মায়াময় মানসার

দেবস্থান মানসার লেক। কথিত আছে এই লেকের জলে স্নান করলে যে-কোনও চর্মরোগ নাকি সেরে যায়। ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য তো বটেই, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানেও ছুটে আসেন বহু মানুষ। লিখছেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

মাতারানি বৈষ্ণোদেবীর দর্শন শেষে কাটরা ছাড়িয়ে গাড়ি যখন চলছিল তখন ড্রাইভার সনু পণ্ডিতের কাছ থেকে জানতে পারলাম এবার আমাদের গন্তব্য মানসার লেক। এই লেক জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজমের মধ্যে পড়ে। এই মানসার লেক যেতে যেতে চারিদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল সত্যিই যেন সমগ্র প্রকৃতি মন খুলে গাইছে। চারিদিকের পাহাড়, গাছের মিছিল, পাহাড়ের গায়ে নাম না জানা ফুল, তার অপার সৌন্দর্যের পশরা নিয়ে বসে আছে আপন মহিমায়।

আরও পড়ুন-জন্মভিটেয় সমাহিত উস্তাদ, রাষ্ট্রীয় সম্মানে বিদায়

মানসার ইতিহাসগত ভাবে মহাভারতের সঙ্গে যুক্ত তাই প্রকৃতির অমলিন সৌন্দর্যের সঙ্গে পাশাপাশি কোথায় যেন প্রাচীনতার গন্ধ মিলেমিশে রয়েছে। মহাভারতের কাহিনি অনুযায়ী, যখন নাগ রাজকন্যা উলুপীর সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে হয়, তখন অর্জুনকে এক জ্যোতিষী বলেছিলেন যে অর্জুনের পুত্র তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে। মহাভারতের যুদ্ধের পর অর্জুন অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করে, তাঁর বীরত্ব প্রমাণের জন্য। ঘোড়া ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে ধর উধমপুরের রামকোট গ্রামের কাছে। মায়ের সঙ্গে এখানেই থাকত অর্জুন-পুত্র বাবরবাহন। সে ঐ ঘোড়াটিকে ধরে। তখন তার বারো বছর বয়স।
অর্জুনের সৈন্য-সামন্তরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, বালক বাবরবাহনের সঙ্গে। সব্বাইকে পরাজিত করে সে এবং শেষে অর্জুন যুদ্ধে এলে তাঁকেও পরাজিত করে। তাঁর মাথা কেটে মায়ের কাছে নিয়ে যায়। খুব আনন্দের সঙ্গে বর্ণনা করে যে সে কত বড় বীর।

আরও পড়ুন-দুই মামলা, সজোরে দুই ধাক্কা দুই বিচারপতিকে

অর্জুনের স্ত্রী উলুপী অর্জুনের কাটা মুন্ডু দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েন এবং সে পুত্রকে জানায় যে, বাবরবাহন যাকে হত্যা করেছে তিনি তার পিতা অর্জুন। অবশেষে অর্জুনের বেঁচে ওঠার একমাত্র উপায় শেষনাগের মাথা থেকে মণি নিয়ে আসা। বাবরবাহন তখন তির ছুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে যা এখন সুড়ঙ্গসাগর নামে পরিচিত। এবং শেষনাগকে পরাজিত করে তার মাথার উজ্জ্বল মণি নিয়ে আসে। সেই থেকে এই জায়গার নাম হয় মণিসার। কালক্রমে তা মানসার নামে পরিচিতি লাভ করে।
স্থানীয় লোকে এখনও মানসারকে দেবতার স্থান বা দেওস্থানই বলে। এই বিস্তৃত লেকের জলে স্নান করলে যে কোনও চর্মরোগ নাকি সেরে যায়। সঙ্গে অবশ্য মানসিক করে শেষনাগের পবিত্র মন্দিরে কালো তিল দিয়ে পুজো দিতে হয়। শেষনাগের মন্দির লেকের পূর্ব দিকে অবস্থিত। ছয় মাতা নাগ দেবতার ছয় মাথা, মহাদেব নরসিমা এবং দেবী দুর্গার প্রাচীন মন্দির কাছে রয়েছে।

আরও পড়ুন-খেজুরগুড়ের মান বজায় রাখতে সক্রিয় প্রশাসন

পূজারি সুভাষ শর্মার কাছ থেকে জানা গেল লেক ও মন্দির সংলগ্ন সমগ্র জায়গার ইতিহাস।
শুধু ঐতিহাসিক দিক থেকেই নয় প্রকৃতির কোলে নিজেকে নতুন করে চিনতে, জানতে হলে যেতেই হবে জম্মু থেকে বাষট্টি কিলোমিটার দূরে উধমপুর, সেখান থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের দূরত্ব।
লেক-এর আয়তন প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। মাঝখানে সাঁইত্রিশ মিটার গভীর। লেকে নানা প্রজাতির দুষ্প্রাপ্য মাছ, কচ্ছপ দেখা যায়। চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা, সবুজ বনানী-মাঝে লেক। লেকের চারপাশে সুন্দর করে সাজানো বসার জায়গা, দোলনা, বাচ্চাদের উপযোগী রাইডস— সবই রয়েছে । লেকে বোটিংয়ের সুব্যবস্থা রয়েছে। আর সুন্দর বড় বড় মাছ— খাবার দিলে ছুটে এসে হাত থেকে খাবার খেয়ে যায়। সে-এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা‌! অভূতপূর্ব দৃশ্য! আট থেকে আশি, বাচ্চা-বড় সবার উপভোগ করে দেখার মতো। লেকের পাশ দিয়ে হাঁটার সুন্দর রাস্তা রয়েছে ‌। পরিবেশ নিরিবিলি ও শান্ত। মানুষজনও খুবই ভদ্র ও বিনয়ী।
ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি আছে। নানারকম জলজ পাখি, নীল গাই এবং হরিণ রয়েছে। নানা ধরনের পাখি এবং শীতকালে বিভিন্ন পরিযায়ী পাখিও দেখা যায়।
জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজম থেকে ফুড ক্র্যাফ্ট-এর ফেস্টিভাল হয়। নানান ধরনের খাবার ও হাতের কাজের সামগ্রী মেলে। এটা সাধারণত এপ্রিল মাসে হয়।
তবে মে-জুনে না আসাই ভাল। কারণ প্রচণ্ড গরম সে-সময়ে। সঠিক সময় অক্টোবর থেকে মার্চ।

আরও পড়ুন-ফের শুরু ক্যা ক্যা-র কা কা রব

কোথায় থাকবেন

যেহেতু বেশি ভিড় নেই তাই হোটেল সবসময়ই পাওয়া যায়। “জে কে টি ডি সি”(JKTDC) র টুরিস্ট গেস্টহাউস রয়েছে। যেখানে ঘর থেকে লেকের সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। হোটেল মানসার, হোটেল নটরাজ ইত্যাদি আরো হোটেল এবং হোম স্টে রয়েছে নিজের পকেট এবং পছন্দ বুঝে বেছে নিতে পারেন।

কীভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে জম্মু তাওয়াই অথবা হিমগিরি এক্সপ্রেসে জম্বু পৌঁছে সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়িতে অথবা বাসে যাওয়া যায় মানসার। দূরত্ব ৬২কিমি। অথবা প্লেনে জম্বু পৌঁছে সেখান থেকে ও যাওয়া যায়। আবার ওই এক‌ই ভাবে জম্বু থেকে কাটরা পৌঁছে বৈষ্ণু দেবী দর্শন সেরে সাইট সীন হিসেবে মানসার ঘোরা যেতেই পারে। দূরত্ব কাটরা থেকে ৬৫ কিলোমিটার। ব্যস্ততাকে দূরে রেখে কদিনের কাজের চাপ থেকে ছুটি নিয়ে ঘুরে আসতেই পারেন মানসারে। যেখানে প্রাণ খুলে, মন ভরে প্রকৃতিকে উপভোগ করুন সুপ্রাচীন ইতিহাস কে ছুঁয়ে। নতুন করে আবিষ্কার করুন নিজেকে। নব দম্পতিরা শুনলাম ওখানে খুব যায়। আসলে নির্জনতাকে সবাই উপভোগ করতে ভালোবাসে। পবিত্র দেবভূমি মানসার লেকের পাশে বসে অস্তমিত সূর্যকিরণ গায়ে মেখে আলোক উদ্ভাসিত উদ্দীপ্ত অন্তরে নিজের মনে মনে গেয়ে ওঠে ” বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ”….

Latest article