আবার সে এসেছে ফিরিয়া৷ শীত এলেই যেমন পরিযায়ী পাখি আসে। এবঙ্গে ভোট এলে যেমন সিবিআই-ইডি আসে, তেমনি ফি বছর ‘সিএএ’ চালুর খবরও দিল্লি থেকে আসা বিজেপি নেতারা ভাসিয়ে দেন। গত কয়েক বছর যাবৎ এই এক নাট্য এখন চর্বিত চর্বণে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন-খেজুরগুড়ের মান বজায় রাখতে সক্রিয় প্রশাসন
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সংসদে পাশ হওয়া ইস্তক সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আইনের প্রতিবাদ করে গেছেন। এই প্রতিবাদের প্রথম কারণ, এই আইন ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়াকে মান্যতা দেয়। যা ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর বিপ্রতীপে অবস্থান। পাকিস্তান বাংলাদেশ বা নেপাল-সহ ভারতের প্রতিবেশী যেকোনও দেশ থেকে শরণার্থী হিসেবে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ-সহ যে কোনও ধর্মালম্বী মানুষকেই নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে এই আইনে। বাদ কেবল মুসলিমরা৷ ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে কেন, এভাবে একটি সম্প্রদায়ের মানুষকে ব্রাত্য করে রাখা হবে তা নিয়ে বরাবর প্রশ্ন তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ দেশের বৃহত্তর অংশের শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। যার কোনও সদুত্তর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দিতে তো পারেইনি উলটে এদেশে থাকা কোটি কোটি মুসলমান সমাজের মানুষদের প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে সিএএ অথবা এনআরসি করে দেশ থেকে বিতাড়িত করার ডাক দিয়েছেন বহু বিজেপি নেতারা!
আরও পড়ুন-জন্মভিটেয় সমাহিত উস্তাদ, রাষ্ট্রীয় সম্মানে বিদায়
তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকেই সরব, যে নাগরিকত্বের কথা বলা হচ্ছে, তাতে নতুন করে কী কী পাবে এদেশের মতুয়া বা পূর্ববঙ্গ থেকে আসা পরিবাররা? কারণ, একজন ভারতবর্ষের নাগরিক যা যা সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন, তার প্রত্যেকটিই বাংলার মতুয়া সমাজ পেয়ে থাকে। একই সঙ্গে তাদের বৈধ আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ডও আছে! প্রশ্ন উঠছে, যদি মতুয়ারা ভারতের নাগরিকই না হন, তাহলে তাদের ভোটে নির্বাচিত শান্তনু ঠাকুর কী করে দেশের আইনসভার সদস্য হয়ে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন? তাহলে তো শান্তনু ঠাকুরের নির্বাচনটাও অবৈধ! এই পুরোনো প্রশ্নগুলো ফের একবার মাথাচাড়া দিচ্ছে, কারণ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত ডিসেম্বরে কলকাতায় এসে সভা করে বলে গেছেন, সিএএ দ্রুত চালু হবে৷ আর তারপরেই নয়া বছরেও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার নাকি সিএএ তথা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ধারা প্রস্তুত করে ফেলেছে, এবং খুব দ্রুতই অনলাইনে নাগরিকত্বর জন্য আবেদন করা যাবে। মজাটা এই জায়গাতেই। গত ৫-৬ বছর ধরে নির্বাচন এলেই বিজেপি এই নাগরিকত্ব দেওয়ার একটি ‘ললিপপ’ দেশের এক শ্রেণির মানুষের সামনে ঝুলিয়ে দেয়! বিশেষত বাংলার মতুয়া সমাজকে এই নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলে একের পর এক ভোটে প্রতারিত করে চলেছে বিজেপি। মনে রাখা দরকার, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দেশ জুড়ে প্রবল বির্তকের মধ্যেও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদে পেশ করে নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহরা। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর যে বিল আইনে পরিণত হয়! অথচ গত চার বছর কেটে গেলেও এই আইনের ধারা তৈরি করেনি নরেন্দ্র মোদি সরকার।
আরও পড়ুন-দুই মামলা, সজোরে দুই ধাক্কা দুই বিচারপতিকে
শুধু ৬ মাস বাদে বাদে ‘এক্সটেনশন’ করে গেছে। এখন ঠিক লোকসভা নির্বাচনের দু মাস আগে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যে আইনের ধারা প্রস্তুত। এবার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যাবে। এবার যদি ধরেও নিই যে আগামী একমাসের মধ্যে নাগরিকত্বের আবেদন শুরু করা হবে, তবুও কোনও মতেই এত বিপুল সংখ্যক আবেদনকে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করে কমপক্ষে বছরখানেকের আগে সমস্ত আবেদনকারীর হাতে নাগরিকত্ব তুলে দেওয়া সম্ভব নয়! অর্থাৎ, ঠিক লোকসভা নির্বাচনের আগে বিশেষত বাংলার মতুয়া এবং ওপার বাংলা থেকে আসা নাগরিকদের কাছে আবারও ‘নাগরিকত্বে’র ললিপপ দেখিয়ে কার্যত ভোট চাইতে যাবে বিজেপি! বিজেপির মনোভাব খুব স্পষ্ট, আগে তোমরা ভোট দাও তারপর নাগরিকত্ব দেব! অথচ আমরা যতদূর জানি, কোনও একটি দেশের নাগরিক না হলে সেই দেশের নির্বাচনে অংশ বা ভোটাধিকার প্রয়োগই করা যায় না! কিন্তু তারপরেও, এই নাগরিকত্ব বা সিএএ নামক খুড়োর কল দেখিয়ে বিজেপি প্রতিবার বাংলার মতুয়া সমাজকে প্রতারিত করে!
আরও পড়ুন-বিচারপতিদের মুখে লাগামের আর্জি, সুপ্রিম কোর্টে অভিষেক
এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের আরও একটি দিক রয়েছে, যা বাংলা তথা ভারতের মূলত আসামের হিন্দু বাঙালিদের জন্য বিপজ্জনক। এই আইনে বলা হচ্ছে, প্রতিবেশী কোনও দেশ থেকে ধর্মীয় হানাহানি বা হিংসার স্বীকার হয়ে শরণার্থী হিসেবে এদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাই আপনার নাগরিকত্ব চাই। এবার সরকার মনে করলে আপনাকে নাগরিকত্ব দেবে। অথচ আপনার রেশন আধার প্যান সবরকম কার্ডই আছে। আপনি ভোটও দিতেন। অথচ আপনি এতদিন নাগরিকই ছিলেন না! অনলাইনে (এখনও অবধি যা জানা যাচ্ছে, তাতে নাকি অনলাইনেই সব তথ্য আপলোড করতে হবে) সমস্ত তথ্য তুলে ধরার পর, সংশ্লিষ্ট দপ্তর যদি মনে করে যে আপনি সঠিক তথ্য দিয়েছেন তবেই আপনি নাগরিকত্ব পাবেন! আর যদি না পান? তখন? কারণ, আপনি যখন আবেদন করছেন, তখনই নিজেকে এদেশের নাগরিক হিসেবে নয় বরং ‘শরণার্থী’ হিসেবে নিজেই ঘোষণা করছেন! তখন কি আপনাকে ‘ডি-ভোটার’ বলে চিহ্নিত করবে রাষ্ট্র? ‘ডি-ভোটার’ অর্থাৎ ডাউটফুল ভোটার। মানে আপনি রাষ্ট্রের জন্য সন্দেহজনক! এরপর আপনার স্থান কোথায় হবে? ডিটেনশন ক্যাম্পে। মনে রাখতে হবে, অমিত শাহ বহু আগেই আমাদের ‘ক্রনোলজি’ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। সিএএ চালু হলে এনআরসিও হবে। আজ না হোক কাল হবেই। তখন কী হবে? অসমে এনআরসি-র পরে কিন্তু শুধু মুসলমানদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠায়নি বিজেপি সরকার। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালিকেও ‘বিদেশি’ বলে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়েছে সেখানকার বিজেপি সরকার! ঠিক এই আশঙ্কার জায়গাগুলো থেকেই এই আইন নিয়ে প্রথম থেকে আপত্তি তৃণমূল কংগ্রেসের। যে কারণে ২০১৯ থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নাগরিকত্ব আইনকেই ‘ভুয়ো’ বলে আসছেন।
আরও পড়ুন-বইমেলা উপলক্ষে দুশো বিশেষ বাস নামাচ্ছে রাজ্য পরিবহণ দফতর
২০২৪-এর লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে পরিযায়ী নেতারা যেমন বাংলায় আসছেন, তেমনিই তাদের সিএএ নিয়ে ঢক্কানিনাদও পুনরায় শুরু হয়েছে। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এবং ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার মতুয়া সমাজের একাংশ বিজেপির পরিযায়ী নেতাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে যেভাবে নাগরিকত্ব ইস্যুতে প্রতারিত হয়েছিলেন, সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন থেকেই বাংলার গোটা মতুয়া সমাজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে তাঁরা আগামীদিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই থাকবেন। কারণ, এই ভুয়ো নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আসলে বাংলার মতুয়া সমাজকে তাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে অশান্তি ডেকে আনার কৌশল! এই নাগরিকত্ব আইন দেখিয়ে হয়তো দুয়েকজন নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মতুয়া সমাজের লক্ষ লক্ষ মা-ভাই-বোনেদের জীবন দুর্বিষহ করে দেওয়ার কল এই আইন। কারণ, এই গোটা প্রক্রিয়াটিই অত্যন্ত জটিল এবং বিলম্বিত। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে বাংলায় রাজ্যের প্রতিটি জাতির মতো মতুয়া সমাজের প্রতিটি নাগরিকও রাজ্য সরকারের প্রতিটি সরকারি প্রকল্পের আওতাধীন রয়েছেন। হরিচাঁদ ঠাকুর গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঠাকুর বাড়ির উন্নয়ন বা মতুয়া সমাজের উন্নয়নের জন্য বিশেষ উন্নয়ন পর্ষদ গঠন মতুয়া সমাজকে দু-হাত উজাড় করে দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পড়ুন-পাক জেলেই বন্দি জঙ্গি হাফিজ, দাবি রাষ্ট্রসংঘের
তাই লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে হাওয়া তুলে বাংলায় বিভাজনের রাজনীতি করার বা পূর্ববঙ্গ থেকে আসা নাগরিকদের ফের একবার প্রতারিত করার যে রণকৌশল বিজেপি নিয়েছে, সেই চক্রান্ত এবার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে বলেই বিশ্বাস! কারণ, বাংলার মানুষ বিজেপির এই খুড়োর কল (পড়ুন বিজেপির চক্রান্তের কল) ধরে ফেলেছে! বাংলা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন নয় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের বাণীকেই ছড়িয়ে দিতে হবে গোটা দেশে। ধ্বনিত হবে,
‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।’