আমি ছোটদিদার মতোই
সোহিনী সেনগুপ্ত
আমার জীবনে তিনটে মানুষের ভূমিকা অপরিসীম। আমার নিজের দিদা রমা হালদার। তাঁর কাছেই আমার পুরো শৈশবটাই কেটেছে এলাহাবাদে। দিদার কাছেই আমার রবীন্দ্রসঙ্গীতে হাতেখড়ি, পড়াশুনোর শুরু। দিদার ঠাকুরগুলো সব এখন আমার কাছে। আমি যে খুব পুজো করি তা নয় তবে দিদার স্মৃতি হিসেবে ওঁরা আমার কাছে রয়েছেন। জন্মাষ্টমীর দিন আমার দিদার গোপালের পুজো হয়েছে। আর একজন মানুষ হলেন আমার ছোট দিদা মীরা মুখোপাধ্যায়। উনি খুব বড় ভাস্কর ছিলেন। আমি অনেকটাই ওঁর মতো। মীরা আম্মা বলে ডাকতাম। উনি মেটিরিয়াল জগৎ থেকে দূরে থাকতেন। অসাধারণ রান্না করতেন। এসরাজ বাজাতেন। নিজের শর্তে একাই বেঁচেছেন সারাজীবন। আমার প্রচার-বিমুখতা ওঁর থেকেই পাওয়া। আর একজন হলেন সপ্তর্ষির ঠাকুমা। আমাদের যখন বিয়ে হয় আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমার এটা দ্বিতীয় বিয়ে। আমাদের বয়সের একটা ফারাক আছে। উনি শুনে বলেছিলেন, যদি প্রেম থাকে দু’জনের কিচ্ছু যায়-আসে না বয়স নিয়ে। আমি মনে করি দাদু, ঠাকুমা, দিদা এঁরা আমাদের মূল্যবোধ শেখায়। অন্যকে মূল্য দিতে শেখায়। ওঁরা আমাদের শিকড়।
আরও পড়ুন-‘ভারতের বাস্তবচিত্র লুকিয়ে রাখার চেষ্টা’ এক্সে কেন্দ্রকে নিশানা রাহুলের
ঠাকুমা ছিলেন খুব কাছের
সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়
আমার খুব কাছের ছিলেন আমার ঠাকুমা। দাদুকে আমি দেখিনি। আর মায়ের দিকেও কেউ ছিলেন না। ভবানীপুরে আমাদের যৌথ পরিবার ছিল। ঠাকুমা ওই বাড়িতেই থাকতেন। বাবার চাকরি সূত্রে আমরা বীরভূমে থাকতাম। ছুটিছাটায় আমরা যখন আসতাম ঠাকুমাকে দেখে মনে হত এতগুলো মানুষ কীভাবে একজনকে এত ভালবাসতে, শ্রদ্ধা করতে পারে। ঠাকুমা একটা বকুনি দিলে বড় বড় কাকারা, আমার বাবা— যাঁকে সবাই যমের মতো ভয় পেত তাঁকেও কেমন চুপসে যেতে দেখতাম। ভয়টা আসে শ্রদ্ধা থেকেই। ওপার বাংলা থেকে আসা এত বড় একটা পরিবারের স্তম্ভ ছিল ঠাকুমা। ওই সময় দাঁড়িয়ে মনের দিক থেকে খুব আধুনিক মনের ছিলেন। বাড়িতে সরস্বতী-লক্ষ্মীপুজো হত তখন নাড়ু করতেন ঠাকুমা। সেই নাড়ু সারাবছর ফুরোত না। আমরা চাইলেই সেটা বের করে হাতে দিতেন। আমার মেয়ে তার দিদা, ঠাকুমা আর ঠাকুরদা তিনজনকেই পেয়েছে। নাতনিকে অসম্ভব ভালবাসতেন আমার মা। ওদের মধ্যে ভীষণ সুন্দর একটা বন্ধুত্ব ছিল। মায়ের চলে যাওয়াতে খুব কষ্ট পেয়েছে। আর অন্যদিকে ওর দিদাও ছিল ওর খুব কাছের। আমি মনে করি যতই অগ্রগতি হোক না কেন, এই সম্পর্কগুলো বদলাবে না কখনও। এরাই আমাদের শিকড়।
আরও পড়ুন-‘খাবার থালায় ভারতের জাতীয় প্রতীক’ এক্সে সরব সাকেত গোখলে
দাদুই প্রথম ডিকশনারি চিনিয়েছে
সোনালি চৌধুরী
আমি কোনওদিনই নিউক্লিয়ার পরিবারভুক্ত ছিলাম না। অনেকের সঙ্গে বড় হয়েছি। আমার ঠাকুরদাকে কোনওদিন দেখিনি। কিন্তু ঠাকুমার সঙ্গে খুব গভীর সম্পর্ক ছিল। ঠাকুমা খুব অসাধারণ বাঙালি রান্না করতে জানতেন। কুঁচো চিংড়ির ঝাল, আলু পোস্ত, অপূর্ব মাছ রাঁধতেন। আমাকে রান্না করে খাইয়েছেন অনেক কিছু। অন্যদিকে, আমার মায়ের বাবা দাদু দারুণ ইংরেজি বলতেন, লিখতেন। দাদুর কাছে ভাল ইংরেজি লেখা এবং পড়া শিখেছি। ডিকশনারির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় করিয়েছেন আমার দাদু। কত কী যে শিখেছি দাদুর থেকে বলে শেষ করা যাবে না। দিদার প্রচুর আচার ছিল। ওখানে গেলেই আসার সময় আচারের শিশি নিয়ে আসতাম। আমার ছেলে আমার মাকে পেয়েছে মাত্র দেড় বছর। তার মধ্যেই একটা অদ্ভুত বন্ডিং তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মা ওকে সারাদিন কবিতা পড়ে শোনাত। এখন বাবার সঙ্গে ওর খুব সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এই সম্পর্কগুলো অমূল্য। আমি চাই আমার বাবা এবং শাশুড়ি-মা যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের ভরপুর সান্নিধ্য ছেলে পাক।
আরও পড়ুন-চাঁদমুখী ক্রিস্টিনা
খুব সুন্দরী ছিলেন ঠাকুমা
বিশ্বনাথ বসু
দাদুদের সান্নিধ্য আমার পাওয়া হয়নি। দুই দাদু মারা গিয়েছিলেন অনেক আগে। ঠাকুমা ছিলেন। কলকাতায় থাকতেন। এত সুন্দরী ছিলেন ঠাকুমা! চোখে চশমা, মুখ দিয়ে সব সময় ভাজা মশলার গন্ধ বেরত। ছোট্ট একটা হামানদিস্তা ছিল ঠাকুমার। ওটায় দোক্তাপাতা গুঁড়ো করতেন আর পান থেঁতো করে খেতেন। ঠাকুমাকে আমি অনেকগুলো দিন পেয়েছি। উনি যখন মারা যান তখন আমার ষোলো বছর বয়স। জ্ঞান হওয়া থেকে দুর্গাপুজোর ছ’দিন ঠাকুমার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কাটাতাম। সবাই ঠাকুমাকে বড়মা বলে ডাকত। একটা সময় একদম হাঁটা বন্ধ হয়ে যায় তখন আমি কোলে করে ঠাকুমাকে একতলা থেকে দোতলায় তুলতাম। কোলে করেই নামাতাম। তখন আমার জ্যাঠারা খুব মজা করত আমার সঙ্গে। ঠাকুমা খালি বলত, ‘‘কোথায় স্নান করিস!’’ আসলে পুকুরে খুব ভয় পেতেন। আমাকে খালি বলতেন ‘‘নাইতে পুকুরে যাবি না।’’ আর খুব শক্তপোক্ত, কঠিন মানুষ ছিলেন আমার দিদিমা। ওঁর নাম ছিল পাঁচি। আর আমি ছোটবেলায় খালি মজা করে বলতাম, ‘‘অ্যাই পাঁচি তুই মরলে আমি বাঁচি।’’ খুব সেল্ফ মেডউওম্যান ছিলেন। স্বামীহারা হয়েছেন পূর্ণযৌবনে। সন্তানহারা হয়েছেন। সাদা থান পরতেন। একবেলা আহার করতেন। কিন্তু কী মনের জোর! একাই থাকতেন। মেয়েদের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। আমার স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। দিদিমার সঙ্গে এত মজা করতাম অথচ উনি চলে যাওয়ার পর কষ্টে আমি আর শান্তিপুরে যাই না। এখন ছেলেরা আমার মাকে নিয়ে যেভাবে আনন্দ করছে আমার হিংসে হয়, মনে হয় আবার ফিরে যাই শৈশবে। ওদের ঠাকুমা-অন্তপ্রাণ। যার কোটি টাকা রয়েছে সেও নিঃস্ব যাদের এই সম্পর্কগুলো নেই। এঁদের সাহচর্য আমাকে মানুষ তৈরি করেছে।
আরও পড়ুন-তীব্র ভূমিকম্প মরোক্কোয়, মৃত ২৯৬, ক্ষতিগ্রস্ত বহু বাড়ি
দিদুন আর আমি প্রাণের সঙ্গী
স্নেহা চ্যাটার্জি ভৌমিক
আমি আমার মায়ের মা আর বাবার বাবাকে অনেকদিন পেয়েছি। আমার বাপের বাড়ির পাশেই মামারবাড়ি। ফলে অবাধ যাতায়াত ছিল সেখানে। মা আমাকে আর দিদুনকে খুব বকাঝকা করত ফলে আমাদের দু’জনের একটা সেম জোন ছিল। দিদুন বলত, ‘‘তোর মা খুব খ্যাক-খ্যাক করে!’’ আমারও সেটাই মনে হত। আমি আর দিদুন তাই মনের প্রাণের সঙ্গী ছিলাম। যা রান্না করত দিদুন তাই আমার খেতে ভাল লাগত। যখন এইটে পড়ি আচমকা দিদুন চলে যায়, যেটা মেনে নিতে পারিনি। আমার শরীর খারাপ হলে ঠাকুরদা কোথাও নড়তেন না সামনে থেকে। এখন আমার ছেলের দুই বাড়ির দাদুর সঙ্গে দারুণ বন্ডিং। আমার বাবাকে দাদা বলে আর ওর বাবাকে ঠাকুর। আমি ছ’-সাতদিনের জন্য আউটডোরে চলে গেলেও আমার বাবা থাকলে ওর কোনও চাপ নেই। ঘুম থেকে ওঠানো থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত সব করবে দাদা। বাবা যেমন আমাকে সবকিছু চিনিয়েছে তেমনই এখন ছেলের ক্ষেত্রেও শুরু হয়েছে। বাবা আবার সেই আগের ফর্মে। আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গেও ছেলে খুব অ্যাটাচ। তবে উনি একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন আর পেরে ওঠেন না। আমি চাই যে এই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষগুলো বেঁচে থাকুন— ওঁদের সান্নিধ্যও পাক বহুবছর।