দেবর্ষি মজুমদার বোলপুর: যখন বারোয়ারি থিমপুজোর জৌলুসের রমরমা, তখনও ঐতিহ্যবাহী পুজো মানুষের মন কাড়ে। আর এই তালিকার অন্যতম শান্তিনিকেতনের কাছে সুরুল গ্রামের সরকার বাড়ির পুজো। হারিয়ে যাওয়া দিনের স্বাদ ফিরিয়ে দিতে পারে বীরভূমের এই রাজবাড়ির পুজো। এক সময় জেলা ছাড়িয়ে গোটা বাংলায় বিখ্যাত ছিল। সেই জাঁক আর নেই। তবে আজও এই রাজবাড়ির পুজো কিংবদন্তীর মতো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আগে নবমীর দিন রাজবাড়ির দেউড়ির খাস ঝুলবাড়ান্দায় রাজ পরিবারের মহিলারা দাঁড়াতেন। ওখান থেকেই তাঁরা দেখতেন এলাকার সাঁওতাল মহিলা-পুরুষদের মাদল নিয়ে নাচ। সে ছবি আজ ইতিহাস! সুরুল পরিবারের ইতিহাস অষ্টাদশ শতাব্দীর।
আরও পড়ুন-গদ্দারের নন্দীগ্রামে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার বিজেপির অন্দরে ঝড়, প্রকাশ্যে বিদ্রোহ দুই বিজেপি নেতার
এক সময় এখানেই ইলামবাজারে জাহাজের পাল তৈরির কেন্দ্র ছিল। অজয় নদের সাহেব ঘাটে সেই সময় নোঙর গাড়ত ফরাসি ও ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ছোট ছোট জাহাজগুলি। জনশ্রুতি যে, পাল তৈরির জন্য খ্যাত সুরুলের জমিদারদের ‘সরকার’ পদবি আসেছ পাল সরবরাহকারী হিসাবে। তখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি এঁদের থেকেই পাল কিনত। পারিবারিক পুজোর মধ্যে সুরুল ছোটবাড়ি, মুখুজ্জেবাড়ি, মজুমদার বাড়ি এবং গোস্বামীবাড়ির কথা বলা যায়। সুরুল বারোবাড়ির পুজো প্রায় তিনশো বছরের পুরানো। এই পুজোর পত্তন করেন জমিদার শ্রীনিবাস সরকার। সরকার বাড়ির দেবোত্তর ট্রাস্টের ম্যানেজার অসিতবরণ সরকারের এক আত্মীয় জানান, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন বর্ধমান থেকে। তাঁরা বর্ধমানের বাসিন্দা ছিলেন। তিনশো বছরেরও আগে তাঁরা সুরুলে গুরুদেবের বাড়ি আসেন এবং এখানেই থেকে যান। তখন থেকেই পারিবারিক নিয়ম ও ঐতিহ্য মেনে আজও দুর্গাপুজো হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন-জিতলে সিরিজ, ইন্দোরেও বৃষ্টির আশঙ্কা, আজ ফের ভারত-অস্ট্রেলিয়া
রাজবাড়ির মন্দিরে টেরাকোটার কাজ চোখ জুড়ানো। পাঁচটি চূড়ো ও পোড়ামাটির কাজের জন্য খ্যাত সরকার বাড়ির মন্দির। ১৭৫৩ বঙ্গাব্দ ১২৩৮ সালে এখানে কয়েকটি মন্দির নির্মিত হয়। সুরুলের জমিদার বাড়ি আগলে রেখেছে ৩৫০ বছরেরও বেশি পুরনো মন্দিরগুলি। মুর্শিদাবাদ থেকে তাজেম শেখ, সাজ্জাদ মণ্ডল, কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্র লক্ষণ বাগদি ও সর্বেক্ষণ বিভাগের প্রাক্তনীদের তত্ত্বাবধানে মন্দিরের হৃতগৌরব আজ পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে। চলতি বছর ৬ জুলাই হয় মন্দিরের দ্বারোদঘাটন হয়েছে।’ পুজোর চারদিন সমস্ত নাটমন্দিরে লাগানো হয় ঝাড়বাতি। রাজপুরোহিত ভৃগুরাজ ভট্টাচার্য ও আচার্য তরুণ ভট্টাচার্যের মতো বিদগ্ধ পুরোহিত পঞ্জিকা দেখে নির্ঘন্ট তৈরি করে দিলে তা মেনেই নবপত্রিকা স্নান থেকে প্রতিমা নিরঞ্জন সবটাই হয়।
আরও পড়ুন-বুক ফুলিয়ে গর্ব করব না লজ্জায় মুখ লুকোব
মৃন্ময়ী মূর্তি আর ডাকের সাজে অভিনব রূপ পায় সুরুল রাজবাড়ির প্রতিমা। মশাল জ্বালিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জনের দৃশ্য দেখবার মতো। রাজবাড়ির পক্ষে সুরুল আগমনী সমিতি সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীতে যাত্রার আয়োজন করে। বড় ও ছোট রাজবাড়ির তরফে পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার চল আজও আছে। তবে প্রসাদ খেতে দুই বাড়িতেই যান ভাগাভাগি করে। বড়বাড়ির বংশধর কল্লোল সরকারের কথায়, ‘আধুনিক মূর্তিতে মহিষমর্দিনীর রূপ ঠিকমতো পাওয়া যায় না। কিন্তু এখানে মায়ের রূপ আলাদা। তাঁর গোলাকার মুখ, দিঘল কুপিত চোখই প্রকৃত মহিষমর্দিনী রূপ। ভবিষ্যতেও এই রূপ অপরিবর্তিত থাকবে এখানে।’