দশম অবতার

মুক্তি পেল সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ক্রাইম থ্রিলার ‘দশম অবতার’। রহস্যে মোড়া টানটান ছবি। মূল চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে অনির্বাণ ভট্টাচার্য, যিশু সেনগুপ্ত, জয়া আহসান। কেমন হল বহু প্রতীক্ষিত ছবিটি? জানালেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

পুজো উপহার
তিনি বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ফার্স্ট বয়। মনে করেন অনেকেই। গত এক যুগে যতগুলো পরীক্ষা দিয়েছেন, প্রায় প্রত্যেকটাতেই লেটার মার্কস। দর্শকদের বিপুল প্রত্যাশা। যত পূরণ করেন, তত চাহিদা বেড়ে যায়। তিনি সৃজিত মুখোপাধ্যায়। এবার তাঁর পুজো উপহার ‘দশম অবতার’ (Dawshom Awbotaar)। নির্ভেজাল একটি থ্রিলার। একে রামে রক্ষে নেই, তার উপর সুগ্রীব দোসর। ছবিতে তাঁর তুরুপের তাস টলিউডের ‘ইন্ডাস্ট্রি’ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ‘অটোগ্রাফ’ থেকে যতবার তাঁরা জুটি বেঁধেছেন, বাজার গরম করেছেন। ‘জুলফিকার’ অবশ্য ব্যতিক্রম। ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল পুজোয়। মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ভুল থেকেই শিক্ষা। সেটা নিয়েছেন সৃজিত। পা ফেলেছেন ভেবেচিন্তে। হাত দিয়েছেন নতুন নতুন বিষয়ে। লেটার মার্কস।

মেধার প্রাধান্য
‘দশম অবতার’ (Dawshom Awbotaar) নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল বহু আগে থেকেই। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি এই ছবিতে আছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, যিশু সেনগুপ্ত, জয়া আহসান। অন্যকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ তাঁরা। বহু মাথার সম্মিলন ঘটলে নিট ফল কী হয়, জানেন সৃজিত। আবারও তোলা যায় ‘জুলফিকার’-এর নাম। তবে এবার পরিচালক ছক বদলেছেন। মননের তুলনায় বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন মেধাকে। তাই আরেকটা ‘জুলফিকার’ হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

খুনির উদ্দেশ্য
তাহলে কি ‘বাইশে শ্রাবণ’ হবে? নাহলে ‘দ্বিতীয় পুরুষ’? এত ছবি থাকতে এই দুটির নাম কেন? বলা হচ্ছে, ‘দশম অবতার’ হল ‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ সরণির তৃতীয় ছবি। প্রথম দুটি পৌঁছেছিল আলাদা উচ্চতায়। মগজাস্ত্র-নির্ভর ক্রাইম থ্রিলার। আগাগোড়া মারাত্মক টান। খুনি কে? শেষে ছিল চমকে দেওয়ার মতো ট্যুইস্ট। যা কল্পনার অতীত। ‘দশম অবতার’ কিন্তু তেমনটা নয়। খুনি কে, সেটা পরিষ্কার। কী তাঁর উদ্দেশ্য সেটাও অজানা থাকছে না। তবু অপেক্ষা করতে হয় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এখানেই সৃজিতের কৃতিত্ব। প্রেক্ষাগৃহে আলো জ্বলে ওঠার আগে পর্যন্ত চেয়ার এবং শরীরের মধ্যে ফাঁক হতে দেন না।

আরও পড়ুন- সেকালের ঘটনা একালের আয়না

আবার প্রবীর
‘দশম অবতার’ (Dawshom Awbotaar) কাহিনির সঙ্গে যোগ রয়েছে হিন্দু পুরাণের। মানুষের মন এবং পুরাণের এক অদ্ভুত কাল্পনিক যোগপথের ব্যাখ্যা রয়েছে ছবিতে। শ্রীবিষ্ণুর এক একজন অবতার বিভিন্ন যুগে দুষ্টের দমন করতে ধরাধামে এসেছিলেন। গল্প বোনা হয়েছে সেই ভাবনা থেকেই। গল্পের শুরু একজন প্রোমোটারের খুন ঘিরে। বাথটবে স্নানের সময় তাঁকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে রেড বেলিড পিরানহা। কিন্তু খাস কলকাতায় পিরানহা কীভাবে এল, সেটাই প্রশ্ন। তদন্তের ভার পড়ে সিরিয়াল কিলিং কেসের স্পেশ্যালিস্ট প্রবীর রায়চৌধুরীর উপরে। তাঁর সঙ্গী তরুণ ইন্সপেক্টর বিজয় পোদ্দার। এরমধ্যেই একের পর এক খুন হতে থাকে শহরে। প্রত্যেকটি খুন হয় বিশেষ বিশেষ কায়দায়। কখনও কচ্ছপের আকারের ধারালো অস্ত্র দিয়ে, আবার কখনও রেস্তোরাঁয় পর্ক সসেজের মধ্যে বিষ মিশিয়ে। রহস্য দানা বাঁধে।
সৃজিতের গল্প বলার একটা নিজস্ব ধরন আছে। তাঁর গল্পের গতি অনেকটা দিয়েগো মারাদোনার মতো। বল পায়ে কখন কোনদিকে বাঁক নেয়, বোঝা মুশকিল। এইভাবেই গল্পের সঙ্গে খেলতে ভালবাসেন সৃজিত। প্রথম থেকেই। রহস্য ঢুকে পড়লে তাঁর গল্প দিয়েগোর বল হয়ে যায়। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় রহস্য।

গোলকধাঁধায় ঘোরাঘুরি
‘দশম অবতার’-এর প্রথমার্ধ এগোয় আপন খেয়ালে। দ্বিতীয়ার্ধে নানা গোলকধাঁধায় ঘোরাঘুরির শেষে স্পষ্ট হয় ছবির ছবি। সামনে আসে আপাত খলনায়কের প্রকৃত উদ্দেশ্য। তখন প্রশ্ন জাগে, তিনি ‘খল’? নাকি ‘নায়ক’? কিন্তু খুনি চরিত্রের অভিনেতা যিশু সেনগুপ্ত নায়ক হবেন কী করে? এই ছবি তো আসলে ‘প্রবীর রায়চৌধুরী’র। এই চরিত্রে আরও একবার মুগ্ধ করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। অভিব্যক্তি, সংলাপ পরিবেশন সবেতেই রেখেছেন বুদ্ধিমত্তার ছাপ। এক যুগ আগে তাঁর নির্বাচন যে সঠিক ছিল, আবারও প্রমাণ করলেন। বারো বছর বয়স বেড়েছে। কিন্তু সেটা যেন সংখ্যা মাত্র। নিজেকে অদ্ভুতভাবে মেইনটেইন করেছেন ‘ইন্ডাস্ট্রি’। তাই ছবিতে হাঁটুর বয়সিরা থাকা সত্ত্বেও, তিনিই নায়ক।

মুশকিল আসান
অনির্বাণ ভট্টাচার্য এই ছবির ইন্সপেক্টর বিজয় পোদ্দার। তাঁর অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিয়েছেন প্রসেনজিতের সঙ্গে। পক্ষপাত ভুলে পরিচালক তাঁর প্রতি আরেকটু সদয় হলে হয়তো ছবির মঙ্গল হত। তার মানে এই নয়, বিরাট খামতি থেকে গেছে। ছবির মৈত্রেয়ী ঘটক হলেন জয়া আহসান। পোদ্দার এবং মৈত্রেয়ীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক। মৈত্রেয়ী অনেক ক্ষেত্রেই মুশকিল আসান করেন। অনুপম রায় এবং রূপম ইসলামের গান চিত্রনাট্যের সঙ্গী হয়েই বেজেছে।

আরোপিত নয়
ছবিতে অ্যাকশন আছে। কাঁচা খিস্তি আছে। প্রেমের হাত ধরে এসেছে শরীর। তবে কোনওটাকেই আরোপিত মনে হয় না। সবকিছু এসেছে চিত্রনাট্যের দাবি মেনে। ছবির গ্রাফ কখনও উঠেছে, কখনও নেমেছে। ঢেউয়ের মতো। তবে চার প্রধান মুখ এবং বুদ্ধিমান পরিচালক শক্ত হাতে হাল ধরেছেন। যেভাবেই হোক তরি পার তাঁরা করবেনই। নৌকা ডুবল না তীরে ভিড়ল, সেটা সময় বলবে। তবে এটা মনে হয়েছে, সামনে যত বড় ঢেউ আসুক না কেন, এই নৌকা ডোবার নয়। সাকসেস পার্টি শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

Latest article