আমার জেলা মালদহ। এখানে আজানের সুরে শঙ্খের ধ্বনি ভাসে। বৌদ্ধবিহারেও একদা বুদ্ধ স্তূতির মন্ত্রোচ্চারণ হত। সেই সমন্বয় বিনষ্ট করা সহজ নয়। তবুও একটা প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কখনও রাজনীতির বৈপরীত্যে, কখনও সাম্প্রদায়িক প্রচারে, আবার কখনও অকারণেই দরিদ্র মানুষদের পরস্পরকে নানা প্রচারে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সতর্কভাবে এই অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার সব সময় চেষ্টা চালাচ্ছেন। নানা প্রকল্প ঘোষণা করে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে ভরসা জোগাচ্ছেন। যেদিন মণিপুর থেকে শ্রমিকদের নিথর দেহ ফিরেছিল মালদহে, মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেছিলেন শ্রমিকদের জন্য ভাবা দরকার, কেন এরা ভিন রাজ্যে যাবে। নিজের রাজ্যে অল্প উপার্জনে নিরাপদে কাজের পরিকল্পনা করার চেষ্টা করছেন। মালদহের মতো প্রাচীন শহরে উপার্জনের পথ কঠিন হলেও একান্ত অসম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের সেই পথগুলির সন্ধান করতে বলছেন।
অনেক টাকার হাতছানিতে দূরে দূরে পাড়ি দিয়ে নিথর দেহে বাড়ি ফেরার থেকে অল্প আয়ে সকলের সঙ্গে থাকার গুরুত্ব আজ সকলেই অনুভব করছেন। এই যে সমৃদ্ধ শহর, এর চারপাশে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট উপার্জনের ক্ষেত্র। আমরা যদি সেগুলোকে নিয়ে ভাবি তবে প্রাচীন ‘গৌড়বঙ্গ’ আমাদের মালদহ আবার তার হৃত গৌরব ফিরে পাবে। মালদহ নামটি উচ্চারণ করলেই মনে হয় আদিনা মসজিদ, কৃষ্ণ রায়ের মন্দিরের ধুলো মাখা মাটির কথা। যেখানে একই সঙ্গে ভেসে আসে ভোরের ভৈরবীর সুরের সঙ্গে সন্ধ্যার সুলতান রাগের আলাপ। ছেদ-হীন, ভেদ-হীন এক অনাবিল জীবন চর্যা। আর মনে ভেসে ওঠে আমের কথা।
আরও পড়ুন-সাপের কামড়! আতঙ্ক নয়
বর্তমান মালদহের আয়তনগত অবস্থান ৩৭৩৩ বর্গ কিলোমিটার। উত্তর-পশ্চিমে বিহার, উত্তর-পূর্বে দুই দিনাজপুর, দক্ষিণে মুর্শিদাবাদ এবং পূর্বে ঝাড়খণ্ড। পূর্ব সীমানা দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদী বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে মালদহকে। দুটি মহকুমা নিয়ে গঠিত এই জেলা মালদহ সদর আর চাঁচল। ১৫টি থানা, দুটি পুরসভা, ১৫৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত আর ৩.৭০১টি গ্রামের বন্ধনে গড়া এই জেলা। থানার সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী মালদহের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৮ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মালদহের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের সঙ্গে নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলি বিশেষত বিহারের পূর্ণিয়া, ঝাড়খণ্ড এবং মুর্শিদাবাদ। এই কারণে মালদহের অবস্থান অতি-গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন-চারিদিকে যা যা ঘটে চলেছে
বাংলাদেশের রাজশাহি জেলা অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু। অবিভক্ত ভারতে মালদহ এবং রাজশাহির পারস্পরিক ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পূর্ণিয়াও সুপ্রাচীন সময় থেকে ব্যবসায়িক কারণে সমৃদ্ধ, মুর্শিদাবাদের সংযোগের কথা তো বলাই বাহুল্য। আমি মালদহের নানা অঞ্চলে যখনই ঘুরে বেড়াই তখনই চোখে পড়ে এই অঞ্চলের গৌরব আর ঐতিহ্য। কোথাও কোনও বিভেদ নেই, অঞ্চল-ভেদে নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে অটুট এক জীবনচিত্র। তখন মনে হয় পাণ্ডিত্য নয়, এক সামগ্রিক মরমী ধারার আলোচনা প্রয়োজন। মালদহ জেলার এই সমন্বয়ী মরমিয়া বন্ধন নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। অনেক পণ্ডিত মানুষ অনেক বড় বড় ঐতিহাসিক আলোচনা করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে বুঝতে পারেনি। তাই আমাদের মালদহ আজ দুষ্কর্মের করিডর হিসাবেই খবরের পাতায় উঠে আসে। আর বারবার আম উৎপাদনের জেলা বলেই শুধু প্রচারিত হয়। পর্যটকেরা আসেন মালদায়, তাঁরা মন্দির দেখেন, মসজিদ দেখেন। তাঁরা ইতিহাসের তথ্যটুকু দেখে তৃপ্ত হয়ে ফেরার পথে পাড়ি দেন। একাকী পড়ে থাকে মালদার সমন্বয়ী তথ্যের সম্ভার। সুপ্রাচীন গৌরব গাথা নীরবে চোখের জল ফেলে। কেউ মনে করে না ‘গৌড়পুরা’ অঞ্চলের কথা।
আরও পড়ুন-AITT-তে ভালো ফল ITI প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের, বাংলার টপারদের শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর
প্রাচীনকালের বৈয়াকরণ দার্শনিক পানিনির রচনায় গৌড়পুরা নামে এক বর্ধিষ্ণু জনপদের উল্লেখ আছে। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী এই ‘গৌড়পুরা’ সম্ভবত মালদার গৌড় অঞ্চল। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী প্রায় সকলেই এই ভাবনাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। যে অঞ্চলটির বিস্তার ছিল পুরনো গৌড় থেকে পুণ্ড্রবর্ধন বা পাণ্ডুয়া পর্যন্ত। এই দুটি নাম আমি মালদহর বহু ঐতিহাসিক এবং প্রাচীন মানুষের কাছে শুনেছি। বাল্যস্মৃতি থেকে এই দুটি নাম আজও মনে আছে। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে আমি বহু মানুষের কাছাকাছি যেতে পেরেছি। যখনি একটু সময় হয় প্রাচীন মানুষজনের কাছে পুরনো মালদহর কথা জানার চেষ্টা করেছি। আমার সেই চেষ্টাকেই অক্ষম লেখনীতে লিপিবদ্ধ করলাম। বিশাল আমাদের ভারত। বহু ভাষা-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় মিলেমিশে আজও থাকেন। যেসব অকারণ বিদ্বেষ মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তা শুধু সাময়িক নয়, সাধারণ মানুষ তা গ্রহণ করে না। সেই বিশাল ভারতের একটি অংশ আমাদের মালদা। মালদার অতীত ইতিহাস, আর সমন্বয়নী ভাবনাকে বিভেদের পাঁকে তলিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আসলে সচেতন ভাবে ইতিহাস ও সংস্কৃতির আলোচনা তাই জানতে হবে সব কিছু। এই জানার পথটিও হতে হবে সহজবোধ্য। যাতে প্রান্তস্পর্শী মানুষজনও বুঝতে পারেন কোন ঐতিহ্যের ধারক তাঁরা। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ঐতিহাসিকদের আজ গবেষণার কাজ করা খুব দরকার। শুধু মালদহই নয়, সারা ভারতই মিশ্র সংস্কৃতির আগার। একে একপাশ থেকে বিচার করলে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন-প্রাক্তন আরবিআই গর্ভনর উর্জিতকে ‘সাপ’ বলে তোপ দাগেন মোদি
সারা মালদহ জেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা সম্ভার। কালের বিবর্তনে তার অনেকটা হারিয়ে গিয়েছে। আবার রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং সাধারণ মানুষের অসাবধানতায় বহু ইতিহাস বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখানেই যন্ত্রণা, সবই করবেন পণ্ডিতরা, সবই দেখবেন রাজা অথবা পরবর্তী কালে রাজনৈতিক নেতারা। সাধারণ মানুষের কি কোনও কর্তব্য নেই? তাঁদেরও এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের জেলা, নিজেদের শহরের গৌরব সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে। জননেত্রীর প্রদর্শিত পথে ছোট ছোট করে গড়ে তুলতে হবে উপার্জনের পথ। আর যেন অন্য রাজ্য থেকে না ফেরে আমাদের রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের প্রাণহীন দেহ।