বৃষ্টির শব্দ
পাঁচ বছরের একটি ছেলে। একবুক কৌতূহল নিয়ে প্রথমবার সিনেমা হলে। মায়ের সঙ্গে। অরোরা সিনেমা হলের বড় পর্দায় ফুটে উঠল সাদাকালো চলচ্চিত্র। তবে কোনও শব্দ নেই। নির্বাক ছবি। একটি দৃশ্যে দেখা গেল, বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে চলে যাচ্ছেন নায়িকা। তখনই শোনা গেল সিনেমা হলের টিনের ছাদে বৃষ্টির শব্দ। বাইরে হচ্ছিল তুমুল বৃষ্টি। পাঁচ বছরের দর্শকটির সেই সময় মনে হয়, সিনেমার জন্য শব্দ অপরিহার্য। শব্দ ছাড়া চলচ্চিত্র হতে পারে না। ওইটুকু বয়সে প্রথম সিনেমা দেখেই যাঁর এই উপলব্ধি হয়েছিল, তিনি আর কেউ নন, দেশের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন।
আরও পড়ুন-নববর্ষের সংকল্প
চ্যাপলিনের ভক্ত
চলচ্চিত্র পরিচালক হবেন, একটা সময় পর্যন্ত ভাবেননি। বরং নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন অন্যান্য কাজে। সাংবাদিকতা করেছেন। হয়েছিলেন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। থিয়েটার মঞ্চের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল। নাটকের পাশাপাশি দেখতেন সিনেমা। অন্ধ ভক্ত ছিলেন চার্লি চ্যাপলিনের। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন বই ‘চার্লি চ্যাপলিন’। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। তাঁর প্রথম ছবি মুক্তির দু’ বছর আগে। সত্যজিৎ রায় এঁকেছিলেন সেই বইয়ের প্রচ্ছদ। এরপর মৃণাল সেন হাত দেন ছবি তৈরির কাজে। ১৯৫৫-য় মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ছবি ‘রাতভোর’। দ্বিতীয় ছবি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রযোজনায় ও সংগীত পরিচালনায় ‘নীল আকাশের নিচে’ মৃণাল সেনকে পরিচিতি দেয়। ওই ছবিতে ছিল গল্প, গান। ফলে তাঁকে কিছুটা কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন-আজ আইএসসি ও আইসিএসই পরীক্ষার ফল
দীর্ঘ ইতিহাস
কিছুটা সময় যেতেই খুঁজে নেন নিজস্ব পথ। হাত দেন অন্য ধারার ছবিতে। তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকে পান আন্তর্জাতিক পরিচিতি। ১৯৬৯ সালে তাঁর পরিচালিত ছবি ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অন্য অনেক পরিচালকের মতো পর্দায় শুধু গল্প বলেননি, করেননি সুন্দরের সাধনা। ভেঙেছিলেন ছক। তৈরি করেছিলেন একের পর এক বাস্তবধর্মী ছবি। অনেকেই মনে করেন, মৃণাল সেন মানেই একটা কমিটমেন্ট। স্ট্রেট লাইনে ভাবা। সময়ের উন্মত্ততাকে ধরেছিলেন ক্যানভাসে। তাঁর চলচ্চিত্রে দারিদ্রই যেন ভিলেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন নাগরিক পরিচালক। তার পিছনে ছিল এক দীর্ঘ ইতিহাস।
আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গলের সম্মানে আপ্লুত সলমন
এক ক্লান্ত যুবক
১৯২৩-র ১৪ মে, পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে জন্ম। ১৯৪০-এ এসেছিলেন কলকাতায়। তখন তিনি ১৭। দেখেছিলেন মহানগরের ভয়াবহ রূপ। কেমন ছিল সেই রূপ? একটি সাক্ষাৎকারে মৃণাল সেন জানিয়েছেন, ‘ছোট শহরগুলো থেকে চাকরি ও আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন মানুষ এসে কলকাতায় ভিড় করছে। তারা কেউ ফিরে যেতে পারছে না। বৃদ্ধ-শিশু বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ সবাই মিলে গাদাগাদি অবস্থা। শ্বাস নিতে পারছে না শহর কলকাতা। শিশুদের মুখগুলো কেমন ভীতিকর পাণ্ডুর নিস্তব্ধ। চোখের দিকে তাকালেই আঁতকে উঠতে হয়। আমার পকেট শূন্য, তাদের দিকে তাকানো যায় না। সবাই মানুষ, কোনও ধর্ম নেই। কে হিন্দু, কে মুসলমান চেনার দরকার নেই। রাজনৈতিক আন্দোলনের বিপক্ষে এ যেন এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়, যা আমার সম্পূর্ণ অচেনা। ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাড়ির সামনের আবর্জনার মধ্য থেকে মানুষ ও কুকুর খাবার খুঁজতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখে বাড়িতে ফিরে যেতে চাইলাম।’
আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গলের সম্মানে আপ্লুত সলমন
তখন চলে গিয়েছিলেন ফরিদপুরে। তবে আবার ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। নিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা। এই শহর হয়ে উঠেছিল তাঁর বড় প্রিয়। শহরের অতীত স্মৃতি ভোলেননি কোনওদিন।
কলকাতা ট্রিলজি
বলা হয়, কলকাতা এবং মৃণাল সেন যেন অবিচ্ছেদ্য। নগরজীবন অদ্ভুতভাবে ধরা দিয়েছিল তাঁর নানা ছবিতে। ফুটে উঠেছিল ভাল দিক, মন্দ দিক। চারের দশক থেকে মহানগর তাঁকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, ভাবিয়েছে। তিনি বাধ্য হয়েছিলেন কলকাতা-কেন্দ্রিক এক ছবি থেকে অন্য ছবিতে যেতে। তাঁর ছবি যেন সময়ের দলিল। মহানগরের দলিল। এই প্রসঙ্গে উঠে আসে তিনটি ছবির নাম, ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’ এবং ‘পদাতিক’। তিনটি ছবি পরিচিত মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ট্রিলজি’ নামে।
আরও পড়ুন-বাংলাতেই বিজেপি বিদায়ের খুঁটিপুজো, ‘২৪-এ দেশ থেকে
আলো এবং কালো
কী কী দেখিয়েছেন? নাগরিক জীবন, বস্তি থেকে রাজপথ, বিপ্লব, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ঔপনিবেশিকতা, সন্ত্রাসবাদ, বেকারত্ব, সামাজিক প্রতারণা, নিপীড়ন, ভণ্ডামি ইত্যাদি। কলকাতা এসেছে তাঁর আরও কিছু ছবিতে। যেমন ‘মহাপৃথিবী’। ছবিটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটা বিশেষ সময়ের শহরের ছবি। বিশেষ সময়, উত্তাল সময়। যখন মহানগরের বাতাসে বারুদের গন্ধ, গলির মুখে যুবকের রক্তাক্ত দেহ। সমস্তকিছুর কেন্দ্রে সেই কলকাতা। আরও একটি ছবি ‘চালচিত্র’। ঘটনার কেন্দ্রে কলকাতা শহরের একটি বাড়ি। বারো ঘর এক উঠোন। ঘটনার ঘনঘটা। তবে শুধুমাত্র বাড়ির মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি ছবিটি। ঘুরেফিরে এসেছে শহরের রাজপথ, গলি। ক্যামেরা ছুটেছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। ব্যাগ কাঁধে দৌড়নো যুবকের পিছনে। বাড়ির এবং বাড়ির বাইরের মানুষগুলোর প্রকৃত ছবি ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে। আলোর পাশাপাশি ধরা পড়ে কালো।
আরও পড়ুন-জয়ে ফিরতে বিরাটদের সামনে এখন চাহাল-কাঁটা
বিনোদনের জন্য নয়
সিনেমা বিনোদনের জন্য নয়। ছবির মাধ্যমেও শিক্ষিত করা যায় মানুষকে। মনে করতেন মৃণাল সেন। ছিলেন সংলাপের জাদুকর। ক্যামেরার লেন্সে দুনিয়াদারিতে এক নিপুণ পরিচালক। বলেছেন, ‘‘আমি অন্যদের মতো কাহিনিনির্ভর ছবি তৈরি করিনি। কলকাতার ওপরে তো কয়েকটি সিনেমা বানিয়েছি। বাস্তবতার বাইরে আমি যাইনি। ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার আমি নই। আমার সিনেমা জ্ঞান ও প্রমাণ দিয়ে বুঝতে হবে।”
তারকাসমৃদ্ধ
মৃণাল সেনের প্রথম ছবি ‘রাতভোর’-এ নায়ক ছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ও। দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নিচে’। মূল চরিত্রে ছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ ছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। ‘ভুবন সোম’ বানিয়েছেন উৎপল দত্তকে নিয়ে। ওই ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন অমিতাভ বচ্চনের ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর। ‘আকাশকুসুম’-এ ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে রঞ্জিত মল্লিক। এটাই ছিল অভিনেতার প্রথম ছবি। ‘পদাতিক’-এ নিয়েছিলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় এবং সিমি গারেওয়ালকে। তাঁর ‘মৃগয়া’ ছবির মাধ্যমে অভিনয় জগতে পা রাখেন মিঠুন চক্রবর্তী, মমতা শঙ্কর। ‘চালচিত্র’ ছিল অঞ্জন দত্তর প্রথম ছবি। স্মিতা পাতিল ছিলেন ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিতে। ‘খণ্ডহর’-এ শাবানা আজমি, নাসিরউদ্দিন শাহ। ‘অন্তরীণ’-এ ছিলেন ডিমপল কাপাডিয়া। ‘মহাপৃথিবী’ ছবিতে অভিনয় করেছেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, তারকাসমৃদ্ধ ছিল তাঁর প্রায় সমস্ত বাংলা এবং হিন্দি ছবি। তবে তিনি কিন্তু তারকা-নির্ভর ছিলেন না। বরং তাঁর হাতেই জন্ম হয়েছে বহু তারকার। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত তারকারা তাঁর ছবিতে হয়ে উঠেছিলেন এক-একটি চরিত্র। মিটিয়েছিলেন গল্প এবং চিত্রনাট্যের দাবি।
আরও পড়ুন-নিয়োগ নিয়ে আদালত তথ্য চাইলে অবশ্যই দেব
পুরস্কার ও সম্মাননা
বাংলা-হিন্দির পাশাপাশি ওড়িয়া এবং তেলুগু ভাষায় ছবি তৈরি করেছেন মৃণাল সেন। তাঁর ছবিগুলো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে। ভারত এবং ভারতের বাইরের বহু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তিনি ইন্টারন্যাশন্যাল ফেডারেশন অফ দি ফিল্ম সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে পেয়েছিলেন পদ্মভূষণ। ২০০৫-এ পান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর চলে যান না-ফেরার দেশে। বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।
সবার থেকে আলাদা
চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘‘মৃণাল সেন আমাদের গুরুর মতো ছিলেন। অনেক কিছু শিখিয়ে গেছেন। দিয়েছেন অনুপ্রেরণা। কখনও আপস করেননি। তাঁর কাজ সংরক্ষণ করা হোক।’’
আরও পড়ুন-হরিনাম সংকীর্তনে খোল বাজাতে গিয়ে খুন হয়েছিলেন দলীয় কর্মী, সুবিচারের আশ্বাস অভিষেকের
চলচ্চিত্র পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, ‘‘আমার চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার পেছনে যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মৃণাল সেন। ১৯৮২ সালে ওঁর ‘খারিজ’ ছবিটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। পালান নামের একটি ছেলের মৃত্যু ঘিরে তৈরি হয়েছিল ছবিটা। তখন নিজেকে আইডেন্টিফাই করেছিলাম ওই চরিত্রের সঙ্গে। ছোট্ট একটা ঘটনা পূর্ণাঙ্গ ছবি হয়ে উঠেছিল পরিচালকের নাগরিক ভাবনার ফলে। আজ ১৪ মে, মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষ। ওঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে আমি একটা ছবি বানিয়েছি। নাম ‘পালান’। ‘খারিজ’ ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই মূলত এই ছবিতে আছেন। অঞ্জন দত্ত, মমতা শঙ্কর, শ্রীলা মজুমদার, দেবপ্রতিম প্রমুখ। সঙ্গে যিশু সেনগুপ্ত, পাওলি দাম। ওই দম্পতি এবং ওই চরিত্রগুলোকে নিয়েই আমি বলার চেষ্টা করছি আজকের গল্প। ঘুলঘুলির অভাবে দম আটকে ওইভাবে বাড়ির একটা কাজের ছেলে মারা যেতে পারে, ভাবাই যায় না। সেই পরিস্থিতি কিন্তু আজও আছে। যারা বাড়িতে কাজ করে তাদের এখনও সোফা বা ডাইনিং টেবলে বসতে দেওয়া হয় না। এগিয়ে দেওয়া হয় মোড়া বা টুল। অর্থাৎ অলংকৃত ফার্নিচারের বাইরে সাধারণ ফার্নিচার। অথচ আমরা হিউম্যান রাইটসের কথা বলি। এইসব কারণে ‘খারিজ’ আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। মৃণাল সেনকে দাদা বলতাম। কথা বলার সময় কোনওদিনই বয়সটাকে সামনে আসতে দেননি। খুব আধুনিক মনস্ক মনে হয়েছে। তাঁর সমসাময়িক যে সমস্ত পরিচালক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশ্বসিনেমার নিরিখে ছিলেন আধুনিক। নাহলে ‘কলকাতা ৭১’, ‘কোরাস’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘একদিন আচানক’, ‘চালচিত্র’ বানানো যায় না। ওইরকম ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলতে পারেননি ওঁর সময়ের কোনও পরিচালক। পর্দার মধ্যে এনেছেন স্লোগান। এটা একটা অন্য ঘরানা। আমাদের রোজকার জীবনযাত্রা যেরকম, মৃণালদার ছবি সেইরকম। যখন কিছু পরিচালক বনেদি, সম্ভ্রান্ত পরিবার অথবা মধ্যবিত্তের গোছানো পরিবার সেলিব্রেট করতেন, তখন মৃণালদা তুলে ধরতেন শ্যাওলা পড়া দেওয়াল, ভাঙা দরজা, পুরনো বাড়ি-সহ কলকাতার আর একটা দিক। ক্ষুদ্রকে বৃহৎ করে দেখিয়েছেন। এই জন্য তিনি আমার কাছে সবার থেকে আলাদা।”