প্রবাদ আছে, ‘যম জামাই ভাগনা তিন নয় আপনা’। তবু বাংলার ঘরে ঘরে জামাই-বন্দনার খামতি নেই। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে হয় জামাই-পরব বা জামাইষষ্ঠী। এটা কিন্তু কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। বাংলার লোকজ জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা একটি লোকাচার। জামাই-মেয়েকে একসঙ্গে পাওয়াই আসল উপলক্ষ। এই লোকাচার অতীতেও ছিল। আজও আছে। লিখলেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দাস
আদুরে জামাই বাবাজির দিব্যি ভুঁড়ি রয়েছে। গাঁজা খেয়ে, নেশা করে চোখ লাল করে পড়ে থাকেন। কেজো জামাইয়ের হাতে যে শুধু সুরা থাকে তাই নয়, কখনও বা আবার বিষ পাত্র হাতে তুলে নেয়। সময় সুযোগ পেলে জমিতে আবার চাষের কাজও করেন। বাঙালির টপ রেটেড এই জামাইয়ের ছবি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন যামিনী রায়, নন্দলাল বসু এবং কালীঘাটের পট শিল্পীরা।
আরও পড়ুন-অসাধারণ বর্ণনার পাশাপাশি সংলাপ রচনাতেও পারদর্শী
কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝাল ঝোল রসা
মঙ্গল প্রিয় বাঙালির কাব্যে এ জামাই পাহাড়ে তপস্যারত যোগী বা আদি শক্তি নয়, বরং আপন ঘরের আদুরে জামাই। যে নন-ভেজ, যাকে নিয়ে অনেক মজা করা যায়। ঠিক বাড়ির ছেলের মতো। কুকথায় সে পঞ্চমুখ। তার কণ্ঠ ভরা বিষ। কোনও গুণ নেই তার, কপালে আগুন। বাঙালির এই মডেল জামাইয়ের খিদে পেলে অন্নদাকে রাঁধতে বসান ভারতচন্দ্র। মেনুতে রাখেন কালিয়া, দোলমা সঙ্গে শিককাবাব।
‘‘কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝাল ঝোল রসা। কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সমসা।। অন্ন মাংস সীকভাজা কাবাব করিয়া।
রান্ধিলেন মুড়া আগে মসলা পুরিয়া।।”— হাজার হোক ঘরের জামাই বলে কথা। তাকে কি আর যা তা খেতে দেওয়া যায়? রায়গুণাকর আবার জামাই আপ্যায়ন করেছেন। বলছেন— বুড়ো শিব তোমার সাপটি খেলাও। বুড়ো শিব জটা থেকে জল বের করো—
আরও পড়ুন-সাত বছরের মাথায় ফের কেন নোট বাতিল
কেহ বলে ওই এল শিব বুড়া কাপ।
কেহ বলে বুড়াটি খেলাও দেখি সাপ।।
কেহ বলে জটা হৈতে বার কর জল।
কেহ বলে জ্বাল দেখি কপালে অনল।।
কেহ বলে ভাল করি শিঙ্গাটি বাজাও।
কেহ বলে ডমরু বাজায়ে গীত গাও।।
কেহ বলে নাচ দেখি গাল বাজাইয়া।
ছাই মাটি কেহ গায় দেয় ফেলাই।।
কেহ আনি দেয় ধুতুরার ফুল ফল।
কেহ দেয় ভাঙ্গ পোস্ত আফিঙ্গ গরল।।
আর আর দিন তাহে হাসেন গোসাঁই।
ও দিন ওদন বিনা ভাল লাগে নাই।।
— শিব এখানে দূরের কোনও সাধক নন। দেবতা নন। বাংলার ঘরের জামাই। আপনজন। সিনেমায়, গল্প-কথায়, পৌরাণিক আখ্যানের হাত ধরে ঘরে ঘরে প্রবেশ করেছেন তিনি। শিবের নায়কপ্রতিম ইমেজের বাইরে গিয়ে এখানে যেন তিনি হয়ে উঠেছেন ঘরের জামাই।
তবে বাংলায় শিবের আসা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সিনেমায়, গল্প-কথায়, পৌরাণিক আখ্যানের হাত ধরে ঘরে ঘরে প্রবেশ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন-পরা যাবে না জিন্স, টিশার্ট, লেগিংস: অসমে ফতোয়া জারি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের
‘চাষা শিব’ – বাঙালির জামাই দেবতা
বাণগড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, তিনি এসেছিলেন সম্ভবত মৌর্য ও সুঙ্গ যুগে। পরে গুপ্ত আমলে ও বিশেষ করে শৈব উপাসক রাজা শশাঙ্কের আমলে বাংলায় শিবের কদর বাড়তে থাকে। বাংলার ঘরের শিবের যাতায়াত শুরু হয় মঙ্গলকাব্য ও লোক-সংস্কৃতির হাত ধরে। দীনেশচন্দ্র নিয়ে এলেন চাষাভুসা শিব জামাইকে, “যখন বৌদ্ধ-যুগের সংসার-বিরাগের ভূত আমাদের ঘাড় হইতে নামিল, তখন দীর্ঘ যুগের কঠোর বৈরাগ্যের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ঘর-গৃহস্থালীর খুঁটিনাটি লইয়া ধর্ম্মপুস্তক রচনা হইতে লাগিল। প্রথম উপাস্যস্থল শিব ঠাকুর, তিনি চাষাদের হাতে পড়িয়া চাষা হইলেন।” লক্ষ্মণ সেন ও তাঁর পরবর্তী আমলের শিবায়নগুলিতে এভাবেই উঠে এসেছেন ‘চাষা শিব’। তিনি এখানে মাটিতে চাষ করছেন, ত্রিশূল বন্ধক রেখে লাঙল কিনছেন, তারপর ফসলও বুনছেন। সবদিক দিয়েই একেবারে ঘরের মানুষ হয়ে উঠছেন এক জামাই-দেবতা।
আরও পড়ুন-২০০০ টাকার নোটবন্দির পরই সরকারি অফিস থেকে উদ্ধার কয়েক কোটি!
কষ্টের কামাই নিয়ে যাবে জামাই
আগে বলত— ‘যম জামাই ভাগনা তিন নয় আপনা’। আর এখন বলে ‘কষ্টের কামাই নিয়ে যাবে জামাই’। প্রবাদে যা-ই বলুক, বাংলার ঘরে ঘরে জামাই-বন্দনার কোনও খামতি নেই। আগেও ছিল না। তবে ধরন পাল্টেছে। ভরণও বদলেছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে এই জামাই পরব। ঘরের মেয়েকে নিয়ে জামাইরা হাজির হন শ্বশুরবাড়িতে। জ্যৈষ্ঠের এই ভ্যাপসা গরমে আয়োজনে থাকে শালির রসিকতা আর শ্বশুরের পকেট কাটা। নতুন হাতপাখার হাওয়া, পাঁচ রকমের ফল, মিষ্টি, ১০৮টি দূর্বা— এই দিয়ে মাতৃসমা শাশুড়ি মঙ্গল কামনা করেন তাঁর পুত্রসম জামাইকে। পেটপুজোতে বাঙালিদের আবার নানান বাহারি আহারি মেনু— ইলিশ মাছ, খাসির মাংস, মিষ্টি দই— এগুলো তো থাকবেই।
জামাইষষ্ঠী কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। এই বাংলার লোকজ জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা একটি লোকাচার। বাংলা জুড়ে একটা সময় মেয়েরা বিভিন্ন ব্রত পালন করত। তার মধ্যে একটি অরণ্যষষ্ঠী। এই ব্রত রাখা হয় সন্তানের মঙ্গল কামনায়। সন্তানের মা তো বটেই, সন্তানবতী মহিলারাও এই ব্রত পালন করতেন। ষষ্ঠী হলেন প্রসূতি এবং শিশুর রক্ষায়ত্রী।
আরও পড়ুন-পরা যাবে না জিন্স, টিশার্ট, লেগিংস: অসমে ফতোয়া জারি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের
হরপ্পাতেও জামাইষষ্ঠী
জামাইষষ্ঠী খাঁটি বাঙালি উৎসব হলেও, মা ষষ্ঠী কিন্তু কেবলমাত্র বাঙালির নিজস্ব দেবী নন। বায়ু পুরাণে তাঁকে ৪৯টি দেবীর অন্যতম দেবী বলা হয়েছে। যাজ্ঞবল্কস্মৃতি অনুসারে শিব এবং উমার সন্তান স্কন্ধের পালিকা মা হলেন ষষ্ঠী। পদ্মপুরাণে তিনিই আবার স্কন্ধের স্ত্রী। হরপ্পাতেও প্রাগৈতিহাসিক যুগে এমন দেবী মূর্তি পাওয়া গেছে যা দেখে মনে করা হয়েছিল মা ষষ্ঠীর মতো কোনও দেবীর অস্তিত্ব ছিল। এটা সত্যি হলে তা বিস্ময় তো বটেই, এটা ধরে নেওয়া অন্যায় হবে না সেই অনার্য দেবী ষষ্ঠী আস্তে আস্তে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্য দেবীর সঙ্গে এক হয়ে যান। জামাইষষ্ঠীর আচার এবং জনপ্রিয়তা ওপার বাংলার মানুষের মধ্যে একটু বেশি। তবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বাঙালি পরিবারেও এর প্রচলন রয়েছে। মায়ের বাহন বিড়াল কোলে এক বা একাধিক শিশু। শুধু বাংলায় নয়, বিহার এবং ওড়িশাতেও এই পুজোর প্রচলন আছে। বিহারের শিশু জন্মের ষষ্ঠ দিনে ছোঠি মাথার যে পুজো করা হয় সেই মাতাই হলেন ষষ্ঠী। ওড়িশাতে ভবিষ্যতের সন্তান জন্মের ষষ্ঠ এবং একুশতম দিনে ষষ্ঠী পুজো করা হয়।
আরও পড়ুন-সম্মুখসমরে কেজরি–কেন্দ্র, অধ্যাদেশের পর এবার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হল দুই পক্ষ
বিড়াল বলে মাছ খাব না
লোকগাথা অনুসারে এক বধূ নিজে খাবার চুরি করে খেয়ে প্রতিদিন পোষা বিড়ালের নামে দোষ দিত। সেই বিড়াল ছিল মা ষষ্ঠীর বাহন। সেই বিড়াল মা ষষ্ঠীর কাছে নালিশ করত। একদিন এক জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে তার শাশুড়ি ব্রত পালনের জন্য পায়েস মিষ্টি রান্না করে রেখেছিলেন। তিনি স্নানে যাওয়ার আগে বউকে সেগুলো দেখতে বলে গেলেন। বউ খাবার দেখে লোভ সামলাতে পারল না, সব একটু একটু করে খেয়ে বিড়ালটার নামে দোষ দেওয়ার জন্য একটু দই নিয়ে বিড়ালটার মুখে লাগিয়ে দিল। শাশুড়ি এলে বউ রীতিমতো বিড়ালটার নামে দোষ চাপিয়ে বিড়ালটাকে দু’চার ঘা মেরে দিল। মনের দুঃখে সেই বিড়ালটা কেঁদে কেঁদে মা ষষ্ঠীকে জানালে মা এর প্রতিকার করার আশ্বাস দিলেন। কয়েক মাস পর বউয়ের ছেলে হল। একদিন সকালে এসে ঘুম ভেঙে দেখল ছেলে তার কাছে নেই। আর কখনওই ছেলের খোঁজ পাওয়া গেল না। এভাবে পরপর ৭টি সন্তান নিখোঁজ হয়ে গেল। পাড়ার লোকেরা তখন তাকেই তার জন্য দায়ী করল। অপবাদ সহ্য করতে না পেরে বউটি ষষ্ঠীর নাম করে কাঁদতে লাগল। মা ষষ্ঠীর দয়া হলে তাঁর কৃপায় বউ সাত সন্তান ফিরে পেল। মা ষষ্ঠীর পুজো করলেন সবাই। সন্তানেরা বড় হলে তাদের বিয়ে হল, তখন বউ জামাইদের দেখে জামাইষষ্ঠী শুরু করল। এভাবে ব্রতের প্রচার হল।
আরও পড়ুন-আগামী ৪ দিন দেশে হালকা থেকে ভারী বৃষ্টি
ঘরে ফেরার গান
আগেকার দিনে বাংলার কোনও মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর মেয়ের মা-বাবা যখন তখন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারতেন না। কোথাও কোথাও মেয়ের প্রথম সন্তান না হলে তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ারই রেওয়াজ ছিল না। অরণ্যষষ্ঠী তিথিতে মেয়ে-জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় ব্রত পালন অনেকটা মেয়েকে দেখার তাগিদেই শুরু হয়েছিল। ‘জামি’ শব্দের অর্থ সধবা নারী বা কুলবধূ। বহুবচনে ‘জাময়’। আগে রীতি ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠীতে বনে গিয়ে মা বিন্ধ্যবাসিনী ষষ্ঠীর উপাসনা করে তাঁকে তুষ্ট করে সধবা স্ত্রীর সন্তান লাভ করতেন। আস্তে আস্তে জামাই আপ্যায়নের কথাও জুড়ে যাওয়াতেই হয়তো হল জামাইষষ্ঠী।
জামাইষষ্ঠী মানেই কিন্তু মেয়ের বাপের বাড়ি ফেরার পালা। সারাবছর টুকটাক তার আনাগোনা লেগে থাকলেও বিশেষ করে এইদিন জামাই মেয়েকে একসঙ্গে পাওয়াই কিন্তু আসল উপলক্ষ। হরেকরকম রান্নাবান্না তো রইলই, তবে তার সঙ্গে যাবতীয় মরশুমি ফল হিমসাগর আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, গোলাপজামের সম্ভার— জামাই আদরে কোনওভাবেই খামতি রাখেন না শাশুড়িরা।
আরও পড়ুন-মুখোমুখি মোদি-জেলেনস্কি
হলুদ বনে বনে
এই ষষ্ঠীর ক্ষেত্রে দেশ বিভেদে নিয়ম একটু আলাদা হয়। অনেক বাড়িতে নিজেদের সন্তানের মঙ্গল কামনায় বিয়ের আগেও কিন্তু মায়েরা ষষ্ঠী পালন করে থাকেন। আবার কিছু দেশে জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত করা হয়। একটি ফুলের তোড়া বাঁধা হয়, যাকে ‘ষষ্ঠীর ডোর’ বলা হয়ে থাকে। বাঁশের খোল, করমচা, কমলা রঙের ফুল, আতপ চাল, দূর্বা, হলুদ সুতো দিয়ে বাঁধা হয়। সেটিকে ভিজিয়ে রাখা হয় গঙ্গা জলের পাত্রে। এটি দিয়েও মাথায় জল ছেটানোর নিয়ম রয়েছে। হলুদ মা ষষ্ঠীর প্রিয় রং, এ কারণেই অনেকে হলুদ ছেটানো পাখাও ব্যবহার করেন।