দেবানন্দপুর
হাওড়া-বর্ধমান মেন রেলপথে জনবহুল স্টেশন ব্যান্ডেল। হুগলি জেলার এই স্টেশনের খুব কাছেই দেবানন্দপুর। টোটোয় দশ মিনিটের পথ। একদা অখ্যাত গ্রামটি বিশ্বের বাঙালিদের কাছে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে একজন মহান সাহিত্যিকের জন্য। তিনি অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১২৮৩ বঙ্গাব্দের ৩১ ভাদ্র (১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর) এই গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। যদিও এটা পিতৃভূমি ছিল না। পিতৃপুরুষের নিবাস ছিল কাঁচড়াপাড়ার মামুদপুরে৷ বর্তমানে উত্তর ২৪ পরগনায়। দেবানন্দপুর ছিল শরৎচন্দ্রের বাবার মামারবাড়ি৷
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
শরৎচন্দ্র জীবনের বেশ কয়েক বছর ছিলেন জন্মস্থান দেবানন্দপুরে। পড়াশোনা করেছেন গ্রামের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায়। ঘুরে বেড়াতেন শান্ত, নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতির বুকে, গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত সরস্বতী নদীর তীরে। এইভাবেই সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক রচিত হয়েছিল।
সামনেই কথাসাহিত্যিকের জন্মদিন। বর্তমানে কেমন আছে শরৎচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত সেই গ্রাম? কী অবস্থায় আছে তাঁর জন্মভিটে? জানতে ইচ্ছে হল। হাতে সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রোদ ঝলমলে শরৎ-সকালে পৌঁছে গেলাম দেবানন্দপুরে।
আরও পড়ুন-রিয়েল মাদ্রিদে মুখ্যমন্ত্রী-সৌরভ, খতিয়ে দেখলেন আধুনিকীকরণ ও পরিকাঠামো উন্নয়ন
টোটো থেকে নামামাত্র দেখা পেলাম কয়েকজনের। তাঁরা দেখিয়ে দিলেন জন্মভিটের পথ। খুব দূরে নয়, দশ পা যেতেই বাঁদিকে বাড়িটি। লেখা ‘সাহিত্যাচার্য শরৎচন্দ্রের বৈঠকখানা গৃহ’। পাশেই ছোট্ট লোহার গেট। ঢুকে পড়লাম। বাঁদিকে বৈঠকখানা। রয়েছে পরিচ্ছন্ন দালান। দুই পা এগোতেই সামনে শরৎচন্দ্রের সাদা পূর্ণাবয়ব মূর্তি। বই হাতে তিনি দাঁড়িয়ে। নিচে ফলকে লেখা ‘ভারতীয় ভাষার অক্ষর সমুদ্রের এক অসামান্য নাবিক অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’।
মূর্তিটি ডানহাতে রেখে এগিয়ে গেলাম বাঁদিকে। তারপর ডানদিকে বাঁক। একেবারে শেষে চোখে পড়ল হলুদ সূতিকাগৃহ। ছোট্ট এই ঘরটিতেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন মহান সাহিত্যিক, যাঁর লেখা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় সবচেয়ে বেশি অনূদিত, যাঁকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন বিশ্বকবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন-অনন্তনাগে গুলির লড়াই, বারামুলায় নতুন সংঘর্ষে নিকেশ ২ জঙ্গি
জন্মভিটের চারদিকে সবুজের সমারোহ। সর্বত্র পরিচ্ছন্নতার ছাপ স্পষ্ট। সারা বছর বহু সাহিত্যপ্রেমী আসেন বাড়িটি দেখার টানে। তবে শীতের সময় লোক সমাগম হয় বেশি।
ভিটের অদূরেই রয়েছে প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালা। বর্তমানে ভগ্নপ্রায়। এই পাঠশালায় লেখাপড়ার প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র।
জন্মভিটের কাছেই শরৎচন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার। সেখানে আছে ছোট্ট মিউজিয়াম। সংরক্ষিত শরৎচন্দ্রের ব্যবহৃত আরামকেদারা, ছড়ি, তাঁর হাতে লেখা দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চিঠি, দুষ্প্রাপ্য ছবি। শরৎচন্দ্রের জন্ম, শৈশব, যৌবন, বার্ধক্যের বিভিন্ন পর্যায় মাটির মডেলের আকারে ৫৭টি কাচের বাক্সে সংরক্ষিত আছে এই সংগ্রহশালায়। ভবনের সামনে আছে সাহিত্যিকের মূর্তি। এই জায়গাটিও দর্শনীয়। ঘুরে দেখালেন পাঠাগার-সম্পাদক অজামিল কোলে।
আরও পড়ুন-ভারতে আইএস জঙ্গি শিবির! ৩০ জায়গায় তল্লাশি চালাল এনআইএ
কীভাবে পালিত হয় তাঁর জন্মদিন? দেবানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রুমা পাল জানালেন, ‘‘আমরা ৩১ ভাদ্র শরৎচন্দ্রের জন্মদিন পালন করি। অংশ নেয় স্থানীয় বিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, বিভিন্ন ক্লাব সংগঠন এবং এলাকাবাসীরা। অনুষ্ঠান শুরু হয় বর্ণাঢ্য প্রভাতফেরির মধ্যে দিয়ে। মূল মঞ্চে বক্তব্য রাখেন অতিথিরা। আয়োজিত হয় সাহিত্যসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।’’
উপপ্রধান পীযূষকান্তি ধর বললেন, ‘‘শরৎচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত দেবানন্দপুর গ্রামটিকে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি। স্টেশন থেকে রয়েছে পাকা রাস্তা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। খুব সহজেই তাঁর জন্মভিটেতে পৌঁছনো যায়। একটি হোমস্টে তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। হয়তো আগামিদিনে বাস্তবায়িত হবে।’’
আরও পড়ুন-নিপা আতঙ্কে আইসিএমআর! নতুন অ্যান্টিবডি নিয়ে ট্রায়ালের সম্ভাবনা
পঞ্চায়েত সদস্যা চন্দ্রিমা নন্দী প্রামাণিক বললেন, ‘‘সরস্বতী নদীর তীরে একটি বটগাছের নিচে বসে তিনি লিখতেন। জায়গাটা এখনও আছে। এই অঞ্চলের ছবি ফুটে উঠেছে বিভিন্ন লেখায়, তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলো পড়লেই বোঝা যায়। আমরা চাই আরও অনেক মানুষ দেবানন্দপুর গ্রামের কথা জানুক। গ্রামে আসুক।’’
দেবভূমিতে পুণ্য অর্জন হয় শুনেছি। একজন সাহিত্যিকের জন্মভিটে ঘুরে মনের মধ্যে জন্ম নিল পুণ্য অর্জনের আশ্চর্য আনন্দ। টোটোয় চেপে স্টেশনে ফেরার সময় মনে মনে বললাম, ভাল থেকো চিরসবুজ দেবানন্দপুর। স্নেহ-মমতায় যত্নে আগলে রেখো শরৎ-স্মৃতি। আবার দেখা হবে।
আরও পড়ুন-গিরিরাজকে চিঠি ডেরেকের
সামতাবেড়
হাওড়া জেলায় রূপনারায়ণ নদের তীরে ছবির মতো সুন্দর এক গ্রাম সামতাবেড়। পানিত্রাসের পাশেই। জীবনের ১২ বছর এই গ্রামে থেকেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তৈরি করেছিলেন সুন্দর একটি বাড়ি। এই বাড়িতে বসে তিনি রচনা করেছেন বহু কালজয়ী গল্প, উপন্যাস। বর্তমানে পানিত্রাস, সামতাবেড়ে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র। সারা বছর বহু মানুষ আসেন। ঘুরে দেখেন শরৎচন্দ্রের বাড়িটি। সময় কাটান রূপনারায়ণের তীরে।
আরও পড়ুন-পুলিশের সাফল্য: চুঁচুড়ায় নাবালিকা অপহরণে ধৃত ৫
বর্তমানে বাড়িটি কী অবস্থায় আছে? দেখে এলাম। দেউলটি রেলস্টেশনে নেমে টোটোয় পনেরো মিনিটের পথ। শরৎ মোড়ে নেমে বাঁদিকে একটু গেলেই ডানহাতে বাড়িটি। দোতলা, ব্রহ্মদেশীয় স্থাপত্যশৈলী অনুসরণে বানানো। বার্মা কাঠের আসবাবপত্রে সাজানো। মূল ফটক পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ল শরৎচন্দ্রের এক আবক্ষ মর্মরমূর্তি। পুরো বাড়িটা বাগান দিয়ে ঘেরা। এখানে গড়ে উঠেছে একটি মিউজিয়াম। কথাশিল্পীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নানা জিনিস এখানে সংগৃহীত রয়েছে। যেমন বিছানা, চেয়ার, লেখার ডেস্ক, জাপানি ঘড়ি, হুঁকো, বইয়ের তাক, চরকা ইত্যাদি। আছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের দেওয়া শ্বেতপাথরের রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। আজও নিত্যপুজো হয়।
স্থানীয় শরৎ স্মৃতি গ্রন্থাগারের সভাপতি সুমন মুখোপাধ্যায় জানালেন, ‘‘৩১ ভাদ্র এখানে আমরা শরৎচন্দ্রের জন্মদিন পালন করি। এ ছাড়াও শীতকালে আয়োজিত হয় শরৎমেলা। সারা বছর বহু মানুষ আসেন।’’