সোজা কথাটা শুরুতেই সাফ সাফ বলে ফেলা ভাল। বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য এবং বুজরুকির জাল ছেঁড়ার জন্যই সেটা দরকার।
মণিপুরে মেইতেই ও কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে সংঘাতের সংবাদ আমাদের নিয়ত আতঙ্কিত ও আশঙ্কিত করছে, সেটা নিছক দুটি জনজাতির সংঘর্ষকাহিনি নয়। এটি আদতে একটি অসমঞ্জস সংঘাতের আখ্যান, যেটির রূপদান করেছে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্যবাদ যা সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতিতে চালিকাশক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
আরও পড়ুন-মানুষের পরিষেবায় দুয়ারে কাউন্সিলর
মণিপুরের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি অংশ মেইতেই গোষ্ঠীভুক্ত। তাঁরাই মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। এবং তাঁদের দাবি, তাঁরাই মণিপুরের আদিনিবাসী যাকে ইংরেজিতে বলে aboriginal। তাঁরা দাবি করেন, সমস্ত মণিপুর, তার সমভূমি ও পার্বত্য অঞ্চল, বন, পাহাড়, নদী ও জঙ্গল, যাবতীয় ভৌগোলিক অস্তিত্বে তাঁদের একচ্ছত্র অধিকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নোংথোম্বাম বীরেন সিং এই মেইতেই গোষ্ঠীর নেতা। হামেশাই তিনি বলে থাকেন, মেইতেইদের পবিত্র ভূমি মণিপুরে কুকিরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। তারা মণিপুরে ঘর বেঁধেছে স্রেফ অফিম চাষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের নেশাড়ুদের নেশার দ্রব্যের জোগান দিতে। গত শতাব্দীতে কুকিরা খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। এই ধর্মান্তরিত হওয়ার ইতিহাস সংখ্যাগুরু মেইতেইদের চেতনায়, বিশ্বাসে ও প্রচারে আরও বেশি করে কুকিদের বিদেশি হিসেবে তুলে ধরতে প্রণোদিত করেছে।
আরও পড়ুন-সিটি স্ক্যান করানো হল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর, দুপুরে বোর্ড মিটিং
প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী রাজ্য অসমেও এমন কাণ্ডের ইতিহাস জ্বলজ্বল করছে। অসমিয়ারা প্রথমে ভেবেছেন তাঁরা বাঙালি ভদ্রলোকদের দ্বারা শোষিত। তারপর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের প্রাবল্যে তাঁরা ভেবেছেন মুসলমানেরা হিন্দুদের সব সুবিধা কেড়ে খাচ্ছে। এই আশঙ্কা, উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮৩-তে নেলির গণহত্যায়। এই পথ ধরেই আজকের অসম ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মার অনুপ্রেরণায় নবজাগ্রত সংখ্যাগুরুবাদের পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে।
চিটফান্ড-কাণ্ডে জড়িত— এমন অভিযোগ হিমন্তের বিরুদ্ধে থাকা সত্ত্বেও তাঁর সিবিআই কিংবা ইডি-র রেডারের বাইরে থাকতে কোনও অসুবিধা হয়নি।
আরও পড়ুন-সোমবার ভোরেই জয়পুর-মুম্বই এক্সপ্রেসে আরপিএফ জওয়ানের গুলি, নিহত ৪
মণিপুরের কথা বুঝতে গেলে অসমের প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ একটাই। উভয় রাজ্যেই ডাবল ইঞ্জিন সরকার চলছে। আর সেই ডাবল ইঞ্জিন সরকারকে কাজে লাগিয়েই অসমে বাঙালি ও মুসলমানদের ওপর এবং মণিপুরে খ্রিস্টান কুকিদের ওপর নির্যাতন চালানো সহজতর হচ্ছে। লাভ জিহাদের জিগির তুলে হোক, সম্পত্তি আইনে বর্ণবিদ্বেষের ছায়াপাতা কার্যকর করে হোক, ঘৃণা ভাষণকে হাতিয়ার করে হোক অথবা হিংসার ভূগোলের প্রসৃতি ও তীব্রতা বৃদ্ধি করেই হোক, সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ অক্লেশে বিস্তারলাভ করছে।
আরও পড়ুন-জবাব দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া
নাগরিক হিংসা সংখ্যাগুরুর আধিপত্যকামী শাসক— তা সে কেন্দ্রের হোক বা রাজ্যের—তার হাতে অনিবার্যভাবে গণরোষের একটা অজুহাত জুগিয়ে দেয়। আর সেই ছুতোয় আড়াল করা হয় গণপিটুনির উসকানিদাতা মৌলবাদী ছাত্রযুবদের, শাসকের পাপোশে ন্যায়ের যুক্তি বন্ধক রাখা বিচারকদের এবং সেই ধর্মান্ধ উগ্র জনতার পরিচয়ও যারা পিটুনি থেকে অগ্নিসংযোগ, নরহত্যা থেকে সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ, সবকিছুতেই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
আরও পড়ুন-পড়ুয়াদের ঘাড়েও এবার জিএসটির বোঝা চাপাল কেন্দ্র
এই পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যার কথাটাও আলোচিত ও বিবেচিত হওয়াটা আবশ্যক। মায়ানমারের রাখাইনেতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাস ছিল। মণিপুরের মেইতেইদের মতো রাখাইনের বৌদ্ধরাও বিধর্মী মুসলমানদের বিদেশি বলে খেদাতে ইয়াঙ্গনের সংখ্যাগুরুদের সাহায্য করতে দ্বিধা করেনি। মায়ানমারের বামার বৌদ্ধদের ধারকভূমি হল রাখাইনে। সেখানে জাতিবিদ্বেষের বিষ-বীজ বপন হয়েছিল এভাবেই। মণিপুরও সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না, সেটা সময়ই বলবে।
আরও পড়ুন-মহরমে দিল্লিতে হিংসার ছবি, জখম ৫ মহিলা, ৬ পুলিশকর্মী
মণিপুরের হিংসার দুটি লক্ষণ বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো। এক, মেইতেইরা পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র লুট করল। লুণ্ঠনকারীদের গায়ে আঁচটুকুও লাগল না। রাজ্য সরকার তাদের নিরাপত্তার সব সুযোগ দিল। দুই, কুকিদের নাগরিকত্ব হরণের আওয়াজ তুলে কুকিকন্যাদের ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণ নাগরিক আর বিদেশিদের মাঝখানে, সভ্য ও বর্বরদের মধ্যে, মানুষ এবং অমানুষদের মধ্যে পাঁচিল তুলে দেয়। আধুনিক সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্যবাদ হিংসার সাহায্যে নিজের পরিধি কায়েম করে। ধর্ষণ করে, সম্পত্তি আর ইজ্জত লুঠ করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তোমরা নির্যাতিত হলে তোমাদের বাঁচানোর কেউ নেই। এটা তোমাদের দেশ নয়, তাই তোমাদের নিরাপত্তা-বেষ্টনী নেই। মণিপুরে এভাবেই সহবত শেখানো হয়েছে কুকিদের, অসমে আর রাখাইনে বাঙালি মুসলমানদের, শ্রীলঙ্কায় তামিলভাষী হিন্দুদের।
আরও পড়ুন-আজ দিল্লি অর্ডিন্যান্স বিল রাজ্যসভায়, প্রস্তুতি ইন্ডিয়ার
সংখ্যাগুরুবাদ হল এমন এক জাতীয়তাবাদ যা গ্রহণ বা আত্তীকরণের কথা বলে না, বলে কেবল বর্জনের কথা। যদি অপ্রতিহত প্রশ্রয় এ-ধরনের জাতীয়তাবাদ লাভ করে তবে তা একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর নিধন বা নির্মূলকরণের পথ নেয়। মণিপুরের পার্বত্য এলাকা থেকে কুকিদের বিতাড়ণ সেদিকেই এগােচ্ছে, তারই অশনিসংকেত। এ-জন্যই মণিপুরের বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কুকিরা মণিপুরের বনভূমি সংহার করে বসতি স্থাপন করছে, আবাদভূমিতে আফিম চাষ করে নেশার দ্রব্য জোগায়। এক্ষেত্রে আরও একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জনসংখ্যা আর মণিপুরে কুকিদের জনসংখ্যার খুব বেশি ফারাক নেই।
আরও পড়ুন-‘মোদির কাছে কি ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট নেই?’ মণিপুরে নির্যাতিতাদের প্রশ্ন, দিল্লি ফিরে ক্ষুব্ধ সুস্মিতা
জাতিগত সংঘর্ষ সদা উদ্বেগজনক বিষয়। শাসক নিরপেক্ষতা ছেড়ে একটি বিশেষ জাতির পৃষ্ঠপোষকতা করলে সেই উদ্বেগের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এটা বোঝার সাধারণ বুদ্ধিটুকু যেন আমরা কেউ হারিয়ে না ফেলি। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটুকুই প্রার্থনা।
আর সেই প্রার্থনার অনুষঙ্গে একটাই আর্জি— ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনে পদ্মপক্ষকে পাপড়িশূন্য করুন।