নাটক ছিল প্রতিবাদের ভাষা
ধরে গেল আগুন। মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল দাউদাউ করে। ধানবাদের জামাডোবায় চিনাকুড়ি-বড়াধেমো কয়লাখনির গভীরে তখন আটকে পড়েছেন অসংখ্য শ্রমিক। বাইরে উত্তেজনা। অন্য কর্মীরা বাঁচাতে তৎপর। অথচ আটকে পড়া শ্রমিকদের কথা ভাবলেন না খাদান মালিক। চরম স্বার্থপরের মতো তিনি জল ঢুকিয়ে দিলেন কয়লার খনি বাঁচানোর জন্য। ফল হল মারাত্মক। খনির নিচে দমবন্ধ হয়ে মারা গেলেন শ্রমিকরা।
মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। রবি ঘোষ খবরটি পৌঁছে দিলেন তাঁদের নাটকের দলে। সেই সময় উপস্থিত ছিলেন উৎপল দত্ত। মর্মাহত হলেন তিনি। কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে ছুটলেন সেই কয়লাখনিতে। হাজার ফুট নিচের সেই খনিগহ্বরে দু’ঘণ্টা ধরে ঘুরলেন। কথা বললেন জীবিত খনি শ্রমিকদের সঙ্গে। রেকর্ড করলেন খনির ভিতরের বিভিন্ন শব্দ। সেখান থেকে ফিরে মিনার্ভার তিনতলার ঘরে বসে টানা ১৫ দিনে লিখে ফেললেন কালজয়ী নাটক ‘অঙ্গার’। ১৯৫৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথমবার মঞ্চস্থ হল। নাট্য আন্দোলনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হল নতুন ইতিহাস।
আরও পড়ুন-কোন অধিকারে তদন্ত? ইডি নিরুত্তর বিচারপতির প্রশ্নে
এইভাবেই উৎপল দত্ত সৃষ্টি করেছেন একের পর এক কালজয়ী নাটক। বিভিন্ন সামাজিক ঘটনায় আলোড়িত হয়ে। নাটক ছিল তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। নাটকের মধ্যে দিয়েই বাড়াতে চেয়েছেন সচেতনতা। এইভাবেই তিনি আলোড়ন তুলেছেন মানুষের মনে। তাঁর সময়কালে আর কোনও নাট্যব্যক্তিত্বকে ঘিরে এতটা উন্মাদনা দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন আগুনের গোলার মতো। সামনে এসেছে বহু বাধা। নাটকের উপর নেমেছে আক্রমণ। তবু দমে যাননি। তাঁর নাটক যতটা ক্লাসের, ততটাই মাসের। সম্ভবত সেই কারণেই জনপ্রিয়তায় ছাপিয়ে গিয়েছিলেন সমসাময়য়িক অনেককেই।
আরও পড়ুন-প্রশাসনে স্বচ্ছতার লক্ষ্যে বিজয়ীদের অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করাচ্ছে তৃণমূল
বাড়িতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিবেশ
জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ। পূর্ব বাংলার বরিশাল জেলার কীর্তনখোলায়। যদিও তাঁর পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল কুমিল্লা জেলায়। পুরো নাম উৎপলরঞ্জন দত্ত। বাবা গিরিজারঞ্জন দত্ত। মা শৈলবালা দেবী। বাবা ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ প্রভাবিত সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষ। পরবর্তী সময়ে জেলার হিসেবে ইংরেজ কারাগারের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক নিযুক্ত হন। শিলং শহরের সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে উৎপলের স্কুলজীবন শুরু। তবে বেশিদিন থাকেননি সেখানে। বাবা বদলি হয়ে আসেন বহরমপুর শহরে। এখানেই কেটেছিল উৎপলের ছেলেবেলার সোনালি দিনগুলো। ভর্তি হন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে।
আরও পড়ুন-লাদাখে সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ সেনা জওয়ানের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ অভিষেকের
স্কুলে যাতায়াতের সময়ে সঙ্গে দেহরক্ষী থাকত। বিপ্লবীদের ভয়ে। উৎপল ড্রিল করতেন জেলের পাঠান রেজিমেন্টের জওয়ানদের সঙ্গে। তাঁদের কাছেই শিখেছিলেন সময়ানুবর্তিতা। জেল-সংলগ্ন কোয়ার্টারে থাকতেন তাঁরা। নাটকের সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক পরিচয় ঘটে সেইসময়। বাড়ির সদর দরজায় ঝুলত মায়ের হাতে তৈরি এমব্রময়ডারি করা শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকের পেমেনিয়াসের সংলাপ, ‘নেভার কোয়ারেল, নেভার লেন্ড অর বরো ইফ ইউ আর অনেস্ট।’ এর পিছনে কারণ ছিল বাড়িতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিবেশ। শেক্সপিয়র নিয়ে রীতিমতো চর্চা হত। মেজদা পাঠ করে শোনাতেন শেক্সপিয়রের নাটকের গল্প। গান শোনার মতো বাড়িতে রেকর্ড চালিয়ে নাটক শোনার চল ছিল। খুব কম বয়স থেকেই উৎপল সেই সব নাটক মন দিয়ে শুনতেন। আশ্চর্যের কথা, মাত্র ছয় বছর বয়সেই শেক্সপিয়রের নাটকের সংলাপ মুখস্থ বলতে পারতেন।
আরও পড়ুন-মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে ফিরলেন লাসিথ মালিঙ্গা, পরিকল্পনা শুরু
মহেন্দ্র এবং শিশিরকুমারের নাটক
হিন্দুস্তানি মার্গ সংগীতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় বহরমপুরের বাড়িতেই। বড়দিদির মাধ্যমে। কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময়ে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের সংস্পর্শে আসেন। তখনও নাটক তাঁকে সেইভাবে টানেনি। তিনি কনসার্ট পিয়ানিস্ট হতে চেয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় বদলি হন বাবা। থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার রয় স্ট্রিটে। কলকাতায় আসার পরেই বাবা-মায়ের সঙ্গে উৎপল কলকাতার পেশাদার থিয়েটার দেখতে যেতেন। স্টার থিয়েটারে দেখতেন মহেন্দ্র গুপ্তের নাটক, শ্রীরঙ্গমে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর নাটক। শিশিরকুমারের নাটক তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। দশ বছর বয়সে উৎপল ভর্তি হন সেন্ট লরেন্স স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে। স্কুলে হত বিদেশি নাটক। সেখানেই হয় উৎপলের অভিনয়ে হাতেখড়ি। এর পরে তিনি চলে আসেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। নবম শ্রেণিতে। এই স্কুল এবং পরবর্তীতে কলেজ জীবন উৎপলকে তৈরি করে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন-রেল লাইনে লোহার পাত ফেলে দুর্ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধৃত যুবক
সময়টা ছিল অস্থির
ইউরোপীয় নাট্যচর্চার একটা ধারা আগে থেকেই সজীব ছিল কলেজে। এখানে পড়াকালীনই একদিকে যেমন ইবসেন বা শেক্সপিয়রের নাটকের জগৎ তাঁর আরও কাছে এসেছিল, তেমনই তাঁকে পেয়ে বসেছিল সেই নাটকে অভিনয় করার ইচ্ছে। কলেজ পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন ‘বেটি বেলশাজার’ নামে প্রথম ইংরেজি নাটক। এ-ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে শুরু করেন। বিষয়ের মধ্যে ছিল শেক্সপিয়র, বার্ট্রান্ড রাসেল, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বেঠোভেন, বাখ, শুবার্ট ও ভাগনার।
আরও পড়ুন-হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অভিনেতা পবন
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়। ওই বছর নিকোলাই গোগোলের ‘ডায়মন্ড কাটস ডায়মন্ড’-এ অভিনয় করেন উৎপল। কলেজ জীবনে তাঁর সহপাঠী অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন প্রতাপ রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়। বন্ধুদের নিয়েই তৈরি করেন তাঁর প্রথম নাট্যদল ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিরিয়নস’। তখন তাঁর বয়স আঠারো। তার আগে ১৯৪৪ সালে ‘নবনাট্য আন্দোলন’-এর জন্ম দেওয়া ‘নবান্ন’ নাটকটি তিনি দেখেছেন এবং চমকে গিয়েছেন। সময়টা ছিল অস্থির। তাঁর চোখের সামনে ঘটে যায় বিশ্বযুদ্ধ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা, উদ্বাস্তুদের ঢল, নৌ-বিদ্রোহ ইত্যাদি। প্রত্যেকটি ঘটনা ভাবিয়েছিল উৎপলকে। ভিতরে ভিতরে জন্ম দিয়েছিল উত্তেজনার। তিনি চালিয়ে যেতে থাকলেন নাটক নিয়ে গভীর চর্চা। জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করলেন নতুন ভাবনার। ১৯৪৯-এর ১৫ জুলাই জেভিয়ার্সের মঞ্চে শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ মঞ্চস্থ করলেন। নতুনত্বের স্বাদ পেলেন দর্শকেরা।
আরও পড়ুন-হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অভিনেতা পবন
শেক্সপিয়রের আটটি নাটকে অভিনয়
এই সময় ঘটল আরও একটি স্মরণীয় ঘটনা। উৎপলের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিজের দলে টেনে নিলেন জিয়োফ্রে কেন্ডাল।
যাঁকে পরবর্তী সময়ে উৎপল নিজের গুরুর আসনে বসাবেন। উৎপল অভিনেতা হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন ‘দ্য শেক্সপিয়রানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানি’তে। এই দলের পেশাদার অভিনেতা হিসেবে শেক্সপিয়রের মোট আটটি নাটকে অভিনয় করেন। প্রথম পর্বে কলকাতায়, দ্বিতীয় পর্বে সারা দেশে।
আরও পড়ুন-জয় শাহকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ পিসিবির
একই সঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের দল ‘দ্য অ্যামেচার শেক্সপিরিয়ানস’। ১৯৪৯ সালে এই দলের নতুন নাম হয় ‘কিউব’। পরের বছর আবারও নাম বদল। রাখা হয় ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। ১৯৫২ সালে মঞ্চস্থ করেন হেনরিক ইবসেনের বাংলা অনুবাদ ‘গোস্টস’ নাটকটি। এই সময় কিছুদিনের জন্য যুক্ত হয়েছিলেন গণনাট্যের সঙ্গে। তবে একটা সময় বিরক্ত হয়ে তিনি বেরিয়েও আসেন।
আজ বাংলায় পথনাটকের রমরমা। এই ধারার নাটকের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলেন উৎপল। হাজরা পার্কে অভিনয় করেন উমানাথ ভট্টাচার্যের ‘চার্জশিট’ নাটকে। উৎপলের সঙ্গে অভিনয় করেন ঋত্বিক ঘটক। ১৯৫২ সালে ‘পাসপোর্ট’ থেকে ১৯৯২ সালে ‘সত্তরের দশক’, দীর্ঘ একচল্লিশ বছরে উৎপল মোট ২৫টি পথনাটকে অভিনয় করেন। দর্শকদের মনে তুলেছেন ঢেউ। এই নাটকগুলোর মধ্যে ছিল সামাজিক বার্তা। উদ্দেশ্য ছিল জনজাগরণ। মানুষের সচেতনতা বাড়ানো। কোনও নাটকেই বিনোদনের ছিটেফোঁটা ছিল না।
আরও পড়ুন-রেল লাইনে লোহার পাত ফেলে দুর্ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধৃত যুবক
মিনার্ভা এবং
পেশাদার নাট্যমঞ্চ
একটা সময় পেশাদার নাট্যমঞ্চে পা রাখেন উৎপল দত্ত। উদ্দেশ্য নিয়মিত অভিনয়। লিজ নেন মিনার্ভা থিয়েটার। প্রতি বৃহস্পতি, শনি ও রবিবার মঞ্চস্থ করতে থাকেন নাটক। দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেন ‘ওথেলো’, ‘ছায়ানট’, ‘নীচের মহল’। প্রথম দিকে দর্শক সমাগম হত খুব কম। একদিন ‘নীচের মহল’ নাটক দেখতে এসেছিলেন রবিশঙ্কর। অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি উৎপল দত্তের সঙ্গে দেখা করেন এবং নাটকে সংগীতায়োজনের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তাঁকে সাদরে বরণ করে নেন উৎপল।
আরও পড়ুন-জরিমানার হয়রানি, ঠেকাতে নয়া নির্দেশিকা আরবিআইএর
কালজয়ী নাটক ‘অঙ্গার’ মঞ্চস্থ হয়েছিল মিনার্ভায়। পরবর্তী সময়ে তিনি মিনার্ভায় মঞ্চস্থ করেন ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘চৈতালী রাতের স্বপ্ন’, ‘প্রোফেসর মামলক’ প্রভৃতি নাটক। ১৯৬৫ সালের ২৮ মার্চ মঞ্চস্থ করেন আর এক সাড়া জাগানো নাটক ‘কল্লোল’। ১৯৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে এই নাটক বিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকে অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনের সূচনা করেছিল। প্রশংসার পাশাপাশি তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল তীব্র সমালোচনাও। মুখোমুখি হতে হয়েছিল বহু বাধা-বিপত্তির। করতে হয়েছিল কারাবরণ। পক্ষে এবং বিপক্ষে গলা তুলেছিলেন অনেকেই। মন্মথ রায়, সত্যজিৎ রায়-সহ দেশের বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে ফিরলেন লাসিথ মালিঙ্গা, পরিকল্পনা শুরু
রাজনীতি থেকে দূরে
রাজনীতি সচেতন ছিলেন উৎপল দত্ত। তবে একটা সময় নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন রাজনীতি থেকে। বলা ভাল সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন যাপন করেছেন নিঃসঙ্গ জীবন। তাঁকে বহিষ্কার করেছিল নিজের দল এলটিজি। পড়েছিলেন অর্থকষ্টে। নিঃসঙ্গতা এবং সংকট মুহূর্তে তিনি মঞ্চস্থ করেন ‘মানুষের অধিকার’ নামে আরও একটি নাটক। এই নাটকও পড়েছিল সমালোচনার মুখে। ভেঙে যায় দল। উৎপল দত্ত মিনার্ভা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। গড়ে তোলেন ‘বিবেক নাট্যসমাজ’। যা পরবর্তী কালে নতুন দল পিপলস লিটল থিয়েটার নামে পরিচিতি পায়। ১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর রবীন্দ্রসদনে মঞ্চস্থ হয় দলের প্রথম নাটক ‘টিনের তলোয়ার’। বিতর্ক কিন্তু পিছু ছাড়েনি। তবু থেমে থাকেননি উৎপল। এর পরে মঞ্চস্থ করেন ‘সূর্যশিকার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘টোটা’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’, ‘তিতুমীর’, ‘জনতার আফিম’, ‘একলা চলো রে’ প্রভৃতি নাটক। ‘একলা চলো রে’ নাটকে শেষবারের মতো মঞ্চে নামেন বাংলা থিয়েটারের ‘সাহেব’ উৎপল দত্ত।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
নাট্যকার যখন সফল পালাকার
শুধুমাত্র নাটক রচনা, পরিচালনা এবং অভিনয় নয়, উৎপল দত্তের জীবন জুড়ে ছিল আরও কয়েকটি অধ্যায়। তার মধ্যে অন্যতম যাত্রাপালা। তিনি উপলব্ধি করতেন, মানুষের মাঝে পৌঁছনোর সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম যাত্রা। শহুরে প্রোসেনিয়াম ছেড়ে তিনি যেমন মাটিতে নেমে নাটক করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তেমনই যাত্রার আলো-ঝলমলে মঞ্চকে ব্যবহার করে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মধ্যে চেতনা বাড়াতে চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় পা রেখেছিলেন। নাম লিখিয়েছিলেন নিউ আর্য অপেরায়। ‘রাইফেল’ পালার মধ্য দিয়ে পেশাদার পালাকার এবং পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। যাত্রা, নাটকের পাশাপাশি উৎপল দত্ত লিখেছেন কবিতাও। আবৃত্তি করতেন দরাজ গলায়। রবি ঘোষ বলেছেন, উৎপল দত্ত ছিলেন সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ স্টেজ স্টলওয়ার্ট। স্টেজ প্রোডাকশনের এ টু জেড জানতেন।
আরও পড়ুন-বাজি হাবের উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী
চলচ্চিত্রে অভিনয়
অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত। তার সূচনা হয়েছিল মধু বসুর ‘মাইকেল’ ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। বাংলার পাশাপাশি বেশকিছু হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, অজয় কর, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, শক্তি সামন্ত, প্রভাত রায়, গৌতম ঘোষের বহু ছবিতে তাঁকে বিভিন্ন চরিত্রে দেখা গেছে।
১৯৯৩-এর ১৯ অগাস্ট কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন উৎপল দত্ত। মাত্র ৬৪ বছর বয়সে। শোভা সেন ছিলেন তাঁর স্ত্রী। বাংলা নাটকে উৎপল দত্ত এনেছিলেন নবজোয়ার। তুলেছিলেন ঝড়। তিনি অজান্তেই নাটকের ভাবনার বীজ বুনে দিয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের মনে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আজ অভিনয়-জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত।
আরও পড়ুন-বাজি হাবের উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী
দর্শনের পাশাপাশি থাকত হিউমার
কথা হল বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘‘ছাত্রজীবনে যাঁর নাটক সবচেয়ে বেশি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, তিনি উৎপল দত্ত। সেইসঙ্গে নান্দীকারের থিয়েটার। উৎপল দত্তের থিয়েটার আমাকে যথেষ্ট আচ্ছন্ন করত, মুগ্ধ করত। নাটকের প্রেক্ষাপট যে পুরোটা বুঝতে পারতাম তা নয়। কিন্তু চারপাশের সমাজ, নিপীড়িত মানুষ, সংগ্রাম, দেশভাগ, স্বাধীনতার পরবর্তী কালের ছিন্নমূল এবং নাগরিক মানুষের জীবন সম্পর্কে বুঝতে চেষ্টা করতাম। যেটা বুঝতে পারতাম সেটা হল, যাকে জীবনযুদ্ধে অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে, সেই মানুষটি লড়াইয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এবং শেষমেশ মনুষ্যত্বের জয় ছিনিয়ে নিচ্ছে। সবমিলিয়ে উৎপল দত্তের থিয়েটার আমার মনের মধ্যে নাট্যভাবনার বীজ বুনে দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আমি যে নাট্যজগতে কাজ করলাম তার পিছনে উৎপল দত্তর একটা প্রভাব রয়েছে। শম্ভু মিত্র ছিলেন একটা ঘরানা, ছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ও— নিজস্বতা নিয়ে। পাশাপাশি উৎপল দত্ত ভিন্ন বর্ণের একটা নাট্যনির্মাণ এবং দর্শন আমাদের সামনে হাজির করতেন। ওঁর মধ্যে ইংরেজি নাটকের ভাবধারা ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে পরবর্তীকালে যখন নিজের থিয়েটার তৈরি করলেন, তখন তিনি সময়ের অনুসারী হলেন। মঞ্চসজ্জাকে বড় জায়গা দিলেন। মিনার্ভা থিয়েটারে অনেকদিন অভিনয় করেছিলেন। একটা মঞ্চে দীর্ঘ সময় অভিনয় করলে নিজেকে প্রকাশের সুবিধা থাকে। তাই ‘অঙ্গার’, ‘কল্লোল’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘ফেরারি ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকে আলো এবং মঞ্চকে আলাদা জায়গায় নিয়ে গেলেন। গেলেন ডিটেইলে। ‘অঙ্গার’-এ তৈরি করলেন কয়লা খনির সেট, তার মধ্যে দেখালেন রোপওয়ে, খাদানের উপর নিচের দৃশ্য, জলের প্লাবন, তার মধ্যে ডুবন্ত শ্রমিকদের আর্তনাদ— এই ভাবনাগুলো ছিল নতুন। দর্শকদের স্তম্ভিত করে দিচ্ছিল।
আরও পড়ুন-প্রশাসনে স্বচ্ছতার লক্ষ্যে বিজয়ীদের অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করাচ্ছে তৃণমূল
‘কল্লোল’-এ যেমন নৌ-সেনাদের বিদ্রোহ দেখাতে গিয়ে উনি মঞ্চে দেখিয়েছিলেন ফাইবারের ভাসমান জাহাজ। এই সমস্ত দেখানোর পাশাপাশি উনি সহজ থিয়েটারও নির্মাণ করেছেন। নাটকের মধ্যে দিয়ে মানুষকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, সচেতন করতে চেয়েছেন। একটা সময় রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা হয়েছিলেন। বেরিয়ে এসেছিলেন নিজের দল থেকে। সেই সময় তৈরি করেছিলেন নতুন নাট্যদল। এইগুলো করেছিলেন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার জন্য। ওঁর নাটকে দর্শনের পাশাপাশি থাকত অসম্ভব হিউমার। সাধারণ মানুষও রিলেট করতে পারতেন। দীর্ঘ সংলাপের মধ্যেও নিয়ন্ত্রণ করতেন আবেগ। তৈরি করতেন যুক্তি। সেইসঙ্গে অভিনয়ের একটা রীতি তৈরি করেছিলেন। ‘টিনের তলোয়ার’ দেখলে সেটা ভালমতো বোঝা যায়। কম বয়সে খুবই প্রভাবিত হতাম এইগুলোর দ্বারা। ভিতরে শিক্ষা তৈরি করত। তাই উৎপল দত্তের থিয়েটার সবসময় একটা পথনির্দেশ করে। সেই পথ মানতেও পারো, সেই পথে হাঁটতেও পারো, আবার না-ও পারো। কিন্তু পথটিকে অস্বীকার করতে পারবে না। দর্শনের মধ্যে, অভিনয় রীতির মধ্যে, মঞ্চ স্থাপনের মধ্যে, নাট্যরচনার মধ্যে দিয়ে উৎপল দত্ত বারবার নিজস্ব এই বোধ দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। সামগ্রিক ভাবে উনি অনেক মানুষ নিয়ে কাজ করতে ভালবাসতেন। থিয়েটার যে টোটাল একটা কাজ, সেটা দেখিয়েছেন। মঞ্চকে ভাগ করতেন সিনেমার মতো করে। একসঙ্গে সমাজের তিন-চারটি স্তরের ঘটনাকে দেখানো প্রথম ওঁর নাটকেই আমরা পেয়েছি। সব মিলিয়ে উৎপল দত্ত একটা বিস্ময় এবং পথপ্রদর্শক। অন্তত আমার কাছে।’’
আরও পড়ুন-ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডাক্তারের সাহায্যে ব্রিটিশ পুলিশের জালে নবজাতক খুনি নার্স
ছিলেন ভার্সেটাইল
বিশিষ্ট অভিনেতা বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী জানালেন, ‘‘উৎপল দত্তের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ আমার হয়নি। তবে ওঁর অভিনয় দেখেছি। ওঁর দলে অভিনয় করেছি। ‘কল্লোল’ নাটকে। তখন অবশ্য তিনি নেই। উৎপল দত্তের নাটক আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ওঁকে শিক্ষাগুরু হিসেবেই মেনে এসেছি বরাবর। ছিলেন ভার্সেটাইল। নানা ধরনের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। ওঁর বহু নাটক দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেগুলো আজও মনের মধ্যে গেঁথে আছে। যেমন ‘টিনের তলোয়ার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘তিতুমীর’। বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন। আমার সবচেয়ে প্রিয় ‘গোলমাল’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’, ‘আগন্তুক’। থিয়েটার, যাত্রা এবং চলচ্চিত্রে উৎপল দত্তের অবদান কোনও দিন ভোলা যাবে না।’’