কয়েকটা ঘটনা (Incidents)। কোনওটাই এখনকার নয়। সবকটাই বহু বহু পুরনো। কিন্তু কী আশ্চর্য! পুরনো সেসব ঘটনায় কোথাও যেন বিম্বিত এই সময়ের ছবি। নীচে তাই রইল, প্রতিটি ক্ষেত্রে, অতীত সংঘটন। আর তার নীচে, প্রত্যেক ঘটনার অনুসারী, টিপ্পনী। সেকালের দুর্গোৎসবে একালের ঘটনার (Incidents) অত্যাশ্চর্য সমাহার এগুলো।
অতীত সংঘটন নং ১
সন ১২২৯ বঙ্গাব্দ। অর্থাৎ ১৮২২ খ্রিস্টাব্দ। তারিখ ১১ কার্তিক। ইংরেজি ক্যালেন্ডার মোতাবেক ২৭ অক্টোবর, রবিবার। সেদিন ‘সমাচার দর্পণ’-এ একটা খবর বেরিয়েছিল।
কলকাতার পশ্চিমে শিবপুর গ্রাম নিবাসী এক ভদ্রলোকের কাণ্ড। তিনি দুর্গাপুজোর প্রতিমা বানিয়েছেন। যাবতীয় আয়োজন করেছেন। তারপর ২৫০টা টিকিট বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রতিটি টিকিটের মূল্য ১ টাকা। ওগুলো লটারির টিকিট। লটারিতে যার টিকিট উঠবে, ওই দুর্গাপুজোর সংকল্প হবে তার নামে। এটাই লটারির প্রাইজ। ‘সমাচার দর্পণ’ এই অভিনব দুর্গোৎসবের নাম দিয়েছিল ‘মূর্তির দুর্গোৎসব’, ‘মূর্তি’র অর্থ হল ‘ভাগ্য পরীক্ষামূলক খেলা’, অর্থাৎ কিনা লটারি।
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ ১
কেউ যদি ২০১ বছর আগে ঘটা এই ঘটনায় আজকের ছায়া দেখতে পান, সে দায় তাঁর দৃষ্টিপথ বা তাঁর দৃষ্টিকোণের। এই অধম কলমচি তার জন্য দায়ী নয়। কারণ, মনে হতে পারে, মনে হতেই পারে, এই যে ২০২৩-এ, দলের আর সব রাঘববোয়াল, রুই কাতলাদের পুজোতে ফিতে কাটার অনুরোধ-উপরোধ, আবেদন-নিবেদন উপেক্ষা করে, কেন্দ্রের ৫৬ ইঞ্চি ছাতিবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার ২নং শক্তিমান পুরুষ মধ্য কলকাতার এক চুনো পুরপিতার জাঁকের পুজো— রাসের মেলায় হাজির হওয়ার জন্য ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে বঙ্গের রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে চলে এলেন। এর পিছনেও রয়েছে ওই লটারি। লটারি করেই নাকি ঠিক হয়েছে কেন্দ্রের মেজদা ঠিক কোথায় যাবেন। তাই-ই নাকি চিংড়িসম পুরপিতার কপাল খুলেছে। আবারও বলছি, একালের ঘটনার সত্যমিথ্যা জানা নেই। তাই, তাই-ই, এই অনুমানের দায়ও এই কলমচির নয়।
অতীত সংঘটন নং ২
এ ঘটনা ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের বাংলার। ঘটনাস্থল দাঁইহাট। সে জায়গা তখন বর্গিদের শাসনকেন্দ্র। কাটোয়ার কাছে এই জায়গাটাতেই মারাঠা বর্গিদের নেতা ভাস্কররাও কোলহটকর দুর্গাপুজোর উদ্যোগ নেন। এই বর্গি সর্দারকে
বঙ্গজরা ডাকে ভাস্কর পণ্ডিত নামে। মুসমান-শাসিত বাংলায় বাঙালি হিন্দুদের সমর্থন পাওয়ার জন্যই ভাস্কর পণ্ডিত দুর্গা পুজোর আয়োজন করেন। বড় বড় জমিদার আর মহাজনদের কাছ থেকে পুজোর টাকা জোর জুলুম করে আদায় করল বর্গিরা। সেবার দুর্গা ষষ্ঠী পড়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর, রবিবার। সপ্তমীর সকাল থেকেই সে পুজোয় লোক-খাওয়ানোর দেদার বন্দোবস্ত হয়েছিল। সকালের জলখাবার চিঁড়ে, মুড়ি, বাতাসা আর ফল। দুপুরে খিচুড়ি। রাতে লুচি, সন্দেশ। অষ্টমীর দিন গভীর রাত্রি পর্যন্ত হই-হুল্লোড় করে বর্গি সেনারা শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এই সময় সুবা বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ উদ্ধারণপুরের কাছে সেনাদল সমেত গঙ্গা পার হলেন। কাটোয়ার কাছে পার হলেন অজয় নদ। তারপর নিঃশব্দে দাঁইহাটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বর্গিদের ওপর। অপ্রস্তুত বর্গিরা দুর্গাপুজো অসমাপ্ত রেখেই চম্পট দিল। কবি গঙ্গারামের লেখা ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’ জানাচ্ছে, ‘সপ্তমী অষ্টমী দুই পুজো করি। ভাস্কর পলাইয়া যায়ে প্রতিমা ছাড়ি।’
আরও পড়ুন- ২৫ লক্ষ কোটির ঋণ মকুব কেন্দ্রের!
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ নং ২
উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে ২৭৯-র বাংলার রাজনীতিক ছবির যদি কেউ মিল পান, তবে তার জন্য এই কলমচি দায়ী নয়। কারণ, ২০২১-এ বাংলায় বহিরাগত বর্গির দল দুর্গাপুজোকে ইস্যু করে বিভেদের বায়ু ছড়িয়ে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে, কিন্তু শেষে বাংলার সচেতন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন জনচেতনার অভিঘাতেI বাংলা ছাড়া হতে বাধ্য হয়। ‘এক এক ঘোড়ায় দুই দুই বরগি চড়িয়া। দ্রব্য সামগ্রী যায়ে ফেলাইয়া। … সামগ্রী লুটে বহনিয়া। হোতা ফৌজ লইয়া ভাস্কর গেল পলাইয়া।’ গঙ্গারাম কবির এই কথাচিত্রের সঙ্গে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন-উত্তর বঙ্গ-গেরুয়া শিবিরের কোনও মিল কেউ যদি খুঁজে পান, আবারও বলছি, তজ্জন্য এই কলমচি দায়ী নয়।
অতীত সংঘটন নং ৩
সন ১৮৪৮। তারিখ ২৭ সেপ্টেম্বর। ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। বিজ্ঞাপনটি দিয়েছিল এ লেসলি অ্যান্ড কোম্পানি। তারা জুতো-সহ চামড়ার নানা জিনিসপত্র তৈরি করত। তাদের অফিস ছিল ৫ নং ট্যাংক স্কোয়ারের পূর্ব দিকের বাড়িতে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ‘এই বিজ্ঞাপন পত্র দ্বারা সকলকে জ্ঞাত করা যাইতেছে যে উল্লিখিত কোম্পানিরা অতি সমাদরপূর্বক বহুদেশীয় বিশেষত কলিকাতা নগরীর মান্য মহাশয়দিগকে বিজ্ঞাপন করিতেছেন যে আগামী দুর্গাপুজো পর্বের জন্য তাঁহারা অত্যুত্তম জেপেন লেদর অর্থাৎ বার্নিশ করা চর্মের এবং ব্যবহারযোগ্য চলিত চর্মের অনেক জুতা প্রস্তুত করিতেছেন, গুণে এবং গঠনে এতদপেক্ষা উত্তম জুতা ভারতবর্ষে দুষ্প্রাপ্য হইবেক, প্রথমোক্ত প্রকার চর্মের এক জোড়া জুতার মূল্য ৫ টাকা শেষোক্তের মূল্য ৩ টাকা মাত্র। মূল্য নগদ দিতে হইবেক।’
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ নং ৩
১৭৫ বছর আগেকার এই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে কেউ যদি এখনকার খবরের কাগজগুলোয় পুজোর আগে জুতা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনের কোনও সাদৃশ্য খুঁজে পান, তবে তার জন্যও এই কলমচি দায়ী নয়। সে শুধু এস ওয়াজেদ আলির ‘ভারতবর্ষ’-এর সমর্থনে শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে বলতে পারে, ‘বুঝতে পারি এই এতদূর এসে …. সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।’
শুভ মহাষষ্ঠী।