নারী সৌন্দর্যের অর্ধেকটা লুকিয়ে আছে তার চুলে। চুল-চর্চার আসরে আজও ‘ঘনকালো’ ও ‘মেঘবরণ’ চুলের উপমা টানা হয়। তবে উপমা প্রদানে এক ধাপ এগিয়ে থাকেন প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ। চুলকে তিনি তুলনা করেছেন ‘বিদিশার নিশা’র সঙ্গে। বাংলা সাহিত্যেও স্থান করে নিয়েছে নারী সৌন্দর্যের অন্যতম অঙ্গ চুলকে।
যদিও সেসব দিন অতীত। বর্তমানে ঘন ও লম্বা চুলের দিন শেষ হয়েছে। এখন হাঁটুর নিচে ঝোলে না খুকুর গোছাভরা চুল। ছাদের কারনিসে অথবা ঝুলবারান্দায় পশ্চিমে ঢলে যাওয়া রোদে এলো চুল শুকতে দেখা যায় না গৃহবধূদের। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, আধুনিকতার স্পর্শে চুল-চর্চায় এসেছে নানা পরিবর্তন। এখন বাহারি চুলের দিন।
আরও পড়ুন-রানি রাসমণি নতুনের দিশারি
একটা সময় ছিল যখন নকল বা বিকল্প চুলকে বাঁকা চোখে দেখা হত। আর এখন নারীর রূপচর্চার অন্যতম অঙ্গ নকল বা পরচুল। দিন দিন বেড়ে চলেছে পরচুলের ব্যবহার। আমাদের রাজ্যে কুটিরশিল্পের আকার নিয়েছে এই ‘পরচুলা’ শিল্প। শুধু তাই নয়, বাংলার কুটিরশিল্প হিসেবে পরচুলা এখন অবস্থান করছে সামনের সারিতে। যদিও বিদেশ পাড়ি দিয়ে পরচুলা হয়েছে ‘উইগ’। মূলত গ্রামীণ মহিলারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
বিউটি পার্লার বা অভিনয় জগৎ তো বটেই, মানবজীবনে কেশসজ্জা এখন রোজগারের বড় পথ। গ্রাম বা মফসসলেও বিয়ের আসরে কনে সাজাতে চুলের বাহারি রূপ দেওয়া হয়। তাতেই বেড়েছে পরচুলার ব্যাবহার। এই কাজে দক্ষকর্মীদের আমরা ‘কেশশিল্পী’ নামে ডাকা শুরু করেছি। যার ফলে, পরচুলার ব্যবহারিক প্রয়োগ বেড়েছে। ফাঁকা মাথার যে তরুণকে দেখে বিরামচিহ্নের মতো মনে হত, পরচুলার ব্যবহারে সেই তরুণকেই দেখতে নায়ক-নায়ক মনে হয়। শুধুমাত্র টাকের কারণে যে তরুণ ব্যর্থ হয়েছেন প্রেমে, পরচুলা ব্যবহারের পর সেই তরুণকেই কোনও কলেজ গার্ল প্রোপোজ করতে ভুল করছে না। পরচুলার এমনই ক্যারিশমা।
আরও পড়ুন-হারানের নাতজামাই
পরচুলার এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন বাংলার গ্রামীণ মহিলারা। আমরা এখন খোঁজ নেব নেপথ্যে-থাকা সেইসব মহিলাদের। যাঁদের হাতের স্পর্শে মানুষের উচ্ছিষ্ট ও পরিত্যক্ত চুল নতুন করে ব্যবহার-উপযোগী হয়ে উঠছে।
আমাদের রাজ্য পশ্চিমবাংলা ছাড়াও পরচুলা আমদানি হয় প্রতিবেশী রাজ্য বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম ও ত্রিপুরা থেকে। গ্রাম-ঘুরে-ঘুরে হকাররা সংগ্রহ করেন এসব চুল। গ্রামে যাঁরা বড় হয়েছেন তাঁদের মনে থাকতে পারে ডুগডুগি বাজিয়ে হকার চেঁচিয়ে বলছেন, ‘কাচভাঙা, টিনভাঙা, লোহাভাঙা, মাথার চুল বিক্রি আছে…’। গ্রামীণ বাংলার সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ আছে তাঁরা আজও দেখেন এই হকারদের। সারাদিন পাড়া ও বস্তি ঘুরে বেড়ান এঁরা। দিনের শেষে উক্ত ভাঙা দ্রব্যের সঙ্গে কমপক্ষে ৩০০ গ্রাম চুল সংগ্রহ হয়। চুল সংগ্রহ হয় নদীর স্নানঘাট ও বিউটি পার্লার থেকেও।
আরও পড়ুন-ডিজিটাল দুনিয়ায় খবরদারি বাড়াতে বিল আনছে কেন্দ্র
মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা ঝাড়খণ্ডের এক হকার ইসমাইল শেখ জানাচ্ছেন, বাড়ির গৃহিণীরা পরিত্যক্ত চুল আগে ডাস্টবিন বা আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিতেন। সেখান থেকে আমরা সংগ্রহ করতাম। এখন সেটা হয় না। বাড়ির গৃহিণী জানেন হকার আসবে। সংগ্রহ করা চুল নিয়ে যাবে নগদ অর্থ, চকোলেট অথবা শোনপাপড়ির মতো শুকনো খাবারের বিনিময়ে। ফলে, চুল সংগ্রহ করতে আর ডাস্টবিন বা আবর্জনার নোংরা হাতড়াতে হয় না।
ইসমাইলের দেওয়া তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ইদানীং শহর, আধা-শহরে মহিলারা যেসব সেলুন গড়ে তুলেছেন সেখান থেকেও চুল সংগ্রহ হচ্ছে। জানা গিয়েছে, বর্তমানে মহিলাদের সাজ-সজ্জাতেও আধুনিকতার ভাবনা লক্ষ্যে করা যাচ্ছে। অনেকেই আর লম্বা চুলের বাহার দেখাতে চাইছেন না। হাল ফ্যাশনের স্পর্শে চুল কেটে ফেলছেন অনেকেই। সেলুনে গিয়ে চার থেকে ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত চুল কেটে ফেলছেন। হকাররা ওইসব পার্লার থেকে চুল সংগ্রহ করছেন। যেটা পাঁচ বছর আগেও ছিল না।
আরও পড়ুন-৪০০ বছর ধরে নিষ্ঠায় পূজিত কাত্যায়নীরূপী দুর্গা
এরপর হকারদের সংগ্রহ-করা সব চুল কিনে নেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরাই এগুলোকে নতুন করে ব্যবহার-উপযোগী করে তোলেন। অনেক ব্যবসায়ী স্থানীয় হকারদের সঙ্গে চুক্তি করেন। জানা গিয়েছে, কোনও কোনও ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রয়েছেন ১০০০ হকার। তাঁদের সংগ্রহ-করা চুল ওই ব্যবসায়ীকেই দিতে হবে। তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, হকাররা দিনে ৩০০ গ্রাম চুল সংগ্রহ করতে পারেন। অর্থাৎ হাজার হকারের থেকে প্রতিদিন চুল সংগ্রহ হয় ৩০ কেজি। মাসের হিসেব ধরলে ৩০০ কেজি।
আরও পড়ুন- পকসো আইনে সম্মতির বয়স কমানোর বিরুদ্ধে আইন কমিশন
সংগৃহীত সব চুলই থাকে দলা পাকানো। অথবা কাঠিতে জড়ানো থাকে। এইসব চুল ছাড়ানো হয় মেয়েদের দিয়ে। পুরুষরা চুল সংগ্রহ করলেও জট ছাড়ানোর মতো কাজে তাঁরা দক্ষ নন। কারণ, এই কাজে সময় ও ধৈর্যের দরকার হয়। মহিলারা হন ধৈর্যশীল। এবং এই কাজে পটু। তবে, এই কাজ মেয়েরা অবসর সময়ে করেন। বাংলায় যতরকম কুটিরশিল্প আছে তার সঙ্গে মহিলারাই বেশি যুক্ত থাকেন। যেমন রাখি-তৈরি, বিড়ি-বাঁধা ও জরির মতো শিল্প-কাজ। সংসারের সমস্ত কাজ সেরে অবসর সময়ে তাঁরা শিল্প-কাজগুলো করেন। চুল ছাড়ানোর সঙ্গে যুক্ত মুর্শিদাবাদের আমিনা বিবি, রহিমা বিবি জানাচ্ছেন, অবসর সময়ে কাজ করেও একজন মহিলা প্রতিদিন ৩০০ গ্রাম চুল ছাড়াতে পারেন। সারাদিন কাজ করলে এক কেজি চুলও ছাড়ানো সম্ভব। তবে, সারাদিন কাজ করেন এমন মহিলার সংখ্যা নগণ্য। ৩০০ গ্রাম চুল ছাড়ালে রোজগার হয় ৭০ টাকা। অর্থাৎ মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। গ্রামের একজন দরিদ্র মহিলার হাতে প্রতি মাসে এই টাকাটাও অনেক। আমিনার কথায় বোঝা যায় গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন পরচুলা শিল্পে যুক্ত থাকা মহিলারা।
আরও পড়ুন-বিধায়কের শপথ কৌশলী তৃণমূল
কুণ্ডলী পাকানো বা কাঠিতে জড়ানো চুল ছাড়িয়ে যা সংগ্রহ হয় তা থেকে ব্যবহার হয় ৮ থেকে ৩০ ইঞ্চি মাপের চুল। মাপ অনুপাতে ১০, ১২, ১৪ ও ১৬ ইঞ্চির মাপে কাটিং হয়। ইঞ্চি মাপ অনুপাতে চুলের দাম নির্ধারণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ার সবটাই হয় মহিলাদের দ্বারা।
এ-প্রসঙ্গে আমরা একটু অতীতে ফিরতে পারি। ইতিহাস জানাচ্ছে, বাংলায় প্রথম পরচুলার কাজ ও ব্যবসা শুরু হয় মেদিনীপুর জেলায়। আজ থেকে ৬০ বছর আগে। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এই কাজ নিয়ে আসেন ওই জেলার কিছু পরচুলা-কর্মী। যাঁরা ওই প্রদেশে কাজের সূত্রে ছিলেন। মেদিনীপুর জেলা থেকে আসে হাওড়া। এখান থেকে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও ২৪ পরগনায় ছড়িয়ে পড়েছে। কাজ পেয়েছেন কয়েক লক্ষ মানুষ। এঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশ মহিলাকর্মী। পরচুলার মূল ব্যবসা হয় বিদেশে। তবে ব্যবসা রয়েছে ভারতে ও বাংলাতেও। আমরা জানি, মঞ্চ ও চলচ্চিত্র জগতে পরচুলার ব্যববহার রয়েছে অনেক আগে থেকেই। বর্তমানে তা বেড়েছে। কারণ, টলিউড এখন শুধু সিনেমা- নির্ভর নয়। এই স্থানে এসেছে ধারাবাহিক টিভি সিরিয়াল। ফলে টলিপাড়ার কলাকুশলীদের মেক-আপ ম্যানের রমরমা বাজার। এই বিভাগে সবচেয়ে বেশি মানুষ যুক্ত আছেন হাওড়ার। পাঠকদের এ-ব্যাপারে একটি তথ্য দিতেই হচ্ছে। হাওড়ার উলুবেড়িয়ার মানুষ ছিলেন পিয়ার আলি। টলিপাড়ায় তিনি পাঁচ দশক কাজ করেছেন। একটা সময় ছিল যখন উত্তম-সুচিত্রার একমাত্র মেক-আপ ম্যান ছিলেন তিনি। হাতের নিপুণ কাজে মুগ্ধ হয়ে স্বর্ণযুুগের তারকাদ্বয় মেক-আপ আর্টিস্ট হিসেবে স্থায়ী করে দেন পিয়ার আলিকে।
আরও পড়ুন-সাবেকিয়ানার টানে একচালার প্রতিমা গড়েন চায়না পাল
এমনকী অতীতে চণ্ডীমাতা ফিল্মসের সব ছবির মেক-আপ আর্টিস্ট ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর সে-স্থানে বর্তমানে কাজ করছেন ছেলে দিলওয়ার হোসেন। এক সময় মঞ্চ-কাঁপানো ‘নহবত’ নাটকে দিলওয়ার হোসেন প্রথম কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তিনি সিনিয়র মেক-আপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। টলিপাড়ার ৭০ শতাংশ কলাকুশলী পরচুলা নেন দিলওয়ারের থেকে। বর্তমান সময়ে টলিপাড়াতেও কাজ বেড়েছে। দূরদর্শন আসার পর সিনেমার পাশাপাশি সিরিয়াল, শর্ট ফিল্মের প্রসার বেড়েছে সর্বত্র। ফলে, দিলওয়ার হোসেনের পাশাপাশি টলিপাড়ায় আরও অনেক তরুণ আর্টিস্ট কাজ পেয়েছেন। পরচুলা ব্যবসার বৈদেশিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে নানান সমস্যা। মুর্শিদাবাদের পরচুলা ব্যবসায়ী মহম্মদ পিয়ার আলি বলেন, জেলায় তৈরি পরচুলা সবটাই যায় বিদেশে। তিনি জানাচ্ছেন, পূর্ব ভারত থেকে বিদেশে এক্সপোর্ট ব্যবসায় পরচুলা রয়েছে শীর্ষস্থানে।
আরও পড়ুন-এশিয়ান গেমসে ৬ দিনে ৩২টি পদক জয় ভারতের, অভিনন্দন মুখ্যমন্ত্রীর
পরচুলার বৈদেশিক বাণিজ্যে মুনাফায় পূর্ব ভারত পথ দেখাচ্ছে সমগ্র দেশকে। সম্প্রতি পূর্ব ভারতে শ্রেষ্ঠ রফতানিকারক ব্যবসায়ী হিসেবে কেন্দ্র সরকারের বিশেষ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন মুর্শিদাবাদের আলমগির শেখ। রফতানি বাণিজ্যে কেন্দ্র-সরকার লাভবান হলেও বাংলার ব্যবসায়ীরা বঞ্চিতই থেকে গিয়েছেন। তাঁদের প্রধান সমস্যা এখন কেন্দ্র সরকারের দেওয়া মুনাফা সম্মান শতাংশ হঠাৎ কমিয়ে দেওয়া। জানা গিয়েছে, পূর্বের কংগ্রেস সরকারের আমলে বিদেশে রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মুনাফার ৭ শতাংশ ফিরিয়ে দেওয়া হত ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিতে। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুনাফার অংশ কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। ২০১৯-এ ক্ষমতায় এসে আরও কমিয়ে এক শতাংশ করা হয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন পরচুলা ব্যবসায়ীরা। পিয়ার সাহেব জানান, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশের কাছেও নানা হয়রানির শিকার হন। রফতানির বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও পুলিশি হয়রানি চলে। পাশাপাশি রাস্তাঘাটে চুরি, ছিনতাইও বড় সমস্যা। সমস্যার বিষয়টি সমাধানের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সাহায্যই চাইছেন ব্যবসায়ীরা।