নবাবি আমলের বাংলা। মুর্শিদকুলি খাঁ-র শাসনকাল, নদিয়ার জমিদার ছিলেন রামকৃষ্ণ রায়। সময়মতো নবাবের খাজনা মেটাতে পারেননি। তাই মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁকে ঢাকার কারাগারে কয়েদ করলেন। সে- যাত্রায় রামকৃষ্ণকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন আর একজন সামন্তপ্রভু। বাঁশবেড়িয়ার জমিদার রাজা রঘুদেব রায়। বকেয়া অর্থ রামকৃষ্ণকে পৌঁছে দিলেন রঘুদেব। রামকৃষ্ণ কারাবাস থেকে রক্ষা পেলেন। কৃতজ্ঞ রামকৃষ্ণ রায় রঘুদেব রায়কে ‘শূদ্রমণি’ উপাধিতে ভূষিত করলেন।
কিছুদিন পর আবার একই ঘটনা ঘটল। খাজনা বাকি পড়ল রামকৃষ্ণ রায়ের। সেবারও তাঁকে ঢাকার কারাগারে পুরলেন মুর্শিদকুলি খাঁ।
ঢাকার কয়েদখানায় রামকৃষ্ণর সহবন্দি ছিলেন সমুদ্রগড়ের সামন্তরাজা রণজিৎ ভট্টঠাকুর। তিনিও খাজনা না দিতে পারার কারণে নবাবের হাতে বন্দি। রামকৃষ্ণর বকেয়া খাজনা যতটা, রণজিৎ ভট্টঠাকুরের বাকিপড়া খাজনার পরিমাণও ঠিক ততটাই।
মুর্শিদকুলি খাঁ বললেন, খাজনা দিতে না পারলে— একটা নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে বকেয়া অর্থ মেটাতে না পারলে— শাস্তিস্বরূপ দুজনকেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে হবে। নবাবের আদেশে, ধর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রণজিৎ আর রামকৃষ্ণ, দুজনের শিরদাঁড়াতেই হিমস্রোত বইয়ে দিল। দুজনেই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন।
অবশেষে এসে গেল নবাবের নির্দিষ্ট করে দেওয়া দিন। রণজিৎ ভট্টঠাকুরের দেওয়ান খাজনার বকেয়া অর্থ নিয়ে হাজির হলেন নবাবের দরবারে। কিন্তু রামকৃষ্ণ রায়ের তরফে কেউ এলেন না। কারাগারেই রামকৃষ্ণ আর রণজিৎ পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠেন। বন্ধুর সম্ভ্রম রক্ষায় এগিয়ে এলেন তাই আর এক বন্ধু। রামকৃষ্ণর বকেয়া খাজনা মেটাতে রণজিৎ ভট্টঠাকুর তাঁর জন্য আনা টাকাটাই নবাবকে দিয়ে দিলেন। রামকৃষ্ণকে আর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে হল না। মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁকে ছেড়ে দিলেন। ওদিকে রণজিৎ-এর কারামুক্তি ঘটলা না। তিনি ধর্মান্তরিত হলেন। তাঁর নতুন নাম হল আতাহার খাঁ।
কারাগার থেকে বেরোতে পারলেন না রামকৃষ্ণ রায়ও। সেসময় তাঁর বসন্ত রোগ হয়েছিল। তাই কারাকক্ষের ভেতরই রয়ে গেলেন তিনি। সেখানেই দুরারোগ্য বসন্ত রোগের কারণে তাঁর মৃত্যু হল।
কিছুদিন পর আতাহার খাঁ ওরফে রণজিৎ নিজের জমিদারিতে ফিরে এলেন।
সমুদ্রগড়ে প্রত্যাবর্তনের পর আতাহার সমুদ্রগড় রাজবাড়ির দেবদেবীর মূর্তিগুলোকে পাঠিয়ে দিলেন রাজবাড়ির বাইরে, সেবায়েত পুরোহিতদের ওপর ভার পড়ল, সেইসব দেবমূর্তি অর্চনা করার। একেশ্বরবাদী প্রতিমাপূজার বিরোধী ইসলামি ধর্মচারণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই আতাহারের ওই পদক্ষেপ। দেবার্চনায় যাতে কোনওরকম বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য আতাহার সেবায়েত ও পুরোহিতদের জমিও দান করলেন।
এভাবেই বংশ-পরম্পরায়, সমুদ্রগড় হয়ে উঠল দুই ধর্মের মিলনক্ষেত্র। সেখানে রাজবাড়ির অভ্যন্তরে পালিত হল ইসলামি পরব আর বাইরে হিন্দুদের ধর্ম-উৎসব (Durgotsav)। রাজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও গড়ে ওঠে মুসলমান নামকরণের পাশাপাশি হিন্দু নাম গ্রহণের প্রথা। তাই আজাহার যিনি, তিনিই জনার্দন, মোজহার যদু, ইদামত মধু, জিল্লার রহিম তিনু, এদাবুল আলম মুকুল।
আতাহার রাজবাড়ির বেশিরভাগ দেবদেবীর মূর্তিগুলোকে মোহন্তদের আখড়ায় পাঠিয়ে দিলেও দুর্গাপুজোর ভার দেন ব্রাহ্মণ রামলোচন বাগচীর ওপর। সেই রামলোচনের হাতে পূজিতা দুর্গা সমুদ্রগড়ের ‘লোচনমাতা’। সেই রামলোচনের ভিটের পুজো এখন সর্বজনীন। জাগ্রত দেবী লোচনমাতার কাছে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমুদ্রগড়ের মানুষ রোগমুক্তির মানত করে।
এরকম সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধনে পালিত দুর্গাপুজোর নজির বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কিসানগঞ্জে। এখানকার জমিদার ধর্মপরিচয়ে মুসলমান ছিলেন। তাঁর আমল থেকেই দুর্গাপুজো হত কুতুবগঞ্জ বাজারে। বাজারের আয় ধরা থাকত দুর্গাপুজোর খরচ মেটানোর জন্য। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সেই দুর্গার পরিচিতি ‘দুর্গা বিবি’ হিসেবে।
একইভাবে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের যৌথ দুর্গা-সাধনার (Durgotsav) প্রতীক রঘুনাথগঞ্জের দুনম্বর ব্লকের জোতকমল গ্রাম পঞ্চায়েতের লক্ষ্মীজনার্দনপুর বহুরা গ্রামের কোদাখাকি দুর্গার পুজো। জোতকমলের জমিদার শরৎচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় গিরিয়া-সেকেন্দ্রার গভীর অরণ্যের ভেতর দিয়ে আসার সময় দেখতে পান দেবী দুর্গার মূর্তি। সেই মূর্তি পুজো করত অরণ্যের ডাকাতরা। শরৎচন্দ্র দেবীকে প্রতিষ্ঠা করলেন জমিদারবাড়িতে। কিন্তু তাঁর পুজোতে সন্তুষ্ট হলেন না দেবী। স্বপ্নাদেশ দিলেন, তিনি কোনও মুসলমান পরিবারের মহিলার হাতে ভোগ খাবেন। বাধ্য হয়ে শরৎচন্দ্র শরণাপন্ন হলেন লোকাইয়ের মায়ের। তিনিই তখন ওই গ্রামের একমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী মহিলা। বিধবা লোকাইয়ের মা শরৎচন্দ্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। জানিয়ে দেন, তাঁর মতো হতদরিদ্র বিধবার পক্ষে দেবীর ভোগ তৈরি করা সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হল লোকাইয়ের মাকে। দেবী স্বয়ং তাঁকে স্বপ্নে আদেশ দিলেন। হিন্দু দেবীর ইচ্ছা মেটাতে মুসলমান বিধবা জঙ্গলের ভেতর থেকে কোদার খুদ জোগাড় করে এনে সেই খুদের নাড়ু নিবেদন করলেন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দেবী দুর্গাকে। প্রায় ৩৬২ বছর ধরে সেই প্রথা আজও চলছে। রঘুনাথগঞ্জের বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোর (Durgotsav) আজও প্রথমে কোনও মুসলমান পরিবারের তৈরি ভোগ দেবীকে নিবেদন করা হয়।
গুজরাতের গরবা অনুষ্ঠানে মুসলমানের প্রবেশ নিষিদ্ধ হতে পারে, বাংলার মাটিতে সেই বিভেদ-বিদ্বেষের বাষ্প শারদীয়া দুর্গোৎসবকে অনেক চেষ্টা করেও ছুঁতে পারেনি।
আরও পড়ুন- ইন্ডিয়ার চাপে থরহরিকম্প বিজেপির, ইতিহাস বদলানোর চক্রান্ত