সাড়ে চুয়াত্তর
কাল্ট ক্লাসিক ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ১৯৫৩-এ মুক্তি। নির্মল দে-র পরিচালনায়। এই কমেডি ছবির মাধ্যমেই জন্ম হয়েছিল ‘উত্তম-সুচিত্রা’ জুটির। তবে মহানায়ক-মহানায়িকা তখনও সেই অর্থে স্টার হয়ে ওঠেননি। ছবির শুরুতে নামপত্রে এবং পোস্টারে তাঁদের নাম ছিল ছোট হরফে। বড় হরফে নাম ছিল তুলসী চক্রবর্তী এবং তাঁর নায়িকা মলিনা দেবীর। সেইসময় দু’জনেই ছিলেন জনপ্রিয়। তুলসী চক্রবর্তীর সন্দেহবাতিক স্ত্রীর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন মলিনা দেবী। জীবনে বহু ছবিতে অভিনয় করলেও, এই ছবিটি তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। আজও বাংলা ছবির দর্শকদের কাছে সমাদৃত।
আরও পড়ুন-নিখোঁজ
নৃত্যশিল্পী হিসেবেই শুরু
অভিনেত্রী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেলেও, নৃত্যশিল্পী হিসেবেই শুরু হয়েছিল মলিনা দেবীর কেরিয়ার। মাত্র আট বছর বয়সে। ঘরে ছিল অভাব। কলকাতার নাট্যমঞ্চে তাঁকে দেখা যেত সখীদের নাচের দলে। মিনার্ভা থিয়েটারে ‘কিন্নরী’, ‘মিশরকুমারী’ প্রভৃতি নাটকেও সুনামের সঙ্গে অভিনয় করেন। ১৯২৯ সালে মঞ্চস্থ হয় ‘জাহাঙ্গীর’। বালক দারা শিকোহর চরিত্রে তিনি মাত করে দেন। পরের বছর মুক্তি পায় ‘শ্রীকান্ত’। এই চলচ্চিত্রে ছোট্ট একটি চরিত্রে তাঁর সাবলীল অভিনয় দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ছিলেন মলিনমালা
দর্শকদের কাছে তিনি মলিনা দেবী। তবে তাঁর আসল নাম ছিল মলিনমালা। মা ডাকতেন ‘দুখি’ বলে। চলচ্চিত্র জগতে আসার পর নাম পরিবর্তিত হয়। মলিনমালা হয়ে যান মলিনা। ১৯১৬ সালের ৭ মার্চ তাঁর জন্ম। যদিও এই নিয়ে দ্বিমত আছে। আরেকটি সূত্র বলছে, ১৯১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেন। পৈতৃক বাড়ি ছিল হাওড়ায়। বাবার নাম হরিপদ ঘোষ, মা সুশীলারানি। তিন বোন, এক ভাই। মলিনাই সবার বড়। ভাই রমেন ঘোষ করতেন চলচ্চিত্র সম্পাদনার কাজ। প্রথাগত পড়াশোনার সুযোগ পাননি। নিজের চেষ্টায় যতটুকু যা পেরেছেন শিখেছেন।
আরও পড়ুন-ভারতীয় দণ্ডবিধিতেও গেরুয়াকরণ
অভিনেত্রীর চাকরি
বীরেন্দ্রনাথ সরকার তৈরি করেন ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রাফটস’। শুরু করেন ছবি প্রযোজনা। সেই সময়ে বিষেণচাঁদ ওরফে জলু বড়ালের সঙ্গে মলিনা দেবীর পরিচয় হয়। যদিও তখন তিনি মলিনমালা। জলুবাবুই তাঁর নাম পাল্টে রাখলেন ‘মলিনা’। পরবর্তী সময়ে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৩১ সালে ম্যাডান কোম্পানির ‘দেবী চৌধুরাণী’ এবং ফিল্ম ক্রাফটসের ‘চাষার মেয়ে’ ছবিতে অভিনয় করেন মলিনা দেবী। ১৯৩১ সালেই বি এন সরকার তৈরি করলেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা ‘নিউ থিয়েটার্স’। জলু বড়াল হলেন প্রোডাকশন ম্যানেজার। সে কালের ‘স্টুডিয়ো সিস্টেম’-এ পরিচালক থেকে অভিনেতা থেকে যন্ত্রী, সকলেই ছিলেন মাসমাইনে করা। কিছুদিন বাদে মলিনা দেবীরও সেখানে অভিনেত্রীর চাকরি জুটে গেল। পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’ বানালেন। নির্মলার চরিত্রে মলিনা দেবী। অতি সাধারণ ছবি, তাঁর চরিত্রটিও সাধারণ। কিন্তু এই প্রথম সবাক ছবিতে অভিনয় করলেন তিনি।
আরও পড়ুন-কলকাতায় কাগজের গোডাউনে আগুন
নৃত্যবহুল ছবিতে
দীর্ঘদিন নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখানেই নেন নাচের অতিরিক্ত তালিম। সেইসময় তাঁকে নৃত্যবহুল বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায়। যেমন ‘মীরাবাঈ’ ও ‘মহুয়া’। দুটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেন মুখ্য চরিত্রে। ১৯৩৬ সালে মলিনা দেবী অভিনয় করেন প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘গৃহদাহ’ ছবিতে। দু’বছর পর ১৯৩৮ সালে প্রফুল্ল রায়ের ‘অভিজ্ঞান’। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ছবি ‘অভাগীন’-এও মূল চরিত্রে অভিনয় করেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হয় ‘বড়দিদি’। মলিনা দেবী অভিনীত ছবিটি বিপুল সাফল্য লাভ করে।
আরও পড়ুন-গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র
স্নেহময়ী মা, দিদি, বউদি
মূল চরিত্রের পাশাপাশি পার্শ্বচরিত্রেও অভিনয় করেন তিনি। চ্যালেঞ্জিং রোল পেলেই রাজি হয়ে যেতেন। এককথায় তিনি ছিলেন পরিচালক-প্রযোজকদের ভরসার জায়গা। ১৯৪০ সালে বদলে যায় নিউ থিয়েটার্সের বাণিজ্যিক পরিকাঠামো। সেই সময় থেকেই তিনি অন্যান্য প্রযোজনা সংস্থার তৈরি ছবিতে অভিনয় শুরু করেন। হাতে এসে যায় পরপর অনেকগুলি ছবি। বাংলা এবং হিন্দি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘রামের সুমতি’ ও ‘বিন্দুর ছেলে’।
আরও পড়ুন-ফের ট্রেন বাতিল, যাত্রী দুর্ভোগ
রানি রাসমণি চরিত্রে
১৯৫৫ সালে ‘রাণী রাসমণি’ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন মলিনা দেবী। উচ্চ প্রশংসিত হন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের চরিত্রে অভিনয় করেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী। পরবর্তীকালে মলিনা দেবীকে দেখা যায় ‘নিষ্কৃতি’, ‘ছোট বৌ’, ‘মেজো বৌ’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’, ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’, ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদিদি’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘একটি রাত’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘ছায়াসূর্য’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘ফুলু ঠাকুরমা’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘ময়না’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ছবিতে। বাংলা, হিন্দি, উর্দু মিলিয়ে ৪০০-র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। কাজ করেছেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া, প্রফুল্ল রায়, হীরেন বসু, অমর মল্লিক, চিত্ত বসু, কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, নির্মল দে প্রমুখ বাঘা বাঘা পরিচালকের সঙ্গে। তাঁর অভিনয়ের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল ভেরিয়েশন। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করতেন, তখন সেই চরিত্রের ছাঁচে নিজেকে ফেলে নিতেন। স্নেহময়ী মা, দিদি অথবা বউদির চরিত্রে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়া। দর্শকরা তাঁর মধ্যে দেখতে পেতেন নিজেদের মা, বউদি, দিদির ছায়া। তাঁর কান্না দেখে কাঁদতেন, হাসি দেখে হাসতেন। গুরুগম্ভীর চরিত্রের পাশাপাশি মলিনা দেবী করেছেন কমেডিও। পাশাপাশি তাঁকে খলনায়িকার ভূমিকাতেও দেখা গেছে।
আরও পড়ুন-ক্ষুদ্রশিল্প বিকাশে ৩০০ কোটি তৈরি লক্ষাধিক কর্মসংস্থান
পর্দার পাশাপাশি মঞ্চে
চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা পেলেও মঞ্চকে ভোলেননি। ১৯৪৩ সালে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর শ্রীরঙ্গমে, পরে বিশ্বরূপায় শরৎচন্দ্রের ‘বিপ্রদাস’ নাটকে অভিনয় করেন। বন্দনা চরিত্রে তিনি দর্শকদের প্রশংসা পান। এর পরে কালিকা থিয়েটার প্রযোজিত ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘মেজদিদি’, ‘যুগদেবতা’ নাটকে তিনি অভিনয় করেন। ‘যুগদেবতা’য় তাঁকে রানি রাসমণি ও গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে শ্রীরামকৃষ্ণের ভূমিকায় দেখা যায়। পরে বিভিন্ন সময়ে মলিনা দেবী অভিনয় করেছেন রানি রাসমণির ভূমিকায়। ১৯৫১ সালে বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘ছাব্বিশে জানুয়ারি’ ও ১৯৫২ সালে জলু বড়ালের নির্দেশনায় ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেন।
আরও পড়ুন-সর্বোচ্চ আদালতে জয় নির্বাচন কমিশনের, বাংলায় দল পাঠানো নিয়ে তীব্র ভর্ৎসনা
নাট্য এবং চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা স্থাপন
একটা সময় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে একটি নাট্যসংস্থা স্থাপন করেন। নাম দেওয়া হয় এমজি এন্টারপ্রাইজেস। ‘ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ’ ও ‘রাণী রাসমণি’ নাটক দুটি সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করেন তাঁরা। ১৯৭৯ সালে নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা পিঙ্কি এন্টারপ্রাইজ গড়ে তোলেন। সুখেন দাসকে দিয়ে তৈরি করান ‘সুনয়নী’। উত্তমকুমার এবং শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সেই ছবিতেই আত্মপ্রকাশ হয় শকুন্তলা বড়ুয়ার।
আরও পড়ুন-ফাইনালে ভারত
জীবনে বেশকিছু পুরস্কার পেয়েছেন মলিনা দেবী। তার মধ্যে অন্যতম সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার। নাটকের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৭৬ সালে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৭৭ সালের ১৩ অগাস্ট প্রয়াত হন। আজও টেলিভিশনের পর্দায় তাঁর অভিনয় দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে দেখেন। আনন্দ পান।