আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও ভৌগোলিক অবস্থান যাই হোক না কেন, আমরা সর্বপ্রথমে ভারতীয়। সে কারণে ভারতের চন্দ্র অভিযানে সাফল্যের কারণে আমরা প্রবল গৌরবান্বিত বোধ করছি।
আরও পড়ুন-কোন্দলে
ভারত অখণ্ড। ভারত সনাতন। ভারত শাশ্বত। তাই ভারতের একটা অংশকে কিংবা ভারত-ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট কালখণ্ডকে কেউ আমার বলে দাবি করতে পারে না। আমরা সবাই, প্রত্যেক ভারতীয়ই একটি চিরায়ত প্রবহমানতার অঙ্গ। সেই প্রেক্ষিতে চন্দ্রাভিযানের সাফল্য কোনও সুনির্দিষ্ট সময়কালের সাফল্য নয়। কমপক্ষে ছয় দশক ধরে এই সাফল্যের লক্ষ্যে অগণিত ব্যক্তি নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং করে চলেছেন। আজ তাঁদের সবার কথা আমাদের স্মরণ করা আবশ্যক। আমরা অবশ্যই চন্দ্রযান ৩-এর সাফল্য-মুহূর্ত উদযাপন করব, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের উচিত ইতিহাসের উদযাপন সুনিশ্চিত করা। কালের যাত্রাপথটিকে অভিনন্দিত করা। আমরা অবশ্যই বিস্মৃত হব না পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর আবদানের কথা।
আরও পড়ুন-বিদেশ সফর সফল, আসছে বিনিয়োগ: কলকাতায় ফিরে বললেন মুখ্যমন্ত্রী
তিনি ভারতবর্ষে বিজ্ঞানমনস্কতাকে উৎসাহিত করেছিলেন, যাবতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রণোদনা জুগিয়েছিলেন। বিজ্ঞান গবেষণার কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিক্রম সারাভাইয়ের অবদানও অনস্বীকার্য। নতুন সংসদ ভবনে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উচিত নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা। বৈজ্ঞানিক সাফল্যের উদযাপনে রাজনীতিকদের ঘিরে উল্লসিত হওয়ার পরিবর্তে আমাদের উচিত বিজ্ঞান সাধকদের বন্দনা করা। নতুন সংসদ ভবনে স্থাপন করা উচিত বিক্রম সারাভাই, আবদুল কালাম, সতীশ ধাওয়ান, হোমি ভাবার মতো ব্যক্তিত্বদের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আজ আমরা যেখানে পৌঁছেছি, সেটা এঁদের মতো ব্যক্তিদের কারণেই সম্ভব হয়েছে। তাঁদের চিন্তা-ভাবনা-দর্শন-দূরদৃষ্টি আমাদের অগ্রগতির কারণ, এ-কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।
আরও পড়ুন-বোনাসের দাবিতে চা-শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলন, পাশে তৃণমূল সাংসদ
একইসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীদেরও এ-বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা বিস্মৃত হলে চলবে না। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত ভাবে এই মহতী-যাত্রার সাফল্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁর যাঁরা পূর্বসূরি, যাঁরা এই বিজয় পথনির্মাণের পথিকৃৎ, তাঁদের অবদান কোনও অংশে ন্যূন কিংবা বিস্মরণযোগ্য নয়। অন্য দেশের মহাকাশযানকে পেছনে ফেলে আমাদের চন্দ্রযান যখন চাঁদে অবতরণ করে তখন গর্বে বুক ফুলে যায়।শুধু চন্দ্রযান ৩-এর চাঁদের বুকে পৌঁছনোর জন্য নয়, আরও একটি কারণে আমি উৎফুল্ল বোধ করছে। কারণটি হল, শেষ পর্যন্ত কুসংস্কারকে পরাস্ত করে বিজ্ঞানের বিজয় সম্ভবায়িত হয়েছে। মুখ খোলার আগে আমাদের গবেষণা, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানোপার্জন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতি আস্থা রাখাটা আবশ্যক। যে কোনও বিষয়ে আমরা যেন যথেচ্ছ কথাবার্তা বলে না ফেলি সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক। কোনও কিছু বলে ফেলার আগে যেন তা পরিণাম ও প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেবিষয়ে সতর্ক থাকি। গণেশের হস্তী-মস্তক প্লাস্টিক সার্জারির দৃষ্টান্ত, একথা আমরা কোন আক্কেলে বলি?
আরও পড়ুন-বোনাসের দাবিতে চা-শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলন, পাশে তৃণমূল সাংসদ
শ্রীশ্রী গণেশের বিরাটত্ব ও মহিমা নিয়ে আমাদের কোনও সংশয় নেই, তেমনই গণেশের মাথাটি প্লাস্টিক সার্জারি করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, এরকম ভাবনারও কোনও যৌক্তিক কারণ নেই। একইভাবে মহাভারতের একটা বড় অংশ জুড়ে স্টেম সেল সায়েন্সের বিষয়ে আলোচনা রয়েছে, এমন কথা বলাটাও কি ঠিক? কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে বিষয় থাকাটা অযৌক্তিক বা অন্যায় নয়, কিন্তু যুক্তিবিবর্জিত বিশ্বাস গ্রহণীয় নয়। ভারতীয় হিসেবে বিশ্বাস এবং যুক্তিবাদ, উভয়ের প্রতিই আস্থা রাখা যায়। কিন্তু যখন অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার আর প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের ফসলকে পদদলিত করতে চায় তখন আমাদের অন্তরাত্মা ত্রস্ত হয়। ভারতীয় হিসেবে যুগপৎ কোনও বিশেষ ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি আস্থা এবং নিখাদ যুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কোনও অসুবিধা নেই।
আরও পড়ুন-বেড়াতে যাওয়ার জন্য চালককে গাড়ি না দেওয়ায় খুন বৃদ্ধ!
অথচ, আমাদের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানমন্ত্রী বলেন, তিনি ডারউইনের তত্ত্ব খারিজ করতে চান। অপর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আইনস্টাইনকে বাতিল করার পক্ষপাতী। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী বলে বসলেন, পিথাগোরাসের আগে নাকি আমরা পিথাগোরসের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছি। ঈশ্বর রক্ষতু, বিজ্ঞানকে বাতিল করে বৈজ্ঞানিক বিষয়ে সাফল্যের উদযাপন করা যায় না। বিজ্ঞানকে অবহেলা করে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাফল্যের সহায়তা লাভ করা যায় না। তাই এই নেতৃবর্গের কাছে সবিনয় প্রার্থনা, আপনারা এসব বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন। বিস্মৃত হবেন না, আপনারা একটি মহতী সাধারণতন্ত্রের মন্ত্রী। এরকম আলটপকা মন্তব্য আপনাদের মানায় না। এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য আপনাদের পদের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অন্ধ্রপ্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় স্টেম কোষের বিষয়ে এরকম আজব মন্তব্য করেছেন। একজন মুখ্যমন্ত্রী মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট এবং মহাকাশ অভিযানের কথা বলেছেন। এসব অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। বিজ্ঞানের বিষয়ে অবৈজ্ঞানিক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতেই হবে যাতে আমরা আরও চন্দ্রযান, আরও আদিত্যযান সংক্রান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারি। যাতে আমরা উন্নততর ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ যজ্ঞে শামিল হই।
আরও পড়ুন-চিরন্তনী ইন্ডিয়ান আইডল
স্মর্তব্য, চন্দ্রযান অভিযানের সাফল্য আইআইটি থেকে পাশ করা ব্যক্তিদের হাত ধরে আসেনি। আমরা আইআইটিগুলির পোষণ করতে ব্যস্ত। কিন্তু আইআইটি থেকে পাশ করে বেশির ভাগ ব্যক্তিই বিশ্ববাজারে বৃহত্তর ধনতন্ত্রের সেবা করতে যায়। সুতরাং আইআইটিতে অধিকতর গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের ইসরোর মতো অন্যান্য বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি দৃষ্টি প্রদান করা আবশ্যক। চন্দ্রযানের সাফল্যের পেছনে ৩১ জন বঙ্গজের অবদান রয়েছে। তাঁরা কেউই কিন্তু আইআইটি-র মতো প্রতিষ্ঠানে সফল নন। আরও দুটি বিষয়ে আলোকপাত করা আবশ্যক। আমরা ইসরোর সাফল্য নিয়ে মাতামাতি করছি কিন্তু দেভাস-আন্দ্রিক্স কেলেঙ্কারির বিষয়টা আনালোচিত থেকে যাচ্ছে। এই মামলায় কয়েক মাস আগে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে, ৩৩ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানের সাফল্যের সঙ্গে, উৎকর্ষের সঙ্গে রাজনীতিকে না জড়ানোই শ্রেয়। যদি আমরা বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি নিশ্চত করতে চাই, তবে এদেশে বিজ্ঞান গবেষণা ও সাধনাকে রাজনীতির নিগড় থেকে মুক্ত করতে হবে। আমলাতন্ত্রের নাগপাশ থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধিনিষধের বেড়াজালে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলিকে আটকে রাখলে এটা কখনও সম্ভব হবে না। ন্যাশনাল কোয়ান্টাম মিশনের শরিক হয়েছে ভারত। এটা আনন্দের কথা, গর্বের কথা। শাসকের পদে রাম-শ্যাম-যদু-মধু যেই আসুক না কেন, কোয়ান্টাম মিশনে ভারত চিরস্থায়ী অবদান রাখতে চলেছে। শাসকের পরিবর্তনে সেই গর্বিত ঐতিহ্যের কোনও পরিবর্তন হবে না।
আরও পড়ুন-স্পেন থেকে দুবাই, মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে বিনিয়োগ পরিবর্তনের বাংলায়
ভারতীয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দুঃখের বিষয় এই যে, আমাদের সরকার ইসরোর ব্যয়বরাদ্দ ৮ শতাংশ কমাতে আগ্রহী। গভীরতর দুঃখের বিষয় এই যে, গবেষণা কার্যের জন্য অর্থ বিনিয়োগে আমাদের সরকার বড়ই অনাগ্রহী। এটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লজ্জাজনক বিষয় যে, আমাদের সরকার বিজ্ঞান গবেষণার খাতে মোট জাতীয় উৎপাদনের ০.৬ শতাংশের বেশি ব্যয় করেন না। অথচ বিজ্ঞান নিয়ে বড়াই করার সময় ছাতি ফুলিয়ে এগিয়ে যায়। বিজ্ঞান গবেষণায় ০.৪ শতাংশ বিনিয়োগ সরকারের আর ০.২ শতাংশ বিনিয়োগ কর্পোরেট সংস্থা সমূহের। অথচ এই কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে ২০১৯ থেকে ৪ লক্ষ কোটি টাকার ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই ছাড় দেওয়ার জন্য বিজ্ঞান খাতে তাদের অবদান আর অন্তত ০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করতে বাধ্য করতে পারত না কেন্দ্রীয় সরকার? এই বৃহৎ পুঁজির কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সুবিধার্থে ব্যাঙ্ক ঋণের ১২.৫ লক্ষ কোটি টাকা মুছে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই টাকাটা জনগণের জমানো অর্থ। ক’দিন আগেই সংসদ সদস্যের বৃহৎ কর্পোরেট হাউসটি সরকারের কাছ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়ের সুবিধা পেয়েছে।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তো বৈজ্ঞানিক গবেষণাকার্যে বিনিয়োগ করা যেত। সুতরাং, সমস্যাটা সম্পদের স্বল্পতা নয়, সম্পদের ভুল পথে চালনা। এটা বন্ধ না হলে ভারতের বিজ্ঞান নিয়ে গর্ব করাটা অর্থহীন।