সুকুমার রুজ: আহা! তোমাকে ঠিক মা সারদাময়ীর মতো লাগছে গো! লালপেড়ে সাদা শাড়ি, কপালে সিঁদুরের টিপ, হাতে পুজোর ফুল…!
দেখো, পুজো করতে বসছি। এখন আদিখ্যেতা কোরো না।
মিনু, আদিখ্যেতা নয় গো! সত্যি বলছি, তোমার এই রূপটা আমার খুব ভাল লাগে। কী স্নিগ্ধ, শান্ত। আমি রোজ এইসময় মুগ্ধ হয়ে তোমাকে দেখি। আর ভাবি, এই সারদাময়ী আমার বউ, আমারই বউ। জানো, এই বয়সে আবার নতুন করে তোমার সঙ্গে প্রেম করতে ইচ্ছে করে!
মিনতির গাল ঈষৎ রাঙা হলেও সামলে নেয়। বলে— ঠিক আছে, আমি সারদাময়ী হলে তুমি রামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণ সারদাময়ীকে কী করেছিলেন, জানো তো!
আরও পড়ুন-দক্ষিণ সমীরণ সাথে
দীননাথ দু’পা এগিয়ে, আচমকা নিচু হয়ে মিনতির পা ছুঁয়ে প্রণাম করে— জানি, সারদাকে মা জ্ঞানে পুজো করেছিলেন। তাই তো আমিও…!
মিনতি দু’পা পিছিয়ে যায় এবং বাস্তবিকই প্রচণ্ড রেগে ওঠে— বুড়ো বয়সে তোমার ভীমরতি হয়েছে। বেরোও এখান থেকে। ঠাকুরের সামনে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলে! আমার কত পাপ লাগল জানো! তোমার একটুও মায়া হল না, আমাকে নরকে পাঠাতে!
কথা বলতে বলতে মিনতি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। দীননাথ বুঝে উঠতে পারে না, মিনতি কেঁদে ফেলল কেন! ও তো ওর ভাললাগাটাই মিনতিকে বোঝাতে চাইছিল, কিন্তু মিনতি…!
আরও পড়ুন-ফুল পাখি প্রজাপতি বন্ধু, গাছবাড়ি দেবে শীতল আশ্রয়, বজবজে প্রকৃতির পাঠশালা
ও মিনতির পিঠে হাত রেখে বলে— ঠিক আছে, ভুল হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি। তুমি পুজোপাঠ সেরে নাও। তবে যাওয়ার আগে বলি, কোনও ক্যালেন্ডারে কান্নাভেজা চোখের সারদাময়ী দেখিনি। আমি নিশ্চিত, কোনও শিল্পী তোমার এখনকার এই মুখখানা দেখলে, এর ছবি এঁকে ক্যালেন্ডার কোম্পানিকে চড়া দামে বিক্রি করত।
মিনতি চোখ মুছে ঝাঁঝিয়ে ওঠে— তুমি যাবে এখান থেকে! রিটায়ার্ড হওয়ার পর আর তো কোনও কাজ পাচ্ছ না, তাই আমার পেছনে লাগতে এসেছ। আমাকে পুজোটা করতে দাও ভাল করে।
আরও পড়ুন-নববর্ষে সরগরম বইপাড়া
দীননাথ ঠাকুরঘরের সামনে থেকে চলে আসে। ফুলগাছ ভরা ব্যালকনিতে রাখা বেতের চেয়ারটাতে গিয়ে বসে। ফুলগাছগুলোতে চোখ যায়। এটা মিনুর ফুলবাগান। ও কত যত্ন করে গাছগুলোকে। গাছগুলো মানুষের মতো অকৃতজ্ঞ নয়। ওরাও ফুলে-ফুলে ব্যালকনিটাকে আলো করে রেখেছে। চারখানা গোলাপগাছ। সবগুলোই ফুলে-ফুলে ভরা। ওই যে গ্রিলের ধারে সাদা গোলাপ গাছটাতে যেন আলোর মেলা। এত ফুল ফোটে কী করে, কে জানে! ফিনফিনে বাতাসে ফুলগুলো তিরতির করে নড়ছে। সাদা গোলাপের পাপড়িতে শিশিরফোঁটা নাকি মিনুর দেওয়া জলের ছিটে, জানে না। কিন্তু তাতে রোদ্দুর পড়ে কী দারুণ যে লাগছে! ঠিক যেন একটু আগে দেখা কান্না-ভেজা মিনুর মুখ। যেমন স্নিগ্ধ তেমন সুন্দর ও নিষ্পাপ। মিনু বলল, ওর নাকি পাপ লাগল। এমন ভক্তিমতী নারীর কি পাপ লাগতে পারে! যতসব আজগুবি কথা।
দীননাথের মনে পড়ে যায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে শোনা মিনুর একটা কথা, ‘আমি এখন শিবরাত্রির জন্য উপোস করে আছি। তুমি আমাকে শিবমন্দিরে একা পেয়ে চুমু খেলে। ঠাকুর তোমাকে পাপ দেবে।’ ও হেসে বলেছিল, ‘তোমার তো পাপ হবে না! তোমার উপোস ভাঙেনি। কেননা, তুমি তো চুমু খাওনি, আমি খেয়েছি।’ তখন মিনু রাগ ও ভালবাসা মেশানো অদ্ভুত এক মুখভঙ্গি করেছিল যা আজও মনের কোণে জ্বলজ্বল করছে।
আরও পড়ুন-ফুল পাখি প্রজাপতি বন্ধু, গাছবাড়ি দেবে শীতল আশ্রয়, বজবজে প্রকৃতির পাঠশালা
আক্ষরিক অর্থেই মিনু তখন অষ্টাদশী। জানকিবালা বালিকা বিদ্যালয়ে টুয়েলভে পড়ে। ‘শোলে’ সিনেমার ‘বাসন্তী’র মতো দেখতে ছিল। তখন ও ওই ‘শোলে’র বাসন্তীর মতো খুব বকবক করত। শুনতে কী ভাল যে লাগত!
ও নিজে তখন সদ্য স্কুল-মাস্টারের চাকরিটা পেয়েছে। ওদের প্রেমের কথা সারা গ্রামে এবং দু’জনের বাড়ির অভিভাবকদের কাছেও চাউড় হয়ে গেছে। মিনুর এইচএস পাশ হয়ে গেলেই ওদের প্রেমের পরিণতি পরিণয়ে পরিণত হবে, এমনটা ঠিক হয়ে আছে।
দীননাথের কানে আসে একটা গুনগুন শব্দ। এদিক-ওদিক চোখ চারাতেই চোখে পড়ে একটা ভোমরা। মিসমিসে কালো। উড়ে উড়ে গিয়ে লাল টকটকে গোলাপটার উপরে বসল।
আরও পড়ুন-বাদশার শহরে আজ ইজ্জতের লড়াই
ও ভাবে, প্রকৃতি কি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে! এই মুহূর্তে ওর মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এমনই একটা ভাবনা। সেই সময় মিনুকে লাল গোলাপের মতোই সুন্দর লাগত। আর ও নিজে ছিল কালোভ্রমর। বাস্তবিকই ওর গায়ের রং কালো। মোটেও সুন্দর দেখতে নয়। তবুও কী করে যে মিনুর মনের নাগাল পেয়েছিল!
সে কী অদ্ভুত প্রেম! এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো জড়াজড়ি ধরাধরি নয়, শুধু চোখে চোখে মনের গভীরে এক অদৃশ্য ছোঁয়া। ওই ফিনফিনে বাতাস যেমন অদৃশ্য থেকেও ফুলগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনই অদৃশ্য ছোঁয়ায় দু’জনের হৃদয় দুলে উঠত। মনের ভেতরে ফুটে উঠতে অসংখ্য প্রেমের কুঁড়ি। যেমন এখন অসংখ্য কুঁড়ি ধরেছে ওই সাদা গোলাপ গাছে। এখন মিনু যেন ওই সাদা গোলাপ আর ও নিজে হয়ে গিয়েছে একটা ডাঁশমাছি। মিনুর গায়ে বসলে ও যেন তাড়াতে পারলেই বাঁচে।
আরও পড়ুন-মেহুল প্রত্যর্পণে বড় ধাক্কা খেল কেন্দ্র, সিবিআই, ইডির ব্যর্থতা
কুঁড়ির কথা মনে আসতেই দীননাথ সাদা গোলাপের কুঁড়িগুলোকে খুঁটিয়ে দেখে। সবুজ বোঁটায় সাদা পাপড়ি সবে উঁকি দিচ্ছে। কী দারুণ যে লাগছে!
ওর মনে পড়ে, প্রথম যেদিন মিনুকে দেখেছিল, সেদিনটার কথা। সেদিন ওর দারুণ লেগেছিল মিনুকে। মিনু যেন তখন ওই সবুজ সাদা গোলাপ-কুঁড়ি। সবুজ গাউনের উপরে সাদা ফ্রক, চুলে সবুজ ফিতে, দুধে আলতা রঙের কপালে কালো কাজলের টিপ। মিনতির তখন জানকিবালা বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস এইট, আর ও কলেজে পড়ে।
সেই প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়া। প্রজাপতি ধরার মতো মিনুর পিছনে ছুটে, বছর তিনেক চেষ্টার পর ওর মন পেয়েছিল। তখন আবার নতুন করে ওর প্রেমে পড়েছিল। সে এক অন্যরকম প্রেম, যেন ওই পুবের কোণে রাখা নুড়ি ভরা ক্যাকটাসের টবে হাত বাড়িয়ে, কাঁটা বাঁচিয়ে সুন্দর ফুলটাকে তোলার চেষ্টা।
আরও পড়ুন-নববর্ষে সরগরম বইপাড়া
এসব ভাবনায় দীননাথ আপন মনেই মিটিমিটি হাসে। ভাবে, বিয়ের পর মিনু যেন ‘শোলে’র ‘বাসন্তী’ থেকে বদলে গিয়েছিল ‘তোফা’র শ্রীদেবীতে। তখন মিনুর আর একরকম রূপ। উচ্ছ্বলতা কম, সৌন্দর্য বেশি, কথা কম, দায়িত্ববোধ বেশি। সে রূপের প্রেমেও বহুদিন। আলো আছে, অথচ তাপ নেই। মেলামেশা আছে অথচ ভয় নেই।
তার একবছর পরেই মিনু রূপ বদলে ফেলল। তখন ও যেন পদ্মফুলের টাঁটি। পাপড়িগুলো একটা একটা করে খসে পড়েছে। সৌন্দর্য উধাও। দুটো রসবতী পাপড়ির নিচে সবুজ রঙের গোল টাঁটি, বীজে ভরা। সেই বীজ এখন টরেন্টোতে ফুল ফোটাচ্ছে। মাঝে মাঝে রাতদুপুরে ভিডিও কলে কথা হয়।
আরও পড়ুন-ফিরহাদ হাকিমের সভায় বেশি লোক হবে বলে স্থানবদল, আজ বিজেপিকে পাল্টা তৃণমূলের
মিনু যখন পদ্মটাঁটি, তখন ওর শরীরের অন্যান্য অঙ্গের চেয়ে বেশি আদর পেত ওর ঢাউস পেটখানা। তখন ওকে খুব যত্ন করতে ইচ্ছে করত। প্রেম যেন তখন বদলে যেত স্নেহ আর সেবায়।
তারপর যখন বাবু ওর কোলে, তখন ওকে মনে হত মাদার মেরি। তখন ওকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করত। সময়মতো খাওয়াদাওয়া নেই, রাতে ঘুম নেই। অথচ ক্লান্তিও নেই। ওর তখন ধ্যানজ্ঞান ছিল শুধুমাত্র বাবু। মিনুর ওই স্নেহশীলতা, ওই মমতা ওকে নিজের মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দিত। ও ছিল হতভাগা, নিজের মায়ের আদর বেশিদিন পায়নি। বাবু যেন…!
ওর প্রার্থনা সফল হয়েছে। তিরিশ বছরের বাবু আজও মিনুর কাছে সেই ছোট্ট বাবুটাই রয়ে গেছে। মাঝরাতে বাবু ভিডিও কল করলে, মিনু বলে, ‘বাবু, খাবার গরম থাকতে থাকতে খেয়ে নিবি। আলো জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়বি না!’
আরও পড়ুন-রাজু ঝা খুনে জেলবন্দি আসামিকে সুপারি
বাবু হেসে ওঠে। বলে, ‘মা, আমি এখন অফিসে। রিসেস টাইমে লন-এ এসে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।’
মিনু তখন অপ্রস্তুতের হাসি হাসে। ওর গালদুটো গোলাপি হয়ে ওঠে। বোকা বোকা মুখখানা এত সুন্দর লাগে, ওই মুখখানা ধরে আলতো হাতে আদর করতে ইচ্ছে করে। ঠিক যেমন সকালবেলায় ব্যালকনিতে এসে মিনু আধফোটা সূর্যমুখীটাকে আদর করে।
দীননাথ চেয়ার ছেড়ে ওঠে। দু’পা বাড়িয়ে সূর্যমুখীর কাছে যায়। আলতো হাতে সূর্যমুখীটাকে ছোঁয়। এমন সময় মিনুর গলা— অ্যাই! আমার ফুলে হাত দেবে না। ওরা আজেবাজে ছোঁয়া পছন্দ করে না।
আরও পড়ুন-পয়লা বৈশাখের তীব্র গরমে কালীঘাট–দক্ষিণেশ্বর–তারাপীঠে মানুষের ঢল
দীননাথ চমকে উঠে হাত সরিয়ে নেয়। আমতা আমতা করে বলে— আজ এত তাড়াতাড়ি তোমার পুজো করা হয়ে গেল?
হ্যাঁ, আজ আর গীতাপাঠ করলাম না। মন চঞ্চল হয়ে গেছে। ঠাকুর বললেন, পাপক্ষালনের জন্য আজ শুধু তোমার সেবা করতে। চলো, ঘরে চলো। আজ তোমাকে অনেক ভালবাসব, অনেক যত্ন করব।
শুধু যত্ন করবে, আদর করবে না?
হ্যাঁ, করব তো! বিষ্ণুপ্রিয়া যেমন শ্রীচৈতন্যকে আদর করত, সেইরকম। চলো চলো, ঘরে চলো।
দীননাথ মিনতির পিছন পিছন ঘরে যেতে যেতে ভাবে, এটাও এক ধরনের প্রেম। এটাকে কী প্রেম বলবে ভেবে পায় না। ও মনে মনে শব্দের বাগানে উপযুক্ত শব্দ খুঁজতে থাকে।
অঙ্কন : শংকর বসাক