সংবাদে প্রকাশ, গত রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দেশের উপরাষ্ট্রপতি নতুন সংসদ ভবনের (New Parliament) গজদ্বারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছেন।
এই গজদ্বারটি কী?
আসলে ভারতের নতুন সংসদ ভবনের (New Parliament) ছ’টি দ্বার। এবং কী আশ্চর্য! এগুলির প্রত্যেকটি হিন্দু ধর্মীয় ভাবনার সঙ্গে অন্বিত। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করে তোলার সুস্পষ্ট অভিজ্ঞান।
সংসদ ভবনের শিল্প স্থাপত্য প্রকল্প বিষয়ক একটি নোটে বলা হয়েছে নতুন সংসদ ভবনের উত্তরের দ্বারটি গজ বা হাতির নামে নামাঙ্কিত। এখানে একটা হাতির মূর্তি বসানো থাকবে। বুঝিয়ে দেওয়া হবে উত্তরের দরজার দ্বারপাল হস্তী। ভারতীয় পুরাণ এবং হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস অনুসারে, হাতি মেধা, স্মৃতিশক্তি, সম্পদ ও প্রজ্ঞার প্রতীকস্বরূপ। গণতন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই গুণগুলি থাকবে, এমনটাই জন-প্রত্যাশা। সেজন্যই উত্তরের দরজায় হাতির অধিষ্ঠান।
বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে উত্তর দিকটির গ্রহ হল বুধ। এই গ্রহ হল উন্নত মেধার উৎসস্বরূপ। আর উত্তরের অধিপতি হলেন কুবের, সম্পদের দেবতা। উত্তরের দরজায় মেধার সঙ্গে প্রজ্ঞার, সম্পদের সঙ্গে বোধের সংযোগ ঘটাতেই নাকি বেছে নেওয়া হয়েছে গজ বা হস্তীকে। এইভাবে বাস্তু মেনে সংসদ ভবনের বাকি পাঁচটা দরজাতেও লাল বেলে পাথরের মূর্তি বসানো হয়েছে।
দক্ষিণের দরজায় রয়েছে অশ্ব বা ঘোড়ার মূর্তি। অশ্ব সদা-সতর্ক, সদা-প্রস্তুত। সে যেমন শক্তির প্রতীক তেমনই সহনশীলতার প্রতিভূ। সামর্থ্য এবং দ্রুতি, দুটোরই অধিকারী সে। সব মিলিয়ে অশ্ব নাকি গণতান্ত্রিক ভারতের সরকারের প্রতীকী তাৎপর্য বহন করছে।
পূর্ব দ্বারে অধিষ্ঠান করছেন গরুড় দেবতা। বিষ্ণুর বাহন এই গরুড় এখানে একযোগে আম-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার এবং দেশের প্রশাসকবর্গের চারিত্রিক গুণাবলির প্রকাশস্বরূপ। বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, পূর্ব দিক হল উদীয়মান সূর্যের দিক। তাই সেই দিকে বিষ্ণু-বাহনের অবস্থান যুগপৎ আশা, বিজয়মহিমা ও সাফল্যের বার্তা দিচ্ছে। স্মর্তব্য, সূর্যই বিষ্ণুরূপে পূজিত হন।
আরও পড়ুন-আদানি মামলার তদন্তে নয়া কমিটি গঠনের আর্জি সুপ্রিম কোর্টে
বাকি তিনটি দ্বারের একটিতে রয়েছে মকরের মূর্তি, একটিতে শার্দূলের অধিষ্ঠান এবং আর-একটিতে হংস বিরাজমান। মকর একটি পৌরাণিক প্রাণী। জলজ প্রাণী। তার শরীর বিবিধ প্রাণীর নানাবিধ শারীরিক অঙ্গ দ্বারা গঠিত। ফলত, মকর বিবিধের মধ্যে ঐক্যের প্রতীকস্বরূপ। অন্য দিকে শার্দূল সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী। দেশের জন শক্তির প্রতীক এই প্রবল শক্তিধর প্রাণিটি। উত্তর-পূর্ব দ্বারে হংসের অধিষ্ঠান। হংস প্রজ্ঞা ও আত্মবীক্ষণের প্রতীক। গণতন্ত্রে জনগণের এই দুটি গুণ থাকতেই হবে। তাই হংসকে বসানো হয়েছে উত্তর-পূর্ব প্রবেশ দ্বারে।
এই ছ’টি দ্বারের মধ্যে তিনটি বিশেষ দ্বার। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের দিন সংসদে প্রবেশের পথ। এই তিনটি দ্বার জ্ঞান, শক্তি ও কর্মের প্রতিভূ। আবার এগুলির মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত ভারতের জ্ঞান, দেশপ্রেম ও শিল্প সৌকর্যের পরম্পরা। এই দ্বারগুলির নামকরণ ও স্থাপত্যে প্রবলভাবে হিঁদুয়ানির গন্ধ। ‘ইহাই ভারতের সনাতন পরম্পরা’ জ্ঞানে সেটুকু যদি হজমও করে নিই, তাহলেও কয়েকটি বিষয় কিছুতেই হজম হচ্ছে না।
এই যে সম্প্রতি সব ক’টি প্রধান সংসদীয় কমিটিতে অবিজেপি সাংসদদের ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে, সেটা কি আদৌ সুস্থ গণতন্ত্রের লক্ষণ? চিরকাল দেখে এসেছি বা জেনে এসেছি, পররাষ্ট্র নীতি-বিষয়ক সংসদীয় কমিটিতে সভাপতিত্ব করেন একজন বিরোধী পক্ষের সাংসদ। আর কিছুই নয়, সেটার মাধ্যমে সরকারের বিদেশ নীতির ব্যাপারেও যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা তুলে ধরা হয়। বর্তমানে সেই পদটিও অধিকার করে রেখেছেন রাজস্থানের এক বিজেপি-সাংসদ।
সংসদে (New Parliament) বিজেপি-বিরোধী কোনও পক্ষ যদি গুরুত্বপূর্ণ কোনও ইস্যুতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে বাধা পাওয়াটাই এখন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়ে বিরোধী সাংসদরা সংসদ অচল করার পথ নেন। সরকার যদি বিরোধীপক্ষকে বলতে দেন, তাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনেন, তাহলেই এ-নিয়ে গোল বাধে না। কিন্তু বিজেপি সরকার তো সেসব শোনার পাত্রই নয়।
এদেশে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বদলে একতরফা বক্তৃতাবাজি বেশি পছন্দ করেন। এমনকী রোজকার প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁর উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদানের দায়ভার বহন করতে হয় তাঁর দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রীকে।
ব্রিটেনে সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য প্রতি বুধবার দুপুরে প্রায় ৩০ মিনিটের একটি প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে হাউস অব কমন্সে। এই পর্বে বিরোধী দলনেতা ও পিছনের সারির সাংসদরা ছোট ছোট প্রশ্ন করার সুযোগ পান। এদেশে তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই আজও।
আর-একটা কথা না বললেই নয়। এদেশে ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে স্পিকার বিরোধী পক্ষের সাংসদদের যাবতীয় মুলতুবি প্রস্তাব এক এক করে বাতিল করে দেন। যাবতীয় সংশোধনী বিলকে একজোট করে আলোচনা ছাড়াই ধ্বনি ভোটে বাতিলের সুযোগ করে দেন। ‘ডিভিশন’ জারি করে কোনও বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর শোনার অভ্যাসও তাঁর নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী পক্ষেরও যে একটা ভূমিকা আছে এবং সেটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা সুস্পষ্টভাবে বোঝানোর জন্য এগুলোর দরকার ছিল।
সে-সব না করে নতুন সংসদ ভবনে (New Parliament) খানকতক মূর্তি বসিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এই সত্যিটা মোদিবাবুরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, তত মঙ্গল।