শুচিস্মিতা চক্রবর্তী
আয়নার প্রতিবিম্বটাকে আজকাল সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয়।
ঠাকুমা বলত, ‘নাতনি আমার রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী। পাকা গমের মতো বরণ, দুর্গা ঠাকুরের মতো মুখশ্রী, তার উপর লেখালেখি। খবরের কাগজে লেখা বেরোলে কত লোকে প্রশংসা করে; কোনও রাজপুত্তুরই দিদিভাইকে রানি করে নিয়ে যাবে।’
আরও পড়ুন-আদিবাসী সমাজকে কলুষিত করল বিজেপি, গদ্দারদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল বাংলা
ঠাকুমার কথা এক অর্থে সত্যিই হয়েছে। লেখার প্রেমে পড়েই রানা আমায় পছন্দ করে। বিশাল বিত্তশালী রানার পরিবার আমার রূপ-গুণ দুইয়েরই কদর দিয়েছে। প্রত্যেকের এই অতিরিক্ত কদর দেওয়াটাই আমার কাল হল। আমি নিজেকে অন্যদের থেকে তুলনায় অনেক বেশি দর দিয়ে ফেললাম। আমার রূপ, গুণ, ভাগ্য নিয়ে বান্ধবীদের ঈর্ষা আমার অহং-এর কারণ হয়ে দাঁড়াল। আমি হারতে এবং পরাজয় স্বীকার করতে ভুলে গেলাম।
অবশ্য আমার ভুলের মাশুল আমাকেই দিতে হল। কোথায় সেই আগুন ঠিকরে পড়া রূপ! গাত্রবর্ণের ধূসরতা, চোখের নিচের কালিমা অনির্দিষ্টকালের অনিদ্রার সাক্ষী। কিন্তু এসবের কারণ কি নিতান্তই অমূলক নয়!
যে আমি, আমার রূপ, গুণ এবং লেখা হাজারো লোকের ঈর্ষার কারণ, সেই আমি নাকি এক অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছি। তাও আবার কার সঙ্গে? নিজের আত্মজার সঙ্গে?
আরও পড়ুন-আজ সর্বদল বৈঠক, থাকবে তৃণমূলও
লোকে বলত, ‘মেয়ে সুন্দরী হলেও মায়ের মতো নয়।’ একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তি তিরতির করে সারা শরীরে, মনে ছড়িয়ে পড়ত। মেয়েকে আরও সুন্দর করে সাজাতাম। ছোট্ট রঙিন প্রজাপতির মতো আমার মধুজা উড়ে উড়ে বেড়াত। লোকে আমায় দায়িত্বশীলতার প্রতীক মানত। আমি মেয়ের যত্নে আরও নিমগ্ন হয়ে পড়তাম। রানা প্রায়ই বলত, ‘মেয়েকে নিয়ে তোমার এই পাগলামিটা বন্ধ কর মাধুরী। ওকে নিজের মতো বড় হতে দাও। দমবন্ধ লাগবে যে, বড় হচ্ছে…’
দমবন্ধ আমার লাগত। যখন দেখতাম, কী সহজেই এক-একটা কঠিন মাইলস্টোন অবলীলায় অতিক্রম করে চলেছে আমার মধু। তবে আমাকে ছাপিয়ে যেতে কোনও দিনই দিইনি। একটা শক্ত পাশে সমস্তটাকে নিজের করায়ত্ত করে রেখেছিলাম।
কিন্তু বজ্র আঁটুনির কি সত্যিই গেরো ফস্কা? নাহলে আমার নাগপাশে থেকেও কীভাবে অমৃতের সন্ধান পেল মধুজা?
সায়ন যেদিন প্রথম বলেছিল, ‘আন্টি মধুজার লেখা আপনি পড়েছেন? আমাদের কলেজ ম্যাগাজিনে ওর লেখা সাড়া ফেলে দিয়েছে। জাস্ট অসাধারণ। আপনি আরও ভাল বুঝবেন।’
আরও পড়ুন-রিঙ্কু, অক্ষরে সিরিজ ভারতের
—‘কই, মধু আমাকে কোনওদিন ওর লেখার সম্বন্ধে বলেনি… ইনফ্যাক্ট ও যে লেখে, আমি তাই জানি না।’
—‘কী যে বলেন আন্টি! আপনি নিজেই এত ফেমাস লেখিকা…।’
—‘সে জন্যই মধু আমায় বলেনি?’
—‘হয়তো লজ্জায় বলেনি। কিন্তু আপনি লেখাগুলো পড়লে বুঝবেন, ও আপনার থেকেও ভাল লেখে…।’
চমকে উঠে বিস্ফারিত নেত্রে তাকাই সায়নের দিকে। বলে কী ছোকরা? এত সাহস! কী লিখেছে মধু? কতটা ভাল লিখেছে? কী জানে ও সাহিত্য সম্পর্কে? একটা কলেজ ম্যাগাজিনে ছাইপাঁশ লিখে মাধুরী সেনগুপ্তর সমকক্ষ হতে চাইছে?
আগুন জ্বলে উঠল আমার চোখে। সায়ন আমার চোখের ভাষা পড়ে আমতা আমতা করে বলল— ‘না মানে, আমি আসলে তা বলতে চাইনি। আপনি একজন সিনিয়র লেখিকা…।’
—‘থাক সায়ন, তুমি এখন আসতে পার। আমি মধুজার সঙ্গে কথা বলে নেব।’
সেদিন কি আমার ইগো হার্ট হয়েছিল? আমার মেয়ে ভাল লেখে শুনে আমার গর্বিত হওয়া উচিত ছিল না কি? নাকি আমার থেকেও ভাল লেখে শুনে আমার ক্রোধ জাগ্রত হয়েছিল। শুধুই ক্রোধ? নাকি ঈর্ষাও!
আমার সেদিন ভয় হয়েছিল। আমায় নিয়ে লোকের এই ঈর্ষা, মাতামাতি ক্ষণিকেই শেষ হয়ে যাবে না তো? এই বিখ্যাত থাকার মোহই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে কিনা আমারই মেয়ে! তিল তিল করে গড়া সাম্রাজ্য, আমার পরিচয় আরেকজনের সাফল্যের ভারে ক্ষণিকেই হারিয়ে যাবে?
আয়নার ওপাশের আমি অবশ্য আমাকে বারবার বলেছিল, ‘কার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামছ মাধুরী? মধুজা যে তোমার আপন অংশ। ও জিতলে যেমন তোমার জয়, ও হারলেও যে সেটা তোমারই হার।’
সেদিন আমি শুনিনি। ওই কায়াহীন মায়ারূপী প্রতিবিম্বকে চুরমার করে দিয়েছি। আয়নার কাচে ফালাফালা হয়েছে আমার পা। রক্তারক্তি কাণ্ড। কিন্তু আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বোধ হয় কেউ দেখতে পায়নি সেদিন। দু’দিনের লেখালেখিতেই মধুজার ফ্যানফলোয়িং আমার প্রায় তিনগুণ।
আরও পড়ুন-স্বচ্ছতা আনতে বিজ্ঞপ্তি জারি করল অর্থ দফতরের ই-গভর্ন্যান্স শাখা
সায়নের সঙ্গে বন্ধুত্বের বাইরেও যে মধুজার একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠছে সেটা আমার বুঝতে কোনও অসুবিধেই হল না।
ডাকলাম সায়নকে একদিন বাড়িতে। মধুজার অনুপস্থিতিতে। মধুজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে হবে না!
বাচ্চা ছেলে। আষ্টেপৃষ্ঠে মোহপাশে জড়িয়ে পড়ল। এই মাধুরী সেনগুপ্তর রূপ আর ছলাকলার খ্যাতি উপেক্ষা করে কার সাধ্য।
কে যেন বলেছিল ‘everything is fair in love and war’ আর আমি নেমেছি যুদ্ধে আমারই এক সত্তার সঙ্গে আরেক সত্তার। এই যুদ্ধের যাই পরিণতি হোক, পরাজয় আমারই। সব জেনে বুঝেও ঝাঁপ দিয়েছি আগুনে।
মধুজা পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ল।
—‘এ কোন শাস্তি দিচ্ছ মাগো? সায়ন তোমার ছেলের বয়সি। ওকে ক্ষমা কর।’
কুম্ভীরাশ্রু না কী বলে, সেটাই কষ্ট করে চোখে এনে কান্না কান্না গলায় মেয়েকে জড়িয়ে ধরলাম।
—‘আমিও তো ওকে ছেলের মতোই মনে করতাম রে মধু। তোকে সারপ্রাইজ দেব বলেই তো ওকে ডেকেছিলাম। একসঙ্গে প্ল্যানিং করছিলাম। কিন্তু ও যে এইভাবে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে…’
—‘তুমি ভুল বুঝছ মা…।’
—‘তাহলে ঠিকটা তুমি বোঝো মধু।’ মুখের রেখাগুলো দুমড়ে মুচড়ে কুঁকড়ে হিংস্র বাঘিনির মতো হয়ে উঠল। মধুজা তার এতদিনের পরিচিত মায়ের এই রূপ দেখে হাঁ হয়ে গেল।
সম্বিৎ ফিরল আমারই ডাকে।
—‘কী ঠিক করলে? লেখালেখি চালিয়েই যাবে?’
চোখ মুছে ধীরে ধীরে মধু উঠে দাঁড়াল।
—‘শুধু আমি লিখি বলে তোমার এত রাগ মা?’
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের সামনে ভাটিকা, আই লিগে আজ অভিযান শুরু কিবুর দলের
—‘শুধুমাত্র লিখলে তো কোনও ক্ষতি ছিল না মা। সেই লেখা তুমি পাবলিশ করলে। তোমার লেখায় লোক পাগল হয়ে গেল। মাত্র এই ক’দিনেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তোমার ফলোয়ার্স আমার প্রায় তিনগুণ। তারা তোমার লেখার সঙ্গে আমার লেখার তুলনা করছে। আমার লেখা তাদের কাছে ব্যাকডেটেড। তোমার কবিতায় নতুন ছন্দ, নতুন শব্দ, নতুন ভাব তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তোমার গল্পের চরিত্রের সঙ্গে তারা একাত্মবোধ করছে। আমি আমার সাজানো পৃথিবী হারিয়ে ফেলছি মধু। আঙুলের ফাঁক দিয়ে বালির ন্যায় সবকিছু আমার হাত ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছে। তুমি কেড়ে নিচ্ছ।’
শেষের কথাগুলো দাঁতে দাঁত চিপে বেরিয়ে এল।
—‘তাহলে তো আমি তোমার অপরাধী। সায়ন কেন?’
—‘তোমায় পঙ্গু করে দিতে। সায়ন তোমার আসল মেরুদণ্ড। আমি জানতাম, ওকে ভাঙলেই তুমি শেষ।’
—‘তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারলে?’
—‘আমি শিল্পী, আমি স্রষ্টা। আমার রূপ, মেধা আমার অর্জিত নয়। এ-সবের আমি জিনগত বাহক। কিন্তু লেখা আমার একদম নিজস্ব সৃষ্টি। আমার পরিচায়ক। আমার এই লেখিকা-সত্তার শেষ আমি হতে দিতে পারি না। আমার লেখা লোকের মনে না থাকলে, আমায় মনে থাকবে কী করে? আমি তো কালের গর্ভে হারিয়ে যাব মধু!’
—‘শুধুই এই মোহে? এই নাম আর খ্যাতির মোহে তুমি আমার জীবনটা তছনছ করে দিলে? তুমি এতটা স্বার্থপর?’
—‘স্বার্থপর কি না জানি না, কিন্তু ‘মাধুরী সেনগুপ্ত, মাধুরী সেনগুপ্ত’ বলে লোকজনের উল্লাস, উন্মাদনা একদিন জাস্ট ‘নেই’ হয়ে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারব না।’
আরও পড়ুন-শিশু নক্ষত্রের ভিড়ে
—‘সে আজ নয় কাল তো হবেই মা। আমার বদলে না হয় অন্য কেউ। পরিবর্তন তো জীবনের ধর্ম। তোমার আগেও কেউ ছিল, পরেও কেউ আসবে। তুমিও তো চিরকাল থাকবে না। সৃষ্টিতে যেমন স্রষ্টার পরিতৃপ্তি হয় না, চিরকাল সে আরও আরও উন্নত সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকে। তেমন পাঠকেরাও আরও নতুনত্বের আশায় থাকে। তাদেরও তো তৃপ্তির সম্পৃক্তি নেই। অমর বলে তো কিছুই নেই মা…।’
—‘the key to immortality is first living a life worth remembering…’
—‘মনে তোমায় সবাই এমনিই রাখবে মা, like a creator or a destroyer, you decide।’
আয়নার ওপাশে আমি আবার আমাকে খুঁজে চলেছি। ছোট্ট মধুজা আয়নার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে বলছে ‘মা টুকি’। কচি কচি গায়ের দুধেল গন্ধে মাতোয়ারা আমি আমার আত্মজার বুক থেকে প্রাণ ভরে সেই মিষ্টি ঘ্রাণ নিই। এই গন্ধটা আমাকে মা হওয়ার আশ্বাস দেয় প্রতিবার। কিন্তু বহুদিন যেন এই গন্ধটা কোথাও হারিয়ে গেছে। আয়নার ও-পাশের মাধুরী সেনগুপ্তর দাঁত, নখ বেরিয়ে আসা কদাকার মুখ আমায় পীড়া দেয়। আমি নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে রিপুর তাড়নায় সব কিছুই হারিয়ে ফেললাম।
আরও পড়ুন-বাংলার ঝুলিতে বাঙালির ভাটনগর
তবুও মুক্তি পেলাম কই?
সায়নের আত্মহত্যার পর মধুজা লেখালেখি ছেড়ে দেয় পাকাপাকিভাবে। সঙ্গে দেশও। আর ফিরে আসেনি।
আমি এখনও খবরের শিরোনামে। সায়ন ওর সুইসাইড নোটে আমার নাম দিয়ে আমাকে চিরতরে ফেমাস করে দিয়ে গেছে। কোর্টের হিয়ারিং-এর ডেট পড়লেই শুরু হয় আমায় নিয়ে হইচই।
হাতগুলো এখন আর কাজ করে না। কেমন যেন সাড় নেই। রানা বলে ‘এটাই উচিত শাস্তি’। স্রষ্টার সৃষ্টি করার ক্ষমতাটাই হারিয়ে গেল।
তবুও জীবনের শেষ উপন্যাসটা ঠিক লিখব। ‘এনিমিজ ইন মাই লাইফ’, আমার উপন্যাস। ঠাকুমার কথা, রানার কথা, সায়নের কথা, মধুজার কথা। আমার শেষ স্বীকারোক্তি। শুধু একজন ভাল রাইটার চাই। যে আমার থেকে যাওয়ার দলিলের শেষ সাক্ষী; আমার অমরত্বের দোসর। অঙ্কন : শংকর বসাক