কর্নাটকে বিজেপির (Karnataka BJP) হার, মানুন না-মানুন, মোদিজির হার। জিতলে যে জয় মোদিজির জয় হত, সেই যুক্তিতে এই পরাজয় মোদিজির পরাজয়, তা কেবল নয়। আরও নানাবিধ কারণে এটাই সত্য, ভয়ংকর রকমের সত্য।
কারণগুলো এক এক করে দেখে নেওয়া যাক।
এক, নির্বাচন ঘোষণার আগে থেকে প্রচার শেষ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি বারবার কর্নাটকে গিয়েছেন। শেষ এক সপ্তাহে ২১টা জনসভা করেছেন, রোড শো করেছেন ৪টি। পোস্টার, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, কাট আউটে মোদিজির মুখ জ্বল জ্বল করেছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃবর্গ প্রার্থীর উপস্থিতিতেই মোদিজির নামে ভোট চেয়েছেন। জনতাকে বলেছেন, তাঁরা যেন প্রতিটা ভোট মোদিজিকে দেন।
তেমনটা হয়নি। বাসবরাজ বোম্মাইয়ের হতাশায় সেটা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিষাদ খিন্ন কণ্ঠে বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মোদি ও বিজেপি কর্মীদের প্রবল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা দাগ কাটতে পারিনি।’’
তবুও বলব, এই হার মোদিজির হার নয়?
দুই, শেষ মুহূর্তে বিজেপি বুঝতে পেরেছিল কর্নাটকে তাদের হার অবধারিত। তাই, শেষ মুহূর্তে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে তারা মোদিজির বদলে জে পি নাড্ডার ছবি দিয়ে প্রচার করেছিল।
তিন, এর আগে কর্নাটকে (Karnataka BJP) ভোটের প্রচারে কোনও প্রধানমন্ত্রী এতবার প্রচারে আসেননি। এবার প্রধানমন্ত্রী অন্তত কুড়িবার কর্নাটকে গিয়েছেন। সুতরাং, এই পরাজয় অবশ্যই তাঁর হার।
চার, এই ভোটের প্রচারে মোদিকে প্রায় ভগবানের পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছিল। আর এই কাজটি করেছিলেন বিজেপি-র নাম্বার টু, অমিত শাহ। তিনি বলেছেন, প্রকাশ্যে বলেছেন, মোদিকে ভোট না দিলে কর্নাটকবাসী তাঁর আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন। কেন? মোদিজি ভগবান বলেই না তাঁর আশীর্বাদ পাওয়ার এবং বঞ্চিত হওয়ার প্রসঙ্গ। ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপ্তি মানে সমৃদ্ধশালী হওয়া আর আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হওয়া মানে ভাগ্যহীন সাব্যস্ত হওয়া। সেজন্য কর্নাটকবাসী বিজেপিকে ভোট দেননি মানে এই রাজ্য মোদিজির আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে, ফলে কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্প কর্নাটকে আসবে না।
অর্থাৎ, কর্নাটকের ভোটকে গণভোটে পরিণত করেছিল বিজেপি-ই। এখন সেই ভোটে হেরে যাওয়া মানে গণভোটে মোদির পরাজয়। মোদির আশীর্বাদ পেতে আগ্রহ দেখায়নি কর্নাটকবাসী।
পাঁচ, কর্নাটক দেশের তৃতীয় বৃহৎ করদাতা রাজ্য। তার আর্থিক অবস্থা মোটেও উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের মতো নয়। সেই রাজ্য যখন এত চেষ্টা সত্ত্বেও মোদিজির থেকে মুখ ফিরিয়েছে, তার মানে দেশের গরিব ও মধ্যবিত্ত উভয় শ্রেণির মানুষই চাইছেন মোদিজির হার। মোদিজিকে হারানোর অ্যাজেন্ডাটা তার কেবল দরিদ্র, মেহনতি শ্রেণির মধ্যে সীমায়িত নয়, এটা বোঝা দরকার।
কর্নাটকে হার আধিপত্যবাদের হার।
মোদিজির অসহিষ্ণুতার, ঔদ্ধত্যের পরাজয়
আর ক্রোনি ক্যাপিটালিজম এই জঞ্জাল পার্টির সঙ্গে কতটা জড়িয়ে, সেটা বোঝা যায় মোদিজির ক্রোনি ক্যাপিটালদের বাঁচানোর চেষ্টা দেখলে।
ভারতের মূলধন বাজারের মুখ্য নিয়ন্ত্রক সেবি মোদি ঘনিষ্ঠ শিল্পোদ্যোগী গোষ্ঠীর প্রতি এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট যে তাদের সম্পর্কে লিখিত আকারে মিথ্যা তদন্ত রিপোর্ট সংসদে জমা করতে ইতস্তত করেনি। তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে উত্থিত একটি প্রশ্নের উত্তরে সেবির তরফে জানানো হয়েছিল, তারা মোদিজি ঘনিষ্ঠ ও শিল্পোদ্যোগী গ্রুপটির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। কিন্তু তারপর তারা শীর্ষ আদালতে একটি হলফনামা দাখিল করে জানায়, মোদিজির আশীর্বাদপ্রাপ্ত ওই শিল্প সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত তারা করছে না।
এরপর হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে যখন ওই শিল্পগোষ্ঠী অভিযুক্ত হল, তখন, এই মে মাসে, সেবির এক ২২ বছর বর্ষীয় অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দাখিল করে জানাচ্ছে, আদালতের নির্দেশে তারা যে তদন্ত শুরু করেছে, তা শেষ করার জন্য তাদের আরও মাস দুয়েক দেওয়া হোক।
অথচ এই সেবির তরফে আগে বলা হয়েছিল ২০১৬ থেকে তারা ওই শিল্পগোষ্ঠীর কাজকর্ম তদন্ত করছে।
মোদি ঘনিষ্ঠ শিল্প সংস্থাকে বাঁচানোর জন্য সেবির এহেন মিথ্যাচার।
এসবও কিন্তু বাঁচাতে পারেনি বিজেপিকে কর্নাটকে।
মিথ্যাচারেরও হার হয়েছে কর্নাটকে।
মোদিজির তো বটেই।
আরও পড়ুন: কুর্মিদের সঙ্গে বৈঠক, দাবি যুক্তিপূর্ণ মানলেন মুখ্যমন্ত্রী