত্য প্রকট হয়ে ওঠে আমাদের সামনে। সেই সত্যটি হল, এদেশে স্ত্রীশিক্ষার অভাব। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এঁদের জীবনে নারী আসেনি, তা তো নয়। কিন্তু কোথায় সেই নারী যে বুঝবে প্রেমপত্র? লিখবে উত্তর? রবীন্দ্রনাথ বারবার আক্ষেপ করেছেন স্ত্রী মৃণালিনীর কাছে, তাঁর চিঠির উত্তর না পাওয়ার জন্য। কিন্তু মৃণালিনী তাঁর হস্তাক্ষর, বানান এবং ভাষার দুর্বলতার কথা মনে রেখে স্বামী রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখা থেকে যতখানি সম্ভব বিরতই থেকেছেন!
আরও পড়ুন-বাংলার মানচিত্রের বিবর্তন
এ-যুগের বাঙালি পুরুষ ভাগ্যবান, কারণ তাদের কপালে শিক্ষিত, চর্চিত নারীর অভাব নেই। কিন্তু অন্য একটি ভয়ানক অভাব দেখা দিয়েছে এ-যুগের নারী-পুরুষের জীবনে। সেটি হল, বিরহের অভাব। এবং প্রেমের সম্পর্কে দূরত্বের অভাব। টেলিফোনের যুগ শুরু হতেই চিঠিপত্রের যুগ শেষ হওয়া শুরু হয়েছিল। আর সেলফোন বিরহ ও দূরত্বের সর্বনাশ ঘটাল। এখন প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমের যে-কোনও সম্পর্কে বিচ্ছেদ, বিরহ, দূরত্বের এতটুকু জায়গা নেই। হোয়াটসঅ্যাপ, ট্যুইটার, মেসেজ এবং সর্বক্ষণ সেলফোন এবং ভিডিওকল! নারী-পুরুষ ক্রমাগত একে অপরের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। প্রেমপত্রের চান্স কোথায় সর্বক্ষণের এই ঘেঁষাঘেঁষির মধ্যে?
আরও পড়ুন-ব্রুকের মঞ্চে খাটল না রিঙ্কু ম্যাজিকও
এ-যুগের সব থেকে জরুরি প্রশ্নটি হল, আর কি কখনও কবে, ‘মেঘদূত’ লেখা হবে? অসম্ভব। আর কখনওই ‘মেঘদূত’ লেখা হবে না। কারণ এই কাব্যের সবটুকুই বিরহ ও দূরত্বের দান। এই বিচ্ছেদ, বিরহ এবং অপরিমেয় দূরত্ব আর প্রেমের সম্পর্কে সম্ভব নয় সেলফোনের সৌজন্যে। আর নারী-পুরুষ যদি ক্রমাগত কথা বলতেই থাকে এবং ভিডিওকলে চাক্ষুষ হতেই থাকে পরস্পরের কাছে, প্রেমপত্রের প্রয়োজন এবং তাড়না তো লুপ্ত হতে বাধ্য। সুতরাং প্রেমপত্রের যুগও শেষ হয়েছে বলা যায়। ভাগ্যিস জন্মেছিলাম প্রেমপত্রের যুগে। এবং জীবনে পেয়েছিলাম সেই সব চর্চিত, শিক্ষিত, তোলপাড়-নারী, যারা শুধু প্রণয়পত্র পেতেই জানত না, পাঠাতেও জানত! আমি এইটুকু বলতেই পারি, নারী সান্নিধ্যে ও সংস্পর্শে যে তাপিত রত্নভাণ্ডার পেয়েছি, তার চেয়েও হয়তো দীপিত প্রাপ্তি থেকে গেছে আমার লেখা এবং পাওয়া ভালবাসার চিঠিতে। নিজে অসংখ্য প্রেমপত্র লিখেছি। প্রেমিকার কাছে না গিয়ে তাকে কখনও-কখনও চিঠি লিখতেই বেশি পছন্দ করেছি আমি। এই নারীদের দু’জন আমার স্ত্রী হওয়ার পরে বুঝেছি, বিয়ে কীভাবে হত্যা করে প্রেমপত্রকে! এবং প্রেমপত্র লেখার ও পাওয়ার আনন্দকে! তবে পর-জায়াকে প্রণয়পত্র লেখার মধ্যে যে তীব্রতা গহনতা, তির্যকতার টান উপভোগ করেছি এবং বাংলা ভাষায় যেসব বিস্তীর্ণ ইশারার আয়োজন করতে পেরেছি, তা সম্ভব হয়নি নিজ-জায়াকে চিঠি লিখে। ক্রমশ বুঝতে পেরেছি বিয়ে প্রেমপত্রের দুর্বার ঘাতক।
আরও পড়ুন-বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনায় কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
অবৈধ প্রেমের চিঠি লেখায় বিপদ এবং দুর্ভোগের আঁচ আছেই আছে। এবং সেই আঁচই অবৈধ প্রণয়ের প্রধান আকর্ষণ। অসামাজিক আশনাইয়ের তাপ সেই প্রেমপ্রকাশের পত্রে। এই সব গোপন পত্রে যে কত বড় বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে সেই ভাবনার শিহরন অবৈধ ভালবাসার টান বাড়ায়। গোপন প্রেমের চিঠি মেয়েরা যেভাবে লুকিয়ে রাখতে পারে, সম্ভবত ছেলেরা পারে না। এই প্রসঙ্গে এক পরনারীর কথা মনে পড়ছে যাকে এক সময়ে আমি তোড়ে চিঠি লিখেছি। নারীটি বোধবুদ্ধিসম্পন্না। তাকে চিঠি লিখে মনের আরাম পাই। এবং অনেক সময়েই তার সান্নিধ্যের থেকেও ভালবাসি তাকে চিঠি লেখার আনন্দ ও উত্তাপ। কিন্তু আমার এই চিঠির প্লাবন সে রাখে কোথায়? তাকে জিজ্ঞেস করলে সে মুচকি হাসে। তার চোখে দেখা যায় ঝিলিক। তার গালে টোল। কোনও এক লক্ষ্মীপুজোর দিন তার ঠাকুরঘরে তার স্বামীর সামনে ঘটল ঘটনা। তার হাত থেকে পড়ে গেল লক্ষ্মীর ঝাঁপি। আর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল আমার প্রেমপত্রের তোড়।
আরও পড়ুন-এবার ৭ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি ট্রাম্প
প্রেমপত্রজাত আরও এক অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। প্রেমে পড়েছি পর-জায়ার। তখন স্মার্টফোনে প্রেমপত্র পাঠাচ্ছি। হাতে লেখা চিঠি। হ্যোয়াটসঅ্যাপ করে পাঠাই। যে-প্রেমে প্রেমের চিঠি নেই, সে আবার কেমন প্রেম? আমার এই পুরনো প্রত্যয়ের টানে পড়েছে পরস্ত্রী। সে আমাকে জানায়, তার স্বামীর কাছ থেকে সে কখনও কোনও চিঠি পায়নি। এর ফলে, আমাদের ভালবাসায় যেন নতুন একটা ডাইমেনশন দেখা দেয়। পরস্ত্রীটি স্মার্টফোনে তুখড়। সে আমাকে জানায়, সে নাকি স্মার্টফোনের সুবিধার সৌজন্যে আমার সমস্ত চিঠি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রাখছে। আমার মনে ধরে কথাটা। এই ‘মেঘমল্লার’ সম্ভব? প্রশ্ন জাগে মনে। পরস্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্কে কসমিক দ্যোতনা আসে। সরে যায় সব অন্যায়বোধ।
আরও পড়ুন-নতুন দার্জিলিং গড়ার ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর
তারপর একদিন সেই নারীর ওপরচালাক স্বামী অব্যর্থ ‘কোড’ প্রয়োগে ভেঙে ফেলে ক্লাউডের আড়াল। মেঘভাঙা প্রেমপত্রের বন্যা নামে অলীক আকাশ থেকে! অবৈধ প্রেমপত্রের এই একটা বিপদ। কখন যে বেড়াল বেরিয়ে পড়বে থলে থেকে! কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর বৈধ প্রেমপত্র কে পড়বে বলুন? তাতে সব থাকে। জীবনের সমস্ত চুলচেরা নিখুঁত হিসেব। শুধু থাকে না সেই শীতল পারিপাট্যে অবৈধ প্রণয়ের ঈশ্বরকণা!