শেষ পর্যন্ত শতরানের সামান্য আগে থামলেন নরেন্দ্র মোদি। যেভাবে লোকসভা ও রাজ্যসভায় অধ্যক্ষ ও চেয়ারম্যান ব্যাট চালাচ্ছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল শতরান পেরিয়ে যাবেন! কিন্তু কী ছিল বিধাতার মনে, থামলেন। একই দিনে আইনসভার দুই কক্ষ থেকে ৭৮ জন সাংসদ বহিষ্কৃত হলেন। এই শীতকালীন অধিবেশনে সর্বমোট ৯২ জন বহিষ্কৃত। বিরোধী দলগুলোর নেতা-সহ সব সাংসদদের বহিষ্কার করে শ্মশানের শান্তি নামিয়ে আনতে চাইছে সংসদের কক্ষে। আর যাতে কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে বিস্তর সন্দেহযুক্ত বিলগুলো পাশ করে নেওয়া যায়। অতীতেও বিজেপির সরকার ছিল। এমন প্রতিহিংসামূলক আচরণ দেখা যায়নি কখনও। বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার এমন হিংস্র চেষ্টা অতীতে কোনওদিন দেখা যায়নি। ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে ফ্যাসিবাদীরা তাদের দর্শন কায়েম করার জন্য সংবাদমাধ্যম, আইনসভা, গণতন্ত্র সবার প্রথমে ধ্বংস করবে এবং নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে। সেদিক থেকে বিজেপি সব সূচক মান্য করেছে। এমন ফ্যাসিবাদী শক্তি অতীতে ভারতে আসেনি।
আরও পড়ুন-জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের উদ্যোগে রাজ্যের ৭০ লাখ বাড়িতে পরিশ্রুত পানীয় জলের সংযোগ
সংসদ অধিবেশন দেখতে আসা কয়েকজন মানুষ ১২ ডিসেম্বর দর্শক গ্যালারি থেকে সংসদে ঝাঁপ দেয় ও ধোঁয়া বিতরণ করতে থাকে। বিজেপির এক সাংসদের অতিথি হয়ে তারা সংসদভবনে ঢুকেছিল। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে নতুন সংসদভবন হয়েছে। বিজেপির গর্বের শেষ নেই। সেখানে এমন অসৈরণ হবে এবং সেটা তাদের সাংসদের মাধ্যমে এটা জেনেই প্রধানমন্ত্রী-সহ সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। অধ্যক্ষ তো ঠিকই করতে পারছেন না কী করবেন। রাজ্যসভায় চেয়ারম্যানের অবস্থা তার চাইতেও খারাপ। এমন অবস্থায় বিরোধীরা সংসদ এবং সাংসদদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এবং উচ্চমার্গে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের কাছে এটাই প্রত্যাশা করে। বিরোধীরা দলমত নির্বিশেষে এটাই করেছেন। শাসকদল সেটা মোকাবিলা করতে না পেরে সাংসদদের বিতাড়নের রাস্তা নিয়েছে। যা গণতন্ত্রের উপর ঘৃণ্য, নগ্ন আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এর আগেও সাংসদদের নানা কারণে ব্যাপক সংখ্যায় সভা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে। কিন্তু সেটা ৭০ পার হয়নি। আর পরদিনই বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। নরেন্দ্র মোদি এক্ষেত্রেও সর্বকালীন রেকর্ড করে ফেললেন। ফ্যাসিবাদীদের থাবা কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে?
আরও পড়ুন-আত্ম.হত্যা নাকি কনস্টেবলের খু.ন, রহস্যে মোড়া হরিদেবপুরকাণ্ড
কেন্দ্রের সরকার এবং তার কেষ্টুবিষ্টু মন্ত্রীরা ভয় পেয়েছেন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। সংসদে দাঁড়িয়ে এসব ব্যাপারে কোনও কথা বলার সাহস হচ্ছে না তাঁদের। সংসদ বসছে। প্রধানমন্ত্রী এ-ব্যাপারে বাইরে বক্তব্য রাখছেন। ঘোরতর অপরাধ। এটা করা যায় না। গৃহমন্ত্রী তাঁর অন্যতম দোসর। তাঁকে তাঁর প্রিয় নন্দীভৃঙ্গিরা ইতিমধ্যে ‘লৌহমানব’ আখ্যা দিতে তৎপর হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ- ব্যাপারে পোস্টার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাঁরও সাহস হচ্ছে না সংসদে এ-ব্যাপারে বিবৃতি দিতে। সামান্য এই দাবিটুকুই বিরোধীরা করেছেন। সামান্য দাবিটুকু না মেনে বহিষ্কার করছেন সাংসদদের। এ-ব্যাপারে সংসদীয় ব্যবস্থার দু’টি বিষয় মনে করিয়ে দিই। প্রথম, লোকসভায় সরকার পক্ষ বিবৃতি দেওয়ার পর সে-ব্যাপারে আর কোনও ক্লারিফিকেশন চাওয়া যায় না। যদি অধ্যক্ষ বিশেষভাবে তা অনুমোদন না করেন। কিন্তু রাজ্যসভায় ঠিক উল্টো। সরকারের বিবৃতির পর সদস্যরা ‘ক্লারিফিকেশন’ চাইতে পারবেন। মন্ত্রীদের ভয় এখানেই। কারণ তাঁদের কাছে এমন গর্হিত অপরাধের কোনও জবাব নেই।
আরও পড়ুন-সংসদ হা.নার ঘটনা বাড়িয়েছে উদ্বেগ, বাড়ছে রাজ্য বিধানসভা এবং নবান্নের নিরাপত্তা
দ্বিতীয়টি, সংসদ চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী বা কোনও মন্ত্রী সংসদের বাইরে কোনও ব্যাপারে বা ঘটনায় বিবৃতি দিতে পারবেন না। আমার মনে পড়ছে সীমান্তে একবার বড় গন্ডগোলের খবর পাওয়া গিয়েছে একেবারে সন্ধ্যার মুখে। লোকসভা উঠে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত রাজ্যসভার দিকে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনও খবর না থাকায় মাত্র ৩/৪ মিনিট আগে রাজ্যসভাও শেষ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কোনও বিবৃতি দিতে পারলেন না। পরদিন সকাল ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। প্রধানমন্ত্রীর নাম মনমোহন সিংহ। এখন এসব অতীত। সংসদীয় নিয়মকানুনের এখন আর কেউ তোয়াক্কা করে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে রাজাধিরাজ মনে করেন। সবাইকে প্রজা ভাবেন। ফ্যাসিবাদীরা সবসময় আইনসভাকে গুরুত্বহীন করে দিতে চায়। বিজেপি সেই পথ অনুসরণ করছে তাই না, প্রধান শাগরেদ হয়ে উঠেছে। ক’দিন আগেই মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সভায় মহুয়াকে বলতে দেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে যুক্তি দেওয়া হয়েছে ২টি। এক—এথিক্স কমিটিতে বলার প্রভূত সময় পেয়েছেন মহুয়া। তাহলে আবার কেন? দুই— এরকম একটা কেসে পূর্বতন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় অভিযুক্তকে বলতে দেননি। প্রথমত, এথিক্স কমিটি সংসদ নয়। সংসদের মধ্যে সাংসদের বলার অধিকার নিয়মে আছে। আর আইনে আছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। মান্য করা হল না। দ্বিতীয়টি— সোমনাথবাবু অভিযুক্তকে বলতে দেননি তার কারণ তারা বড় নস্যির ব্যাগে করে কোটি কোটি টাকা সংসদের মধ্যে এনেছিল এবং তা হাতে করে অন্য সাংসদকে বিতরণ করছিল। এমন ক্লেদাক্ত কাজ করার পর কাউকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া যায় না। মহুয়ার ক্ষেত্রে কি তাই? একইভাবে বিচার হবে? হতেই পারে না। আসলে অধ্যক্ষ নিজে জানেন না তিনি কী করবেন? সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে একটা নির্দিষ্ট রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। হল না। হতাশ।
আরও পড়ুন-কানপুরে দ.লিত অনুষ্ঠানে ভাঙ.চুর, গু.লি চালাল দুষ্কৃ.তীরা, গ্রেফতার ৫
হতাশায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যা খুশি তাই করছেন। তাঁর একবারও মনে হয় না —বিগত ৫ বছরে তাঁর ডেপুটি— ডেপুটি স্পিকার তৈরি করতে পারল না বিজেপি। বহুদিন ধরে দেশের গণতন্ত্র ধুলোয় লুণ্ঠিত। ১৪০ কোটি মানুষের দেশ এই প্রিয় জন্মভূমি ভারত। সেখানে গণতন্ত্র হচ্ছে মানুষের অন্তরের চাহিদা। এই চাহিদাকে ধ্বংস করতে রাস্তায় নেমেছে বিজেপি। সরকারি বেশ পরেছে গায়ে। বিচারব্যবস্থা আইন ব্যবস্থা আমলাগণ— সব ক্ষেত্রে গেরুয়াকরণের নীতি গ্রহণ করেছে। একদিন হয়তো দেখা যাবে উচ্চ আদালতের বাড়িটাই আছে, নতুন সংসদভবনের বাড়িটাই আছে, আর কিছু নেই। দেশের মানুষের সামনে এমন বিপদ আসার, ঘোরকৃষ্ণ সময় আসার আগে আমাদের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে মুখর হতে হবে। গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা বাঁচানো সবচেয়ে বড় কাজ।