মণীশ কীর্তনিয়া, নবনীতা মণ্ডল, নয়াদিল্লি: মঙ্গলবার রাতে রাজধানী দিল্লিতে যে ঘটনা ঘটল তা ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। গোটা দেশ তাকিয়ে দেখল তৃণমূল কংগ্রেসের ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচিকে আটকাতে কী পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করল মোদি-শাহর বিজেপি সরকার। পুলিশ, র্যাফ, কেন্দ্রীয় বাহিনী, সিআইএসএফ, সিআরপিএফ— কোনওটাই বাকি রইল না বাংলার মন্ত্রী, সাংসদদের আটকাতে। কখনও লাঠি, কখনও একসঙ্গে হামলা, আবার কখনও ক্যামেরায় দেখা গেল মহিলাদের উপর পুলিশি অত্যাচার।
আরও পড়ুন-গণতন্ত্রের অন্ধকার দিন : মুখ্যমন্ত্রী
কেন্দ্রীয় কৃষি প্রতিমন্ত্রীর কাছে সময় নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল। দেখা করা তো দূরের কথা, মন্ত্রী পালালেন। মন্ত্রীর দফতরেই অপেক্ষায় থাকা তৃণমূলের প্রতিনিধি দলকে পুলিশ আর র্যাফ দিয়ে অগণতান্ত্রিক, পাশবিক এবং নির্মমভাবে মারতে মারতে, টেনে-হিঁচড়ে চ্যাংদোলা করে বের করা হল। অরূপ বিশ্বাস, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, শান্তনু সেন, মহুয়া মৈত্র, দোলা সেন, বীরবাহা হাঁসদা, অপরূপা পোদ্দার— কেউ বাদ গেলেন না। তিনটি বাসে তাঁদের আটক করে গভীর রাতে নিয়ে যাওয়া হল দিল্লির পুলিশ লাইনের উৎসব ভবনে। রাত ১১টায় আটকদের মুক্তি দেওয়া হল। গোটা ঘটনা দেখে ধিক্কার জানাচ্ছেন দেশের মানুষ, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব। দেশের রাজধানীতে কলঙ্কিত হল গণতন্ত্র। ধর্ষিত হল মানুষের অধিকার। লজ্জায় মুখ লুকোচ্ছে গোটা দেশ। থানা থেকে বেরিয়েই অভিষেকের ঘোষণা, ৫ অক্টোবর বিকেল ৩টেয় ‘রাজভবন চলো’ অভিযান। যে ৪২ জন প্রতিনিধি ছিলেন কৃষিভবনে, তাঁরাই থাকবেন। মিছিলে হাঁটবেন ১ লক্ষ মানুষ। সঙ্গে থাকবে ৫০ লক্ষ চিঠি। কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে সেদিন এই বঞ্চনার জবাব দিতে হবে রাজ্যপালকে। প্রতিবাদে আজ বুধবার বাংলার সমস্ত ব্লক এবং টাউনে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ এবং তৃণমূল যুব কংগ্রেস যৌথভাবে বিক্ষোভ দেখাবে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
* যেন জঙ্গি হামলা : সোমবার রাজঘাটে সত্যাগ্রহ পালন করতে গিয়ে পুলিশের হামলা হয়েছিল। বাদ যাননি অভিষেকও। কোনও মন্ত্রী হারিয়েছেন চটি তো কেউ মোবাইল। আহত কম-বেশি প্রত্যেকে। ফলে যন্তরমন্তরের সভায় তেমনই কিছু ঘটবে বলে আগাম অনুমান ছিল। অনুমান মিথ্যা হয়নি। সকাল ৮টা থেকেই পুলিশ, র্যাফ আর কেন্দ্রীয় বাহিনী ঘিরে ফেলে গোটা এলাকা। কম করে তারা সংখ্যায় ২০ হাজার। হঠাৎ দেখে মনে হবে যেন কোনও জঙ্গি হামলা হয়েছে। তা রুখতে নেমে পড়েছে বাহিনী। পুলিশ এবং বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই বাংলা থেকে আসা জব কার্ড হোল্ডাররা অর্থাৎ বঞ্চিতরা হাতে পোস্টার, গলায় প্ল্যাকার্ড আর সঙ্গে তৃণমূলের পতাকা নিয়ে যন্তরমন্তরে আসেন। শুধু বাসে করে আসা বঞ্চিতরাই নয়, দেখা গেল বিশেষ ট্রেন বাতিল করে দিলেও ট্রেনে চেপেও বহু মানুষ এসেছেন শুধু এই প্রতিবাদে শামিল হতে। সংখ্যাটা কম করে ১০ হাজার। ঢুকতে দেওয়া হয়নি সেই সংখ্যাটাও কম-বেশি ১০ হাজার। সওয়া একটায় শুরু সভা। বাইরে জলকামান, মাইকিং চলছে পুলিশের। যেন যুদ্ধ চলছে!
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
* জমিদারি নাকি : সভায় তৃণমূলের ২৭ জন বক্তব্য রাখলেন। শেষে অভিষেক। ঘোষণা করলেন ২,৫০০ প্রতিনিধিকে তৃণমূলের উদ্যোগে দু’বছরের বকেয়া দেওয়ার কথা। জানালেন, দাবি না মিটলে পরের বার লাখো মানুষের জমায়েত দিল্লিতে। আসবেন নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। অভিষেকের প্রশ্ন, এই টাকা ওদের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। মোদি-শাহর জমিদারি বন্ধ করতে হবে। ওরা বোতাম টিপে টাকা বন্ধ করলে মানুষও এবার বোতাম টিপে ওদের তাড়াবে। অভিষেক কৃষি ভবনে কর্মসূচি ঘোষণা করতে গিয়ে বললেন, ৪০ জনের প্রতিনিধি দল যাবেন। ৮ জন বঞ্চিত। সঙ্গে দয়া করে কেউ যাবেন না।
আরও পড়ুন-বাম-কং আমলের দাবি পূরণ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিগগিরই চালু হচ্ছে নেতাজি সুভাষ সেতু
* শুরু পুলিশের লুকোচুরি : হাতে আর মাথায় ফাইল নিয়ে ৪০ জনের দল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যন্তরমন্তর থেকে মিছিল করে চলল কৃষি ভবনে। সাংবাদিকদের এড়াতে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হল প্রতিনিধি দলকে। ৬টা থেকে ৭:৩০টা। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হল। বলে পাঠানো হল, কোনও উপভোক্তাদের সঙ্গে দেখা করা হবে না। অভিষেক অনুরোধ করে পাঠালেন বাঁকুড়ার হতভাগ্য ৪ জনের সঙ্গে দেখা করা হোক। ফের অনুরোধ করতে গিয়ে জানা গেল, মন্ত্রী পালিয়েছেন। ক্ষুব্ধ অভিষেক বলেলন, যদি দেখা করবেনই না তাহলে সময় দিলেন কেন? বসলাম এখানে। মন্ত্রীর অপেক্ষায় রইলাম। প্রমাদ গুণল মোদি-শাহর পুলিশ। এতো আর এক কাণ্ড।
আরও পড়ুন-বিজেপি শাসিত অসমে বাল্যবিবাহ আইন ভাঙায় গ্রেফতার সহস্রাধিক
* মনে করাল সিঙ্গুরের কথা : অভিষেককে মোকাবিলা করতে না পেরে পালিয়ে গেলেন কেন্দ্রীয় কৃষি প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি। একইভাবে বিহারে গিয়ে মুখ লুকিয়ে বসেছিলেন মন্ত্রকের পূর্ণমন্ত্রী গিরিরাজ সিং। তারপর শুরু হল পুলিশ-সিআরপিএফ-র্যাফ-আধা সেনার অত্যাচার। টেনে-হিঁচড়ে বের করা হল কৃষি ভবন থেকে। জিটিবি পুলিশ লাইন থেকে বেরিয়ে অভিষেক বললেন, আজ যে আচরণ করা হয়েছে তা ঠিক যেন ২০০৬ সালের সিঙ্গুরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। ২৫ সেপ্টেম্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চুলের মুঠি ধরে আন্দোলন থেকে সরানো হয়েছিল। আজ কৃষি ভবনেও সেই ঘটনাই ঘটল। বুঝিয়ে দিচ্ছে মোদি-শাহর জমিদারি শেষ হতে চলেছে। দিল্লি পুলিশ দেখল ওই গভীর রাতে কৃষিভবন এলাকা দখল করে নিয়েছে তৃণমূল সমর্থকরা। চলছে গণ-অবস্থান, স্লোগান, পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদ।
আরও পড়ুন-দিল্লি থেকে বিজেপির ‘জমিদারি’ হটানোর ডাক দিলেন অভিষেক
* জবাব দেবেন মানুষ : দিল্লিতে যখন তৃণমূলের লড়াই চলছে তখন কালীঘাটে বসে উগ্বিগ্ন নেত্রীর সঙ্গে সারাক্ষণ যোগাযোগ রেখে চলেছেন নেতৃত্ব। পরিস্কার ভাষায় নেত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই ঘটনা তৃণমূল কংগ্রেসের জয়। তৃণমূলকে ভয় পেয়েছে বিজেপি। জিবিটি থানা থেকে বেরিয়ে অভিষেকের চ্যালেঞ্জ, পথেই দেখা হবে। লড়াই চলবে। বুধবার কলকাতা ফিরব। বৃহস্পতিবার আবার রাস্তায় নামব। জবাব দিতে হবে রাজ্যপালকে। প্রতিদিন দেখি উনি বোমা ফাটাচ্ছেন। এবার জবাব দেবেন পথে নামা মানুষকে। পথেই এবার নামো সাথী…। অভিষেক যখন বলছেন তখন গোটা মিডিয়াকুলেরও গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাওয়ার জোগাড়।