প্রতিবেদন : হিংসা-বিধ্বস্ত মণিপুরে যে জঙ্গলের রাজত্ব চলছে মঙ্গলবার তা ফের স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিল দেশের শীর্ষ আদালত। একইসঙ্গে রাজ্যের বিজেপি সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা করে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, তদন্তের নামে ছেলেখেলা হয়েছে। একাধিক উদ্বেগজনক ঘটনা সামনে আসার পরেও মণিপুর পুলিশ যে ভূমিকা নিয়েছে তা নিষ্ক্রিয়, তাপউত্তাপহীন এবং প্রহসনের নামান্তর। সরকারের এই অপদার্থতার ব্যাখ্যা দিতে আগামী সপ্তাহে মণিপুরের ডিজিপিকে সশরীরে হাজিরার জন্য তলব করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
আরও পড়ুন-হাত গুটিয়ে সরকার, মণিপুর-কটাক্ষ তৃণমূলের
মণিপুর ইস্যুতে সোমবারই কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকারের কড়া সমালোচনা করে শীর্ষ আদালত। মণিপুরের নারী নির্যাতনের ঘটনাকে লঘু করতে গিয়ে বিজেপি বাংলা-সহ অন্যান্য অবিজেপি রাজ্যের উদাহরণ তোলার চেষ্টা করায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিচারপতিরা। বিজেপির এই রাজনৈতিক কৌশল সপাটে খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, অন্য রাজ্যের ঘটনা দিয়ে মণিপুর ইস্যুতে ঢাল তৈরির চেষ্টা করে বোকা বানানো যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ, মণিপুরের ঘটনার সঙ্গে অন্য রাজ্যের তুলনাই চলে না। সোমবার এভাবে এই ইস্যুতে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর মঙ্গলবারও আদালতের ক্ষোভের মুখে বিজেপি সরকার। রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনকে কড়া তোপ দেগেছেন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি মনোজ মিশ্রর বেঞ্চ।
আরও পড়ুন-কংসাবতীর উপর হতে চলেছে, সাত বছর থমকে থাকা সেতু
মণিপুর পুলিশের ভূমিকাকে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বলেছে, পরিস্থিতির উপর কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই রাজ্য পুলিশের। টানা তিনমাস ধরে হিংসা চলছে। ৬ হাজার এফআইআর দায়ের হয়েছে। দেড়শোর বেশি মানুষ খুন হয়েছেন। ঘরছাড়া ৬০ হাজারের বেশি। তারপরেও অপরাধীদের ধরেনি পুলিশ! লাগাতার ভয়ঙ্কর হিংসা চলার পর নামমাত্র গ্রেফতারির সংখ্যা নিয়ে প্রবল উষ্মা প্রকাশ করে মণিপুর পুলিশের ডিজিকে তলব করেছে শীর্ষ আদালত। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, মনে হচ্ছে সাংবিধানিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, আইন-শৃঙ্খলা নেই। তদন্ত এত ধীর গতিতে হয় কীভাবে? দীর্ঘদিন পর এফআইআর নথিভুক্ত হয়, গ্রেফতার হয় না, বিবৃতি রেকর্ড করা হয় না। তুমুল ভর্ৎসনার পর আগামী সোমবার ডিজিপিকে দুপুর দুটোর মধ্যে সশরীরে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ।
আরও পড়ুন-স্কুলের ল্যাবে অ্যামোনিয়া বিস্ফোরণ, আহত শিক্ষক-সহ ১০ ছাত্রী
প্রসঙ্গত, গত ৩ মে থেকে জাতিদাঙ্গায় বিধ্বস্ত উত্তর-পূর্বের এই রাজ্য মণিপুর। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের সঙ্গে লাগাতার সংঘর্ষ চলছে জনজাতি কুকিদের মধ্যে। আর এই হিংসায় সবচেয়ে আক্রমণের মুখে পড়ছেন মহিলারা। গত ১৯ জুলাই ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, কুকি জনগোষ্ঠীর দুই মহিলাকে প্রকাশ্য রাস্তায় বিবস্ত্র করে ঘোরাচ্ছে উন্মত্ত জনতা। ওই মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতন চলে। পরে অভিযোগ ওঠে, পুলিশ আক্রান্ত মহিলাদের রক্ষা করার পরিবর্তে মারমুখী জনতার হাতে তাঁদের তুলে দেয়। কংপোকপি ও থৌবল জেলার সীমান্তে ঘটেছে এই ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী ঘটনা। গত ৪ মে ওই ঘটনা সম্পর্কে মণিপুর পুলিশ অবহিত থাকলেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। অপরাধীদেরও ধরার চেষ্টা করেনি। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে এরকম নারকীয় আরও ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ। প্রায় দুমাসের বেশি সময় পর গত ১৯ জুলাই সমাজ মাধ্যমে দুই নিগৃহীতার উপর অত্যাচারের দৃশ্য ভাইরাল হয়। দেশবিদেশে এই ঘটনার প্রতিবাদে আলোড়ন ওঠে। তারপরেই শীতঘুম ভেঙে তা নিয়ে পদক্ষেপ শুরু করে বিজেপি সরকারের পুলিশ। দেওয়া হয় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ।
আরও পড়ুন-দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারে বড় ধাক্কা, কমে গেল ডলার সঞ্চয়
তবে দুই নিগৃহীতার পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে জানানো হয়েছে, কেন্দ্রীয় তদন্ত এজেন্সি সিবিআই বা মণিপুরের পুলিশ, কোনও পক্ষের উপরেই বিন্দুমাত্র ভরসা নেই তাঁদের। সুবিচার দিতে আদালতের তত্ত্বাবধানে বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গড়ে তদন্ত চালানো হোক। মঙ্গলবার কেন্দ্রের তরফে সলিসিটর জেনারেল শীর্ষ আদালতে এফআইআর আর গ্রেফতারির সংখ্যা তুলে ধরার পরেই প্রবল উষ্মা প্রকাশ করেন বিচারপতিরা। এফআইআর এবং গ্রেফতারির সংখ্যার মাধ্যমে আকাশ-পাতাল তফাতের কথা তুলে মণিপুর পুলিশকে কার্যত দুরমুশ করেছে শীর্ষ আদালত।