তখন ভারত ইংরেজের অধীন। গার্গী-মৈত্রেয়ীর দেশের মেয়েরা সেদিন বই স্পর্শ পর্যন্ত করতে অক্ষম। গ্রন্থ পাঠে বৈধব্য অবশ্যম্ভাবী— এহেন চরম মিথ্যাবাক্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে তাঁদের মন, অসুস্থ মানসিক পরিমণ্ডলে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হচ্ছে তাঁরা। তাঁদের জীবন অন্তঃপুরমুখী করে তুলতে গিয়ে অশিক্ষাকে তাঁদের কাঁধে তুলে দিয়েছেন সমাজ পরিচালকের দল। কিন্তু সব পারিবারের মধ্যে এই সামাজিক অবক্ষয় প্রবেশ করতে পারেনি। আমরা যখন ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণকে নারী জাগরণের সমর্থক বলে মনে করি সেই জাগরণের পথ বীজাকারে লুকিয়ে ছিল যেসব পারিবারিক কাঠামোতে সেইরকম পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন রানি রাসমণি।
আরও পড়ুন-হারানের নাতজামাই
পূর্বে সেই শতাব্দীর যে অন্ধকারময় নারী সমাজের কথা উল্লেখ করেছি, যে-সমাজ কুলীন ব্রাহ্মণের বিবাহ দানকেই ধর্ম বলে ভাবত। সতীদাহকে জীবনের পরম লক্ষ্য ও ন্যায় বলে স্বীকার করেছিল সেই সমাজভুক্ত নারীর দেখা আমরা শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের মধ্যে পাই না। তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে যে নারীরা আবর্তিত হয়েছিলেন তাঁরা আশ্চর্যভাবে যুগলক্ষণে ক্লিষ্ট নয়। এইসব নারীর জীবন এক প্রদীপের মতো জ্বলে উঠেছিল কলুষিত সমাজের আঙিনায়। রানি রাসমণি তার প্রথম প্রকাশ। তিনি সোচ্চারে সামাজিক বিপ্লব করেননি, কিন্তু তাঁর খোলা ছুরির মতো ঝকঝকে এক ব্যক্তিত্ব অত্যাচারী ইংরেজকেও ভীত করে তুলেছিল বারংবার।
আরও পড়ুন-পকসো আইনে সম্মতির বয়স কমানোর বিরুদ্ধে আইন কমিশন
বাংলার ১২০০ সাল, ১১ আশ্বিন, ইংরেজি ২৮ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩। রামপ্রসাদের ভিটে হালিশহরের কাছে কোণা গ্রামে এক মাহিষ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেন এক কন্যা। পিতা হরেকৃষ্ণ দাস পরমভক্ত, মা রামপ্রিয়াও ঈশ্বরমুখী। ভক্ত-ভগবানের সংসার তাঁদের, দরিদ্র কিন্তু ন্যায়-নীতি আর ভক্তির উচ্চ আদর্শে বাঁধা জীবন তাঁদের। রামপ্রিয়া দুই পুত্রের জন্মদানের পর এক কন্যা রাসমণির জন্মদান করেন। সদ্যোজাত অপরূপ সুন্দরী কন্যাকে দেখে আনন্দিত হলেন হরেকৃষ্ণ আর রামপ্রিয়া। এ যে স্নিগ্ধ চন্দ্রমা।
হালিশহরে মাতৃভক্ত রামপ্রসাদের ভিটে থাকলেও এই শহর বৈষ্ণবদের তীর্থস্বরূপ। কারণ, এই হালিশহরই প্রাচীন কুমারহট্ট। এই স্থানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর গুরু ঈশ্বরপুরীর জন্ম হয়। শ্রীচৈতন্য এই স্থানে এসে কীর্তন করেছিলেন এবং এই স্থানের মাটি বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন তিলক করে পরবেন বলে। আবার শ্রীচৈতন্য ভাগবত রচনাকার শ্রীল বৃন্দাবন দাসের বাড়িও এই অঞ্চলে। বৈষ্ণবপ্রধান এই অঞ্চলে রানি রাসমণির পিতা হরেকৃষ্ণ পরম ভক্ত রূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন। তাই তাঁর কন্যার জন্মের শুভ ক্ষণে তুলসীতলায় হরির লুট দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান সকল ভক্ত-সহ হরেকৃষ্ণ। মা রামপ্রিয়াদেবী কন্যার অপূর্ব মুখমণ্ডল দর্শন করে তাঁর নাম রাখেন ‘রানি’। পরবর্তী কালে মাতৃপ্রদত্ত নামটিই সত্য হয়ে দেখা দেয় রাসমণির জীবনে। তবে তাঁর রাসমণি নামটির পিছনে এক অলৌকিক কাহিনি লুকিয়ে আছে। রানির যখন দেড় বছর বয়স তখন পিতা হরেকৃষ্ণ একদিন রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন শ্রীধাম বৃন্দাবন শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা চলছে। গোপীরা কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়ে নৃত্য করছেন। কৃষ্ণের কালো রূপের সঙ্গে যেন আলোর বিজলি খেলে যাচ্ছে, এমন সময় রাসচক্র থেকে এক গোপী নাচতে নাচতে এসে রামপ্রিয়ার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই স্বপ্ন দেখে তিনি তা রামপ্রিয়াকে জানালেন। স্বপ্ন অনুসারে কন্যার নাম হল রাসমণি।
আরও পড়ুন-লাইভ-শো’তেই তুমুল হাতাহাতি পাক নেতাদের!
দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে রানি রাসমণি জীবন সহজ ছন্দে বেড়ে উঠেছিল। পিতা হরেকৃষ্ণ দরিদ্র হলেও নানা শিক্ষায় শিক্ষিত। রাসমণি পিতার কাছে ভাগবত, পুরাণাদি পাঠ শুনতেন। আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যেত ভাগবত শুনতে শুনতে তাঁর দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তিলকচন্দনে চর্চিত উন্নত নাসিকা, ছোট কপাল বেয়ে কেশের রাশি যেন ধরিত্রীকে ছুঁতে চায়। মা রামপ্রিয়া তাঁর কন্যার রূপ দেখে আদর করে বলতেন, ‘‘তুই রানি হবি মা!’’ একদিন নাকি বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে রাসমণি যজ্ঞডুমুর ফল দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্ত তিনি দেখলেও অন্য কেউ তা দেখতে পায়নি। বিস্মিত রাসমণি ঘটনাটি মায়ের কাছে জানাতেই রামপ্রিয়া আবার সেই একই কথা উচ্চারণ করেছিলেন, তুই রানি হবি। মায়ের কথা রাসমণির জীবনে সত্য হয়ে দেখা দিলেও তাঁর মাতৃসুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বালিকা বয়সেই মাতৃহারা হলে আত্মীয়া পিসি হলেন তাঁর অভিভাবক। বৈষ্ণব ভাবধারায় শৈশব অতিবাহিত ধরলেও রাসমণি আমাদের কাছে এক কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রূপেই বেশি পরিচিত। যখন সমাজে এই শাক্তভাবনা ও বৈষ্ণব ভাবনার মধ্যে সম্পর্ক দ্বন্দ্বের সম্পর্ক বেশ স্পষ্ট, তখন এই সমন্বয়কারী শক্তি এক নারীর মধ্যে কেমন করে উৎসারিত হল তা এক প্রশ্ন। তবে এই প্রশ্নকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাব তাঁর জীবনীর দিকে।
আরও পড়ুন-বিধায়কের শপথ কৌশলী তৃণমূল
মাত্র একাদশ বছরের রাসমণিকে গঙ্গায় স্নান করতে দেখে কলকাতার উঠতি বাবু পরিবারের প্রীতিরাম দাসের পুত্র রাজচন্দ্র দাসের পছন্দ হয়। প্রীতিরাম দাস নিজের প্রতিভাবলে বিরাট জমিদারি পত্তন করেন। তাঁর দুই পুত্র হরচন্দ্র ও রাজচন্দ্র। হরচন্দ্র অল্প বয়সে মারা গেলে রাজচন্দ্রই ছিলেন একমাত্র উত্তরাধিকারী। কিন্তু তাঁর জীবনেও দুর্যোগের ঘনঘটা। দু’-দু’বার পত্নী বিয়োগে তিনি বিবাহ করবেন না স্থির করেছিলেন কিন্তু রাসমণিকে দেখে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলেন। তাই কোণা গ্রামের কৃষককন্যা হলেন কলকাতা শহরের নব্যবাবুদের অন্দরমহল-আলো-করা রাজরানি। অবস্থার পরিবর্তন হল, পবিত্র দীপ্ত, স্নিদ্ধ প্রদীপটি মাটির তুলসীতলা ছেড়ে এল কোলাহলপূর্ণ মহলে। বিবাহের পর রানি রাসমণির সামাজিক উত্তরণের রূপটি ছিল অসাধারণ। কিন্তু অর্থ লাভে তিনি ভোগবিলাসে ডুবে গেলেন না। পিতার কাছে ভারতের পুরাণ ও মহাকাব্যের মধ্যে নিহিত যে নারীর জন্য নির্দিষ্ট কর্তব্য বর্ণিত হয়েছে, সেই আদর্শকে প্রতি মুহূর্তে অনুসরণ করতে লাগলেন। সংসারের কোনও কাজেই তিনি বিমুখ ছিলেন না। চারপাশে দাসদাসীর ভিড়, একটা আদেশ করলেই তা পালিত হবে। কিন্তু সেবা তিনি নিতেন না, তিনিই সকলকে সেবা করে যেতেন। রাজচন্দ্রও বিলাসিতা জানতেন না। তাই তাঁর পাশে যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন রাসমণি। স্ত্রী রাসমণির পরামর্শে রাজচন্দ্র দিন দিন বৈষয়িক উন্নতি করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যে কলকাতার তৎকালীন বাবুসমাজের বা অভিজাত সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয়দের একজন হয়ে ওঠেন। তাঁর সঙ্গে রাধাকান্ত দেব, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, অক্রূর দত্ত, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রভৃতি গণ্যমান্যদের যথেষ্ট পরিচয় ছিল। শোনা যায় রাজচন্দ্রের সঙ্গে লর্ড অকল্যান্ডেরও বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন-বাড়ল স্ট্যাম্প ডিউটিতে ছাড়ের মেয়াদ
১২৩০ সালে রাসমণির পিতা হরেকৃষ্ণ পরলোকগমন করেন, তাঁর শ্রাদ্ধকাজের জন্য গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে ভাঙা ঘাট দেখে সাধারণ মানুষের দুর্গতির অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করেন রাসমণি। তখন তিনি রাজচন্দ্রকে পাকাঘাট তৈরি করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেই ঘাট ‘বাবুঘাট’ নামে পরিচিত হয়। কেবল তাই নয়, নিজের বাড়ি থেকে গঙ্গার ঘাট অবধি রাস্তা মেরামত করলেন। পাকারাস্তা তৈরি হল। এই রোডের নাম হয় বাবু রোড। যা এখন রানি রাসমণি রোড নামে পরিচিত। কেবল বাবুঘাট নয়, আহিরিটোলার ঘাট, নিমতলা শ্মশানঘাটে শ্মশানযাত্রীদের জন্য একটি যাত্রীনিবাস তৈরি করেন রাজচন্দ্র।
আরও পড়ুন-ডেঙ্গি নিয়ে আজ নবান্নে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে বৈঠক
এইভাবে জনহিতকর কার্যের তালিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বেলেঘাটা খালের উপর পুল নির্মাণ করে তিনি গভর্নমেন্টকে তা দান করেছিলেন এবং তার জন্য একটি পয়সাও তিনি সরকারের কাছ থেকে গ্রহণ করেননি। কেবল সরকারের সঙ্গে তাঁর চুক্তি হয় যেন সাধারণ মানুষ বিনা পয়সায় এই পুল পার হতে পারেন। এইসব জনহিতকর কার্যের জন্য সরকার তাঁকে ‘রায়’ উপাধি প্রদান করেছিলেন।
কিন্তু রানি রাসমণির জীবন ও ব্যক্তিত্ব ধারালো হয়ে ওঠে রাজচন্দ্রের মৃত্যুর পর। আকস্মিক এই শোকবার্তা সকলকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। রাসমণিও সাময়িকভাবে ভেঙে পড়লেন ঠিকই কিন্তু তিনি আরও পরিণত হয়ে উঠলেন। সেই দুঃখের দিনে তৎকালীন বাবুসমাজের সদস্যরা ভেবেছিলেন জানবাজারের রাজপরিবারের সমৃদ্ধি শেষ। এক বিধবা নারী বিষয়-সম্পত্তি সামলাবেন কীভাবে? একমাত্র জামাতা মথুরমোহন বিশ্বাসই তাঁর ভরসাস্থল। কিন্তু রানি উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর দুঃসহ কষ্টকে কর্মের স্রোতে বইয়ে দিলেন। প্রাচীন ভারতীয় নারীর আদর্শে গড়ে ওঠা এই ব্যক্ত্বিত্বকে দেখে বিলাসী বাবুসমাজ থমকে দাঁড়াল। কিন্তু তার আগে ঠকানোর প্রচেষ্টায় কোনও ত্রুটি হল না। তৎকালের এক বিখ্যাত জমিদার রাজচন্দ্রের কাছ থেকে দু’লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলেন। বন্ধু বলে পরিচিত এই জমিদার রাজচন্দ্রের মৃত্যুর পর দরদি হয়ে উপস্থিত হলেন রাসমণির কাছে। তাঁর সঙ্গে দেখা করে প্রশ্ন করলেন, ‘‘দেখুন বাবু রাজচন্দ্র যে বিপুল সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন তা রক্ষণাবেক্ষণ করা বেশ কঠিন। আপনি মেয়েমানুষ হয়ে এই কাজ করতে পারবেন না। আপনাকে দুর্বল দেখে লোকে ঠকিয়ে নেবে। যদি আপনার প্রয়োজন হয় তবে আমি জমিদারির ম্যানেজার পদে নিযুক্ত হতে পারি।’’ রাসমণি স্থিরভাবে সব শুনলেন, তারপর বললেন, ‘‘এ তো খুব ভাল কথা, আপনার মতো বিশ্বাসীজনকে ম্যানেজার হিসাবে পেলে আমাদের উপকারই হবে। আমি এখনও বিষয়-সম্পত্তির কাগজপত্র দেখে উঠতে পারিনি। তবে শুনেছিলাম আপনার কাছে আমার স্বামী দু’লক্ষ টাকা পেতেন। অসময়ে যদি টাকাটা ফেরত দেন তবে খুব উপকার হয়।’’ ম্যানেজার পদের লোভে সেই জমিদার টাকা ফেরত দিতে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর কাছে তখন যথেষ্ট অর্থ না থাকায় তিনি রংপুর আর দিনাজপুরের দুই জমিদারি রানির নামে লিখে দিলেন। যার বার্ষিক আয় ছিল ছত্রিশ লক্ষ টাকা। সম্পত্তির হস্তান্তর হয়ে গেলে সেই জমিদার একদিন ম্যানেজার পদের সম্পর্কে আলোচনা করতে উপস্থিত হলেন জানবাজারে। এদিন রানি তাঁর সঙ্গে দেখাই করলেন না। লোক দিয়ে খবর পাঠালেন, ‘‘আমি বিধবা মেয়েমানুষ, কিন্তু আমার জামাইরা উপযুক্ত এবং সব বিষয়ে দেখাশুনা করতে সক্ষম। আপনার মতো সম্ভ্রান্ত মানুষকে ম্যানেজার করার স্পর্ধা আমার নেই। যেহেতু আপনি আমার স্বামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সেহেতু আমার জামাইদের স্নেহের চোখে দেখেন, এভাবে মাঝে মাঝে এসে খবরাখবর নিলে কৃতজ্ঞ থাকব।’’
আরও পড়ুন-এবার মানেকা গান্ধীর বিরুদ্ধে ১০০ কোটির মানহানির মামলা ইসকনের
তৎকালীন বাবুসমাজের এই জমিদারের (দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম উল্লেখ করলাম না) অন্তঃপুর থেকে পরবর্তী কালে নারী স্বাধীনতার ধ্বজা উত্তোলিত হয়েছিল বলে আমরা মনে করি কিন্তু সেদিন তিনি যে ব্যক্তিত্বময়ী নারীকে দেখেছিলেন তিনি, সেই রকম ব্যক্তিত্ব বহনকারী নারী তৎকালীন সমাজে বাবুদের পরিবারে বিরল ছিল। রানির এই আচরণ সমস্ত বাবুসমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছিল রাজচন্দ্রের প্রতিটি কাজের পিছনে ছিলেন রাসমণি। তাঁকে ঠকানো বা বিভ্রান্ত করা যাবে না। এই বার্তা তখন সকল বাবুদের সচেতন করেছিল কিন্তু রানির ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে আরও সচেতন হলেন সকলে যখন রানি ইংরেজদের শিক্ষা দিতে লাগলেন। গরিব জেলেদের গঙ্গায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছিল ইংরেজ সরকার, রানি গরিব জেলেদের আকুতি শুনে গঙ্গা ইজারা নিলেন এবং তখন সেই অংশ দিয়ে জাহাজ চলা নিষিদ্ধ করলেন। বড় বড় লোহার শিকল পড়ল। জাহাজ চললে মাছ পালিয়ে যাবে, এই হল যুক্তি। ইংরেজ সরকার বুঝল রানির প্রকৃত উদ্দেশ্য। তারা জেলেদের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল।
আরও পড়ুন-দূষণ ঠেকাতে কড়া পদক্ষেপ কেজরির, শরতেই ‘শীতকালীন কর্ম পরিকল্পনা’ ঘোষণা
রানি রাসমণির প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের প্রসঙ্গ না তুললে তাঁর জীবনী অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আমরা একটি প্রশ্নকে তুলে রেখে এগিয়ে এসেছিলাম। সেই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এই মন্দিরের গঠনশৈলীতে।
একই মন্দির-চত্বরে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণবভাবের আরাধনার আয়োজন। রাসমণি স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন, দেবী ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু মন্দির-চত্বরে কেবল কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা হল না। সমস্ত ভাবের সমন্বয় হল এই মন্দির প্রাঙ্গণ। অবশ্য টালিগঞ্জনিবাসী করুণাময়ী কালীমন্দির সাবর্ণ চৌধুরীদের। তাঁরা দাবি করেন, তাঁদের অধিষ্ঠিত মন্দির কাঠামো দেখেই রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর মন্দির গঠন করেন। আবার হুগলির মহানাদ কালীমন্দিরের অধিকারীদের সেই একই দাবি। আমাদের মনে হয় হয়তো কোথাও এই ধাঁচের মন্দির রানি দেখেছিলেন। সেই অনুপ্রেরণাতে তিনি গঠন করেন। কিন্তু তিনি এই মন্দিরকে ধর্মচর্চার কেন্দ্র করে গড়েছিলেন। কেবল পারিবারিক আরাধনাস্থল করে রাখেননি। তখন রমতা সাধুর আধিক্য বেশি ছিল। তাঁরা এই মন্দিরে এসে কিছুদিন বিশ্রাম করতেন। সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের জন্য বাসস্থান ও অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল। তাঁরা নির্বিঘ্নে এখানে থেকে ধর্মালোচনা করতেন।
আরও পড়ুন-খেতাবি লড়াইয়ে আজ সামনে মোহনবাগান
পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষেত্র ছিল এই মন্দির। এই ধর্মভাবের সম্মেলন আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনার মধ্য দিয়ে। যা রানির জীবনে এক পরম প্রাপ্তি। একথা স্মরণে রাখতে হবে শ্রীরামকৃষ্ণের মৌলিক প্রকাশ তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে পাগল রূপে প্রতিপন্ন করেছিল, কিন্তু রানি তাঁর অসাধারণ জীবনকে যে সঠিকভাবে চিনেছিলেন তার জন্য কেবল অভিজ্ঞ চোখ শুধু নয়, পরিণত ধর্মানুসারী জীবনের প্রয়োজন ছিল। রানি কেবল রানি ছিলেন না, ছিলেন এক প্রকৃত ঈশ্বর অনুরাগী এক ভক্ত। নিজের সইতে তিনি লিখতেন ‘কালীপদ অভিলাষী, রাসমণি দাসী’। তিনি ঈশ্বরের দাস হয়ে কাজ করেছেন, তাঁর চারপাশে ভোগের আয়োজন থাকলেও তাঁর জীবন ছিল কৃচ্ছ্রতাময়। তাঁর চরিত্রই ছিল তাঁর প্রধান অস্ত্র। তিনি ছিলেন আপসহীন এক রানি যাঁর কাছে আচারসর্বস্ব ব্রাহ্মণের দলও পরাজিত হয়েছিল। তিনি আধুনিক নারীদের কাছে নতুনের দিশারি, বক্তব্যে বা বক্তৃতায় নয়, জীবনের বাস্তব প্রয়োগে।