বিজ্ঞানীদের কথায়, মানুষের মস্তিষ্ক হল বিস্ময়কর ও জটিল এক কাঠামো। ১০০ বিলিয়নেরও বেশি নিউরন দিয়ে তৈরি এই মস্তিষ্ক। বলা হয়, এই পৃথিবীতে সবার যদি একটি করে কম্পিউটার থাকে এবং সবাই এক সঙ্গে লগ-ইন করে একই সময়ে কাজ করেন, তার পরেও সেই কাজ মস্তিষ্কের দশভাগের একভাগ কাজের সমান হবে না। ডিমেনশিয়া হল সেই মাথার এমন ব্যামো যে রোগ হলে মানুষ ধীরে ধীরে তাঁর স্মৃতিশক্তি হারাতে থাকেন। ভুলতে থাকেন সব কিছু। একটি জটিল নিউরো ডিজেনারেটিভ রোগ।
আরও পড়ুন-অবশেষে ১৭ দিন পরে উত্তরকাশীর টানেল থেকে ‘মুক্তি’ ৪১ শ্রমিকের
কেন ভুলে যাই
মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট জায়গা, যা স্মৃতির প্রবেশপথ তাকে বলা হয় হিপ্পোক্যাম্পাস। এই এন্ট্রি পয়েন্টের উপরেই রোগটি আক্রমণ করে।
ডিমেনশিয়া হলে এই হিপ্পোক্যাম্পাস শুকিয়ে ছোট হয়ে যায়। যখন এটা ভাল থাকে তখন বিভিন্ন স্মৃতি সংগ্রহ করে জায়গামতো গুছিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু হিপ্পোক্যাম্পাস যখন নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন সে আর স্মৃতি গুছিয়ে রাখতে পারে না। এ-কারণে মানুষ তার নিকট অতীতের স্মৃতি হারাতে শুরু করে। কুড়ি বা তিরিশ বছর আগের স্মৃতি তার মনে থাকে কারণ সেই স্মৃতি গুছিয়ে রাখার জন্য তখন হিপ্পোক্যাম্পাস ভাল ছিল। এখন আর নেই।
আরও পড়ুন-দক্ষিণ আফ্রিকায় শুরুতে রোহিতরা নেই
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডিমেনশিয়া নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল যেখানে দেখা গিয়েছে বিশ্ব জুড়ে ৫৫ মিলিয়ন মানুষ এই রোগ নিয়ে বেঁচে রয়েছে এবং প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন করে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ল্যানসেট পত্রিকার তথ্য বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হবেন প্রায় এক কোটি ১৪ লক্ষেরও বেশি মানুষ। ২০১৯ সালে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতবর্ষে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৮ লক্ষ। অর্থাৎ, মাত্র কয়েক দশকে ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে প্রায় ২০০ শতাংশ। যে যে রোগে মানুষের মৃত্যু হতে পারে এটা তার মধ্যে অন্যতম। অথচ এখনও অনেকেই জানেন না যে কী করে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
আরও পড়ুন-সৈয়দ মোদি টুর্নামেন্ট শুরু, লখনউয়ের কোর্টে পাখি
এই রোগটির কথা ১৯০৬ সালে প্রথম উল্লেখ করেন আলোইস আলঝেইমার নামের একজন জার্মান চিকিৎসক। স্মৃতি হারিয়ে ফেলা একজন নারীর ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে তিনি দেখতে পান যে তাঁর মস্তিষ্ক শুকিয়ে গেছে এবং স্নায়ুকোষগুলো এবং তার আশপাশে অংশে অ্যাবনর্মালিটি রয়েছে। সেই সময় এটি ছিল খুব বিরল একটি রোগ।
আরও পড়ুন-১৭ দিন পর, অবশেষে একে একে উদ্ধার করা যাচ্ছে শ্রমিকদের
ডিমেনশিয়ার কারণ
মস্তিষ্কে সরবরাহকারী রক্তবাহী কোষগুলির ক্ষতির ফলে ডিমেনশিয়া হয়। বংশগত কারণও রয়েছে। এছাড়াও বারবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে, মস্তিষ্কে সংক্রমণ হলে, টিউমার হলে বা আঘাতজনিত কোনও ক্ষত থেকে, পারকিনসনস ডিজিজ, থাইরয়েডের মতো রোগে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে এবং ভিটামিনের অভাবেও ডিমেনশিয়া দেখা দিতে পারে। মস্তিষ্কে টিউমার হলেও ডিমেনশিয়া হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে আলঝাইমার্সের সঙ্গে এমিলয়েড বিটা প্রোটিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এসব প্রোটিন জমা হওয়ার কারণেই মস্তিষ্কের কোষের মৃত্যু হয়। এই কারণে এমিলয়েড বিটা প্রোটিনকে সরিয়ে দিতে পারলে মস্তিষ্কের কোষগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে।
ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়াতে মস্তিষ্কের এলাকার স্নায়ুকোষগুলির অবনতি হয় যা ব্যক্তিত্ব, ভাষা এবং আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আরও পড়ুন-সৈয়দ মোদি টুর্নামেন্ট শুরু, লখনউয়ের কোর্টে পাখি
উপসর্গ
প্রাথমিক পর্যায় স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া শুরু হয়, চিন্তাশক্তি কমতে থাকে।
দ্বিতীয় পর্যায় বিষণ্ণতা এবং উদাসীনতা আসে। মাঝে মধ্যে অস্থিরতা, রাগ, বিভ্রম এবং অল্পআধটু ভুল বকতে থাকে।
এর পরবর্তী পর্যায়ে আচরণের পরিবর্তন হতে থাকে, মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হতে থাকে, পরিচিত জায়গাতেও হারিয়ে যাওয়া অথবা কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে সঠিক শব্দটি খুঁজে না পাওয়া অর্থাৎ কথার খেই হারিয়ে ফেলতে দেখা যায়। বেশি ভুল বকে।
ডিমেনশিয়া গুরুতর পর্যায়ে গেলে রোগী খেয়েছেন কি না সেটাও মনে করতে পারেন না। চাবি কোথায় রেখেছেন, চেকে সই করেছেন কি না, এই মুহূর্তে সে কোথায় রয়েছে সবটাই তাঁরা সহজেই ভুলে যান।
একেবারে শেষের দিকে অসংযমী হয়ে পড়ে, চলাফেরায় অসুবিধা হয়, খাবার গিলতে সমস্যা হয় এবং পেশিতে খিঁচুনি আসে।
ডিমেনশিয়া থেকে বাঁচতে
এই রোগ থেকে বাঁচতে নিয়মিত মানসিক এবং শারীরিক কসরত জরুরি। যতটা পারেন অ্যাকটিভ থাকার চেষ্টা করতে হবে।
আরও পড়ুন-কোটায় ২০ বছর বয়সী ছাত্রের রহস্যমৃত্যু
সঠিক ওজন বজায় রাখুন। অতিরিক্ত ওজন মানেই সেটা রক্তচাপ বাড়াবে এবং একই সঙ্গে বাড়বে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা। এই দুটো রোগই কিন্তু পরবর্তী সময়ে ডিমেনশিয়া রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। একটানা এক জায়গায় বসে কাজ করা ঠিক নয়।
নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। অলস হলে শুধু ডিমেনশিয়া নয়, যে কোনও ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন। যোগব্যায়াম, প্রাণায়াম করুন। সময়ের খুব অভাব থাকলে ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে ভুলবেন না।
মদ্যপান ত্যাগ করুন। অতিরিক্ত মদ্যপান স্ট্রোক, হার্টের অসুখ, ক্যানসারের কারণ হতে পারে যা আপনার স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতি করবে। এই ক্ষতি পরবর্তী সময় ডিমেনশিয়াতে রূপান্তরিত হবে।
ধূমপান ছেড়ে দিন। ধূমপান করলে শিরা সরু হয়ে যেতে পারে, রক্তচাপ বাড়তে পারে যা আপনাকে ক্রমশ কার্ডিওভাসকুলার রোগের দিকে নিয়ে যাবে। এবং একই সঙ্গে এটার কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে।
চাপমুক্ত থাকুন। অতিরিক্ত চাপ নিলে বা সারাক্ষণ চাপে থাকলে বাড়তে পারে ডিমেনশিয়ার সম্ভাবনা। অতিরিক্ত উত্তেজনা ভাল নয় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। মেন্টাল প্রেশার কমান। শরীরকে সচল রাখুন।
আরও পড়ুন-নিমতৌড়িতে শপথ তৃণমূলের, জোড়া ফুলে জোড়া আসন
ডিমেনশিয়ার আশঙ্কা বাড়ায় এমন খাবার ত্যাগ করুন। যেমন ঠান্ডা পানীয়, বেশি নুন-চিনি। রাস্তার খাবার, আইসক্রিম, ডুবোতেলে ভাজা মাংস, সস, প্রক্রিয়াজাত পাউরুটি ও প্যাকেটজাত খাদ্য। নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত চেক আপ করান। পুষ্টিকর খাবার খান।
রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা
ডিমেনশিয়ার রোগটি নির্ণয় করতে রোগীর মেডিক্যাল হিস্ট্রি জানা এবং শারীরিক পরীক্ষার প্রয়োজন। রোগীর অবস্থা বুঝে অনেক ধরণের পরীক্ষা হতে পারে।
মিনি-মেন্টাল স্টেট এগজামিনেশন (এমএমএসই) হল বুদ্ধির কার্যকারিতা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা।
এছাড়া প্রয়োজনে রক্ত পরীক্ষা। মস্তিষ্কের এমআরআই বা সিটি স্ক্যান। ইইজি করার পরামর্শ দেন চিকিৎসক।
ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা হয় তবে খুব বেশি কার্যকারিতা নেই ওষুধের। প্রথম পর্যায় ডিমেনশিয়া ধরা পড়লে ওষুধে কাজ করে। এই ধরনের রোগীর সাহায্যের প্রয়োজন কারণ। সময় পেরোলে সমস্যা বাড়তে থাকে।