অপুর খোঁজে
ইউরোপের কোনও এক চলচ্চিত্র উৎসবের সাংবাদিক সম্মেলনে এক বিদেশি সাংবাদিক সত্যজিৎ রায়কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি আপনার প্রায় সমস্ত ছবিতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কেন কাস্ট করেন? উত্তরে সত্যজিৎ বলেছিলেন, আমি ওর সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করি একটাই কারণে। সেটা হল সৌমিত্র ইজ নট অনলি অ্যান অ্যাক্টর, হি ইজ মোর দ্যান অ্যান অ্যাক্টর।
আরও পড়ুন-বাংলাকে গুজরাট, ইউপি হতে দেব না, জঙ্গিপুরে ফিরহাদ
সালটা ১৯৫৬। ‘পথের পাঁচালী’র মায়ায় তখনও সারা পৃথিবী মায়াচ্ছন্ন। সত্যজিৎ রায় ঠিক করলেন অপুর ট্রিলজি সম্পূর্ণ করবেন। ‘অপরাজিত’র চিত্রনাট্যের কাজ শেষ করে তিনি কিশোর অপু খুঁজছেন। ওদিকে সৌমিত্র তখন কৃষ্ণনগর থেকে সদ্য পা রেখেছেন মহানগরীতে। কলেজে পড়ছেন বাংলা সাহিত্য নিয়ে। শিশির ভাদুড়ীর কাছে নাড়া বেঁধেছেন। নিচ্ছেন থিয়েটারের প্রাথমিক পাঠ। উত্তাল সময় এবং সেই সময়ের উত্তাপ এবং উদাসীনতা সৌমিত্র-চেতনাকে করছে তাড়িত। শুরু হয়েছে যুবক সৌমিত্রের আত্মখনন, কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসা, কফি হাউস। সৌমিত্র তখন রীতিমতো এই মহানগরীর এক তরুণ তুর্কি।
আরও পড়ুন-অবশেষে আলিপুরদুয়ারে জেলা আদালত চালু হল
‘পথের পাঁচালী’ দেখে ফেলেছেন বেশ কয়েকবার। দেখে ভিতরে ভিতরে চলচ্চিত্রে কাজ করার আগ্রহ উঁকি মারতে শুরু করেছে। কারণ ছবিটি সৌমিত্রের সামগ্রিক শিল্পীসত্তাকে একদম মূল থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যে ‘পথের পাঁচালী’ দেখে তাঁর অনুভূতির বিশ্লেষণ তিনি তাঁর শেষ ছবি ‘আমি সৌমিত্র’তে বলেছেন, সিনেমার অভিনয়ের প্রাথমিকতায় হল অভিনয়ের স্বাভাবিকতা। ‘পথের পাঁচালী’র আগে সিনেমা বা রঙ্গমঞ্চে একই সঙ্গে সব চরিত্রকে এত ডিসিপ্লিন্ড ওয়েতে স্বাভাবিক অভিনয় করতে দেখা যায়নি। এর আগে বিচ্ছিন্ন ভাবে কাউকে কাউকে দেখা গেছে স্বাভাবিক অভিনয় করতে। ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম একটি শিল্পকর্ম যেখানে সবাই একই সঙ্গে অত্যন্ত সাবলীল ভাবে স্বাভাবিক অভিনয় করে চলেছে। সে-সময় রঙ্গমঞ্চ এবং চলচ্চিত্রের অতি-অভিনয়ের দাপট থেকে সৌমিত্র বেরিয়ে আসতে চাইছেন। চাইছেন একজন স্বাভাবিক, সাবলীল অভিনেতা হিসেবে রঙ্গমঞ্চ এবং চলচ্চিত্রে ছাপ ফেলতে। ঠিক সেই সময় এক অনন্য অপুর খোঁজ করছেন সত্যজিৎ রায়। অপু তখন গ্রাম থেকে সদ্য শহরে পা রেখেছে। কিশোর অপুর চোখে মায়া, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, বৃহত্তর পৃথিবীকে দেখার, জানার আকুলতা। অপুর চোখ দুটো নিষ্পাপ সরল কিন্তু শাণিত! যার জন্য শুধুমাত্র একজন পেশাদার অভিনেতার চোখ যথেষ্ট নয়, তাই কোনও পেশাদার অভিনেতা চাইছেন না পরিচালক।
আরও পড়ুন-অভিষেককে ঘিরে জনজোয়ার
চাইছেন সেই চোখ যে চোখে থাকবে সংবেদনশীলতা, যে চোখে থাকবে গভীরতা, বুদ্ধি, বাঙালির অনন্ত বিক্ষণ। ঠিক সেই সময় সৌমিত্রের অভিনয় মঞ্চে দেখে সত্যজিতের এক সহকারী নিত্যানন্দবাবুর মনে হয় তাঁর পরিচালক বোধহয় এই মুখ এই চোখ খুঁজছেন। সৌমিত্রকে সহকারী তৎক্ষণাৎ নিয়ে আসেন সত্যজিতের বাড়িতে। সৌমিত্রকে প্রথমবার দেখামাত্র সত্যজিতের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই তো সেই মুখ, সেই চোখ— যার সন্ধানে পরিচালক হন্যে হয়ে ঘুরছেন এই মহানগরে। এ যেন পরিচালকের প্রতি অভিনেতার ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’। এক মুহূর্তের জন্য সত্যজিতের গভীর উজ্জ্বল চোখ যেন এক মায়াঘন মোহর মধ্যে ডুবে গেল। কিন্তু চকিতেই মোহভঙ্গ হল সৌমিত্রের উচ্চতা মালুম হলে। অত্যন্ত হতাশ হয়ে সত্যজিৎ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন— ‘এ হে আপনি যে বড্ড লম্বা হয়ে গেলেন!’
আরও পড়ুন-আজমের আশঙ্কা
উচ্চতার জন্য সেদিন অপরাজিতের অপু হয়ে উঠতে পারেননি সৌমিত্র। ‘আমি সৌমিত্র’ ছবিতে সৌমিত্র বলেন, সেদিন মানিকবাবু অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলেন। পড়েছিলেন চোখের ভাষা। পরিচয় পেয়েছিলেন যুবক সৌমিত্রের পঠন-পাঠন মনন এবং আত্মখননের। খোঁজ পেয়েছিলেন এক সাহিত্যপ্রেমী বুদ্ধিজীবী আধুনিক মেধার। এতকাল যেন এমনই কাউকে খুঁজছিলেন সত্যজিৎ। এই সেই মুখ যা এই তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালকের একমাত্র প্রয়োজন, বাঙালির দর্শনকে পৃথিবীর চলচ্চিত্র আঙিনায় নিয়ে আসতে। যে মুখ এবং চোখে থাকবে বাঙালির আত্মখননের প্রতিচ্ছবি। যে মুখ শুধুমাত্র একমাত্র পেশাদার অভিনেতা দিতে পারে না, সেটা দিতে পারে একমাত্র অভিনয় নয়, অভিনয়ের চেয়েও আরও বেশি কিছু। সেদিন সৌমিত্রর সঙ্গে কথা বলে সেটাই মনে হয়েছিল সত্যজিতের। যিনি সত্যজিতের আগামী সমস্ত চরিত্রগুলোকে এক স্বতন্ত্র অনন্য মাত্রা দেবেন, তিনি আর কেউ নন, একমাত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সেদিনই দুজনের অজান্তেই পৃথিবীর চলচ্চিত্রের একটি ইতিহাসের জন্ম হয়েছিল। সৌমিত্রের সঙ্গে আড্ডা মেরে সেদিন মানিকবাবুর এতটাই ভাল লেগেছিল যে উনি সৌমিত্রকে বলেন, মাঝেমধ্যে আসবেন, আড্ডা দেওয়া যাবে।
আরও পড়ুন-চারের লড়াইয়ে ধোনি বনাম শিখর
দ্বিতীয় সাক্ষাৎ
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তখন আকাশবাণীর সংবাদ-পাঠক, সত্যজিতের সেই সহকারী একদিন কফি হাউসে সৌমিত্রকে দেখতে পেলেন, সদ্য পক্স থেকে সেরে উঠেছেন সৌমিত্র। নিত্যানন্দবাবু সৌমিত্রকে বলেন, মানিকবাবু আপনাকে খুঁজছেন কোনও একটি চরিত্রের জন্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দেখা করেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। এটা দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। খুঁটিয়ে দেখলেন মানিকবাবু। দেখেই বলে উঠলেন, ‘কই অনেকে যে বলছিল মুখে অনেকগুলো বসন্তের দাগ হয়ে গেছে? সেরকম তো কিছু দেখছি না।’ সেদিন মানিকবাবু সৌমিত্রকে দিয়ে অনেক কথা বলিয়েছিলেন। সৌমিত্র পরে বুঝতে পারেন সেটা আসলে ছিল একটা অডিও ভিস্যুয়াল টেস্ট। সত্যি সত্যি তিনি দেখে নিয়েছিলেন যে সৌমিত্র বাংলাটা কেমন বলেন। ভাল বাংলা বলতে পারেন না বলে অনেককেই তিনি বাদ দিয়েছিলেন। মানিকবাবু তখন খুঁজছেন ‘অপুর সংসার’-এর অপু। সত্যজিতের নিজের অস্তিত্বের মধ্যে যেমন বিভূতিভূষণের অপু চুপিসারে বাস করত, সৌমিত্রের মধ্যেও তেমনই একটি অপু কোথাও ঘাপটি মেরে বসে ছিল। এবং সৌমিত্রের ভেতরকার সেই অপুটিকেই সত্যজিৎ রায় আবিষ্কার করেছিলেন। আসলে ‘অপুর সংসার’ বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ এবং সৌমিত্র নামক এই তিন অপুর এক অলীক মৌন রসায়ন। যে-কারণে কোরিয়ান চিত্র পরিচালক কিমকি দুক ‘অপুর সংসার’ দেখে বলেছিলেন, সৌমিত্রের মতো অভিনেতা না পেলে সত্যজিৎ রায় ‘অপুর সংসার’-এর মতন অমন মায়াবী সিনেমা বানাতে পারতেন না।
আরও পড়ুন-সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করে শুরু যুদ্ধ, উদ্ধারকাজে জোর
‘পথের পাঁচালী’র অপুর মতো সৌমিত্র কৃষ্ণনগরের গ্রামের বাড়িতে কাপড় দিয়ে মঞ্চ খাটিয়ে কাগজের মুকুট বানিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ নাটকে অভিনয় করার চেষ্টা করতেন। অপুর সাহিত্যপ্রীতি তার জীবনবোধ তার মনন এবং মেধার কোথাও যেন সত্যজিৎ এবং সৌমিত্রের মনন এবং মেধার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সত্যজিতের ‘অপুর সংসার’ বিভূতিভূষণের ‘অপুর সংসার’ এবং সৌমিত্রের ‘অপুর সংসার’ যেন নিজেরাই নিজেদের আবিষ্কার করে। ‘অপুর সংসার’-এর সৌমিত্র এতটাই স্বাভাবিক এতটাই মাটির কাছের, দেখে যেন মনে হয় অভিনয় করছেন না, তিনি অপুতেই বাস করছেন। তার কারণ সত্যজিৎ সেখানে সৌমিত্রকে দিয়ে অভিনয় করাননি, তিনি সৌমিত্রের অস্তিত্বের ভেতরের অপুটিকে নিংড়ে নিচ্ছেন, পরিচালকের ভেতরে বাস-করা অপুর সঙ্গে সৌমিত্রের ভেতরে বাস-করা অপুটির আলাপন ঘটাচ্ছেন। যা ভারতীয় সিনেমাকে পৃথিবীর দর্শকের কাছে অনেকটাই এগিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন-গোয়েন্দা-ব্যর্থতা প্রকট হচ্ছে
‘অপুর সংসার’-এর সৌমিত্রের সঙ্গে কাজ করাকালীন সত্যজিৎবাবু বুঝতে পারেন যে, বাংলা সাহিত্যকে চলচ্চিত্রায়ণ করলে সৌমিত্রের থেকে ভাল প্রোটাগনিস্ট কেউ হতে পারে না, সেটা রবীন্দ্রনাথ থেকে তারাশঙ্কর কিংবা বিভূতি থেকে সুনীল— যাঁরই সাহিত্যকর্ম হোক না কেন।
চেতনায় রবীন্দ্রনাথ
সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবনের অনেকটা মূল্যবান সময় কাটিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। আর্ট কলেজের ছাত্র হয়ে। ঠিক সেই সময় থেকেই তিনি পাশ্চাত্য সংগীতের চর্চা শুরু করেন। নিজেই নিজের নোটেশন তৈরি করতে শেখেন। পাশ্চাত্য সংগীতের শরীর এবং আত্মার স্পর্শ পান। কিন্তু সত্যজিতের রবীন্দ্রবোধ ঠিক আর পাঁচজন বাঙালির মতো ছিল না, তিনি রবিঠাকুরকে নিয়ে বাঙালির এই আদেখ্লাপনা ঠিক কোনওদিনই মেনে নিতে পারতেন না। শান্তিনিকেতনের ছাত্র হয়েও তাঁর মনে হয়েছিল শান্তিনিকেতনের এই রাবীন্দ্রিক মহাপ্রশান্তি তাঁকে কিছু সৃষ্টি করতে কখনও তাড়িত করছে না। শান্তিনিকেতন থেকে বেরিয়ে বোলপুর স্টেশনের কাছে এলেও তাঁর চেতনা তাঁকে নাড়া দিত কিছু করতে। তাই রবীন্দ্রবলয় থেকে এই মহানগরের ক্যাকোফোনিতেই তিনি রবীন্দ্রনাথের নির্যাস খুঁজেছেন। পাশাপাশি সৌমিত্র যখন রবীন্দ্রপঠনে নিমগ্ন হলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিজের আত্মীয়তা খুঁজে পেলেন তখন বুঝলেন আপামর aবাঙালির কাছে রবিঠাকুর এক অনন্ত আশ্রয়।
আরও পড়ুন-কুণালের মানহানি মামলায় তলব ৩ সিপিএম নেতাকে
অমল এবং সন্দীপ
সত্যজিৎ রায় যখন ‘নষ্টনীড়’-এর মতন অমন জটিল বহুকৌণিক ছোটগল্পকে চলচ্চিত্রায়িত করবেন বলে ঠিক করলেন তখন তার প্রধান পুরুষ চরিত্র অমল হিসেবে সেই সৌমিত্রকে বেছে নিলেন এবং সৌমিত্রর মোর দ্যান অ্যান অ্যাক্টর ফ্যাক্টরটাই সত্যজিতের কাছে বেশি গুরুত্ব পেল। ততদিনে সত্যজিৎ-সৌমিত্রের সম্পর্ক অনেকটাই গভীর হয়েছে এবং সত্যজিৎ-সৌমিত্রের চেতনায় রাবীন্দ্রিক অস্তিত্বের আঁচ পেয়েছেন। একের পর এক আড্ডা-আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ-প্রসঙ্গ যতবার এসেছে সত্যজিৎ বুঝেছেন সৌমিত্রের রবীন্দ্রবোধ আর পাঁচজন বাঙালির মতো নয়। প্রায় অনেকটাই তার নিজের মতো। ন্যাকামি-বর্জিত, মার্জিত, পরিশীলিত। রবীন্দ্রনাথ দুজনেরই চেতনার ভেতরে এক অনন্ত অগ্নিকুণ্ড তৈরি করেছে। কিন্তু সে-আগুনে তাপের চেয়ে আলো অনেক বেশি। ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে ‘চারুলতা’ তৈরির ঠিক আগে মানিকবাবু বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন তাঁর অভিনেতাকে চরিত্র নিয়ে তেমন কসরত করতে হবে না। শুধু তাঁকে সেই যুগে নিয়ে যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যখন নষ্টনীড় লিখছেন তারও প্রায় ৫০ বছর আগের সেই বঙ্গদেশ। তাই সত্যজিৎ সৌমিত্রকে প্রথমেই একটি হোমটাস্ক দেন, বেশ কয়েকটি দৃশ্যে অমলকে লিখতে দেখা যাবে এবং সেটার ক্লোজআপ বা সিনেমার ভাষায় যাকে আমরা বলি ইনসার্ট লাগবে, তাই সত্যজিৎ সৌমিত্রকে বললেন তাঁর হাতের লেখাটা সেই সময়ের মতো হতে হবে এবং সেই সময়ের বাংলা হস্তাক্ষর এবং লিপির বেশ কিছু রেফারেন্স তিনি সৌমিত্রকে দিলেন। এবং সেগুলি দেখে দেখে পালকের কলম এবং দোয়াত দিয়ে তিনি সৌমিত্রকে লিখতে বললেন। এবং বলামাত্র সৌমিত্র ছবির শ্যুটিং শুরুর প্রায় বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই দিস্তা দিস্তা কাগজে ওইরকম হরফে বাংলা লেখা অভ্যাস শুরু করলেন এবং এত গভীর অধ্যবসায়ের সঙ্গে করলেন যে তাঁর হাতের লেখাই পরিবর্তন হয়ে গেল। ‘আমি সৌমিত্র’ ছবিতে সৌমিত্র বলেছেন, হাতের লেখা একটি মানুষের নিজস্বতা, তার আইডেন্টিটি। ‘চারুলতা’র শ্যুটিং তো বটেই তারপরেও ছবি শেষ হয়ে মুক্তি পাওয়ার বহুদিন পর পর্যন্ত সৌমিত্রর হাতের লেখা ওইরকমই থেকে যায়। বহু পরে আস্তে আস্তে তিনি নিজের হাতের লেখা ফিরে পেয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হল, সত্যজিৎ তো চাইলেই অন্য কারও হাতের লেখার ইনসার্ট নিয়ে ওই লেখার ক্লোজ-আপ শট নিতে পারতেন। যাকে সিনেমার ভাষায় আমরা বলি চিট করা। তিনি নিজেও ক্যালিগ্রাফি জানতেন। তাই নিজেও সেই শট দিয়ে দর্শককে চিট করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। আসলে তিনি চরিত্রের সঙ্গে দর্শকের সঙ্গে এবং নিজের সঙ্গে, সৌমিত্রর সঙ্গেও ওই তথাকথিত সিনেমাটিক চিট করতে চাননি। সত্যজিৎ বুঝে গেছিলেন সৌমিত্রকে ‘চারুলতা’র অমল চরিত্র হয়ে উঠতে এই অভ্যাসটি অনেকটাই সাহায্য করবে। তার মনন পঠন-পাঠনের সঙ্গে তার হাতের লেখাটা যদি ওই সময়ের মতো হয়ে ওঠে তাহলে সেটা একটা সম্পূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠবে। তার মধ্যে বিন্দুমাত্র নকলনবিশি থাকবে না। সেই চরিত্র হয়ে উঠবে অনবদ্য এবং ইউনিক। এক-একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের মধুর নিষ্ঠুরতাও বলা যায়। যে নিষ্ঠুরতার নির্যাস ‘চারুলতা’র মতন এমন কালজয়ী চলচ্চিত্র। এই ভাবেই সৌমিত্রকে ‘ঘরে বাইরে’র সন্দীপ বানাতেও সত্যজিৎ রায়কে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। কারণ ততদিনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন কালচার আইকন। সন্দীপের মতো এমন জটিল ডুয়েল চরিত্রকে সৌমিত্র তাঁর মেধা, মনন এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবন্ত করে তোলেন। সত্যজিতের এই সৌমিত্র-নির্বাচন এক ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্রের জন্ম দেয়। সত্যজিৎ সৌমিত্রের রবীন্দ্রযাপনকে নিজের কাজে পুরোপুরি নিংড়ে নিয়েছেন যতটুকু পেরেছেন। এমনকী রবীন্দ্রনাথের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্রেও সৌমিত্রের মঞ্চ-প্রতিভার একঝলক এসেছে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র অমন দীপ্ত উপস্থিতিতে।
আরও পড়ুন-আবাস যোজনা অডিটের সিদ্ধান্ত
ছাপোষা বাঙালি
রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যকে চলচ্চিত্রায়িত করতে গিয়েও সত্যজিৎ তাঁর প্রোটাগনিস্ট হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর প্রিয় ছাত্রটিকেই বেছে নিয়েছেন। তার কারণ সেই একটাই ‘মোর দ্যান অ্যান অ্যাক্টর ফ্যাক্টর’। বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত মনোযোগী এবং একনিষ্ঠ পাঠক সৌমিত্রকে সত্যজিৎ যখন আবার সাহিত্য-চরিত্রে কাজ করেন ‘অশনি সংকেত’ হোক বা ‘অভিযান’-এর মতো একদম বিপরীত মেরুর চরিত্রে, সেখানে সৌমিত্রের সুন্দর চেহারাটা অন্তরায় হতে পারত। কিন্তু পরিচালক এবং অভিনেতার গভীর নিষ্ঠায় যা অত্যন্ত রূঢ় বাস্তব হয়ে উঠেছে। সত্যজিৎ জানতেন সৌমিত্র থিয়েটারের একজন মেথড অ্যাক্টর। চরিত্রের প্রয়োজনে সে যে কোনও সময় নিজেকে ভাঙতে-গড়তে প্রস্তুত। শুধুমাত্র সাহিত্য এবং ভাষার প্রতি ভালবাসা নয়। সাহিত্যবোধের সঙ্গে জীবনবোধ এবং জীবনদর্শন, জীবনকে দেখা, মানুষকে দেখা মানুষের মুখের ভেতর আরও একটা মুখ আছে সেই মুখটাকে আঁচড়ে আঁচড়ে বার করে আনাটাই তো পরিচালক এবং অভিনেতার কাজ। যেটা সত্যজিৎ এবং সৌমিত্র অনন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেলেন আজীবন। এই দুজনেই রীতিমতো আন্তর্জাতিক তারকা। ইন্টেলেকচুয়াল আইকন হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের জীবনকে আজীবন ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালির মতোই যাপন করেছেন। দুজনকে প্রায়ই দেখা যেত নিউ মার্কেট, মির্জ গালিব স্ট্রিট কিংবা কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায়, বইয়ের দোকানের চারপাশে, কিংবা কফি হাউসে কখনও চাঙওয়ায়— যে কোনও কারও সঙ্গে বসে চাওমিন খেতে দেখা যেত দুজনকে। সৌমিত্রকে আজ দেখা গেল কোনও দামি রেস্তরাঁয় উত্তমকুমারের সঙ্গে স্কচ পান করতে তো পরের দিন মিছিলে সবার সঙ্গে হাঁটতে। যাপনে এমন নমনীয়তাই স্বদেশি বুদ্ধিজীবী সন্দীপ থেকে অশিক্ষিত ‘অভিযান’-এর ড্রাইভার চরিত্রের সঙ্গে সুবিচার করতে পারে। ‘অভিযান’ প্রসঙ্গে ‘আমি সৌমিত্র’ ছবিতেই আমরা জানতে পারি প্রথমে চরিত্রটা উত্তমকুমারকে শোনানো হয়। কিন্তু উনি মহানায়কের ইমেজ ভেঙে এই চরিত্র করতে রাজি হননি। তারাশঙ্করের লেখা, সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য-পরিচালনা তবু উত্তমকুমার সাহস পাননি। অবশেষে এই সৌমিত্রই ভরসা। ‘অভিযান’-এর ট্রেনের সঙ্গে জিপ গাড়ির ওই দৃশ্যকে যতটা সম্ভব রিয়েলস্টিক করা যায়, সেই চেষ্টায় যখন সত্যজিৎ মরিয়া, পরিচালকের অমন প্যাশন দেখে সৌমিত্র জিপটা ড্রাইভ করতে করতে ট্রেনের খুব কাছে নিয়ে চলে আসেন। এমন কাছে আসেন যে সাংঘাতিক একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। পরে সত্যজিতের বকুনিও খেতে হয় তাঁকে। শিক্ষক-পরিচালক তাঁকে কতটা স্নেহ করেন। পরিচালক-অভিনেতার এমন স্নেহের সমীকরণ না হলে ‘অভিযান’ বা ‘অশনিসংকেত’-এর মতন মাস্টারপিস হয়ে ওঠে না।
আরও পড়ুন-কাল রাজ্যে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা, কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে
বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতে তখন সৌমিত্র রীতিমতো সুপার স্টার। ‘অশনিসংকেত’-এর সেই অর্ধশিক্ষিত প্রাথমিক শিক্ষকের চরিত্র করতে গিয়ে সৌমিত্র ইউনিটের সবার সঙ্গে অবলীলায় মিশে যেতেন চরিত্রের প্রয়োজনে। মানিকবাবু সেটা সৌমিত্রকে প্রশ্রয় দিতেন।
‘কাপুরুষ-মহাপুরুষ’-এর পরিচালক যেন সৌমিত্রকে সৌমিত্রের এক মধ্যবিত্ত সত্তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই দুটি সূত্রে চরিত্রায়ণ এতটাই রিয়েল যে পর্দা থেকে যেন চরিত্রের ঘাম-মাংসের গন্ধ পাওয়া যায়। বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার গোল-গাল থলথলে চিত্রনাট্য অভিনয়ের নিরিখে এই দুটো ছবি আক্ষরিক অর্থে এক সিনেমা-বিপ্লব।
আরও পড়ুন-দোমহনিতে গৃহশিক্ষকের বাড়ি পাত পেড়ে মাছ-ভাত খেলেন অভিষেক
টিপিক্যাল বাঙালি
সত্যজিৎ যখন কিশোর-শিশুদের জন্য সিনেমায় কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন তখনও তাঁর নিজের সাহিত্য সৃষ্টি ফেলুদার চলচ্চিত্রায়ণ করতে তাঁর প্রিয় অভিনেতার উপরই ভরসা রাখেন। শার্লক হোমসের এতটাই ভক্ত যে হোমসের অনুপ্রেরণায় সত্যজিৎ এক গোয়েন্দা অমনিবাস রচনা করে ফেলেন। যা বাংলা কিশোর সাহিত্যে এক অমূল্য রতন হয়ে যায়। গোয়েন্দা গল্পের ভক্ত সৌমিত্রের ভেতর একটি গোয়েন্দা বাস করে। তাঁকে ফেলুদা করে নিয়ে আসেন সত্যজিৎ। বাংলা সিনেমায়। যা সাহিত্যের মতন সিনেমাতেও একটি কাল্ট চরিত্র হয়ে ওঠে। সৌমিত্র-সত্যজিৎ দুজনেই কিশোরদের জন্য বাংলা সিনেমায় কিছু করতে চেয়েছিলেন খুব আন্তরিকভাবে। কারণ ঠিক সেই সময় সৌমিত্রবাবুর পুত্র ও কন্যা শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখছে। তাই তাদের জন্য কিছু করে যাওয়ার তাগিদ ছিল সৌমিত্র ভেতরে। চিন্তাশীল, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, হাতে চারমিনার, কপালে ভাঁজ— টিপিক্যাল এই বাঙালি গোয়েন্দা ফেলুদা চরিত্রে সত্যজিতের সৌমিত্র ছাড়া কাউকে ভাবা সম্ভব ছিল না।
আরও পড়ুন-দোমহনিতে গৃহশিক্ষকের বাড়ি পাত পেড়ে মাছ-ভাত খেলেন অভিষেক
অবশেষে আসা যাক ‘গণশত্রু’ এবং ‘শাখা প্রশাখা’ প্রসঙ্গে। ‘গণশত্রু’র প্রতিবাদী ডাক্তার তিনিও যেন epitomized সৌমিত্র।
‘শাখা প্রশাখা’র পাগলাটে প্রশান্ত চরিত্রটি সত্যজিতের লেখনী আর সৌমিত্রের মায়া-অভিনয়ে এই অসময়ের এক আন্টিথিসিস হয়ে দাঁড়ায়। সৌমিত্র তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে চিরকালই প্রশান্তর মতোই খুব প্রকটভাবে প্রতিবাদী ছিলেন। যতবার ওঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আড্ডা হয়েছে ততবারই রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিৎ-শিশিরবাবু ছাড়া যে-প্রসঙ্গে চলে আসতেন তা হল এই অসময়ের গ্লানি। সমস্ত সামাজিক রাজনৈতিক ভণ্ডামি নিয়ে সৌমিত্র ছিলেন সোচ্চার। ওঁর চারদিকের মিথ্যাচার, দুর্নীতি এসব নিয়ে অকপটে সবার সামনে তিনি নিজের বক্তব্য রাখতেন। একজন কবির মতোই উনি আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘শাখা প্রশাখা’র প্রশান্ত চরিত্রটির সাবটেক্ট নিয়ে বলতে গিয়ে সত্যজিৎ সৌমিত্রেরই প্রিয় বন্ধু, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি লাইন বলেছিলেন, ‘এখানে এসে দেখি সবাই সুখী/ শুধু আমারই অসুখ’।