ছেলেবেলায় একেবারেই মন বসত না রেওয়াজে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটাই নোট অভ্যাস করতে করতে একসময় ভীষণ বিরক্ত লাগত ছোট্ট রশিদের। থেকে থেকে মন উড়ে যেত খেলার মাঠে। দাদুর বকুনির ভয়ে মুখ বুজে সে গিলে নিত দস্যিপনা। কিন্তু তাঁর ভবিতব্য যে তখন লেখা হয়ে গিয়েছে! লতায়-পাতায় সঙ্গীত সম্রাট মিয়া তানসেনের রক্ত ধমনিতে নিয়ে রশিদের জন্মই হয়েছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এমনকী হিন্দুস্থানি ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ভারতরত্ন পণ্ডিত ভীমসেন যোশী পর্যন্ত তাঁর গলার কারুকার্য শুনে অকপটে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উত্তরাধিকার তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। জন্মভিটে উত্তরপ্রদেশের বদায়ুনে হলেও বাংলার মাটিকে ভালবেসে এখানেই থেকে গিয়েছিলেন কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ রশিদ খান। কিন্তু খেলাপাগল সেই দস্যি থেকে কীভাবে খাঁটি হিন্দুস্থানি ঘরানার একজন কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন রশিদ?
আরও পড়ুন-কাল শুরু টুর্নামেন্ট, ট্রফি জিতলে ১৭ কোটি
খুদে রশিদ
আর কেউ জানুক না জানুক, রশিদের যখন মাত্র ৪ বছর বয়স তখনই মামা উস্তাদ গোলাম মুস্তাফা খান তাঁর গলায় ভবিষ্যতের কিংবদন্তিকে ‘শুনতে’ পান। সদ্য মাতৃহারা রশিদকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ দিতে তখনই উত্তরপ্রদেশ থেকে মুম্বই নিয়ে যান তিনি। কিন্তু সঙ্গীতে রশিদের প্রথম তালিম বদায়ুনেই, দাদু উস্তাদ নিসার হোসেন খাঁ-সাহিবের হাতে মাত্র ৬ বছর বয়সে। হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার প্রবর্তক ইনায়েত হোসেন খানের জামাই নিসার খান প্রতিদিন ভোর চারটেয় নাতিকে ঘুম থেকে তুলে রেওয়াজে বসাতেন। ১১ বছর বয়সে কলকাতায় এসে দাদুর সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয় ছোট্ট রশিদ। ওই বয়সেও ভর্তির ইন্টারভিউতে খুদে রশিদের ছোট ছোট সরগমের কারুকার্য শুনিয়ে বন্দিশে ঢোকার শৈলী তাবড় তাবড় সঙ্গীতজ্ঞকে মুগ্ধ করেছিল। ১৯৭৯ সালে কলকাতায় জীবনের প্রথম কনসার্টেই সুরের মূর্ছনায় রশিদ আচ্ছন্ন করেছিল কিংবদন্তি পণ্ডিত রবিশঙ্করকেও। তারপর থেকে এই বাংলার মাটিতেই জল-হাওয়া পেয়ে বীজ থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মহীরুহ হয়ে উঠেছিলেন রশিদ।
আরও পড়ুন-কর্নাটক: সঙ্গীকে বেধড়ক মারধর করে তরুণীকে গণধর্ষণ
রশিদের স্টাইল
ছোটবেলা থেকেই দাদুর সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানে দিকপাল সঙ্গীতশিল্পীদের সান্নিধ্য পেলেও রশিদের স্টাইল ছিল অন্যন্য। কেউ কেউ বলেন, রশিদের গলায় উস্তাদ আমির খান ও পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর ছোঁয়া থাকলেও তাঁর গায়কী শৈলী ছিল এক ও অদ্বিতীয়। ব্যুৎপত্তিগতভাবে গোয়ালিয়র ঘরানার অংশ রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার ধীরগতির ছন্দময় কারুকার্য রশিদের উদাত্ত কণ্ঠে যেন স্বর্গীয় প্রার্থনার মতো ঝরে পড়ত। সুরের প্রতিটা হরকতে ফেটে পড়ত আবেগ। রশিদের গলায় দুলকি চালে বেহাগ, মেঘ, শুদ্ধ কল্যাণ, ইমনের মতো রাগ যেন সুরেলা তুলিতে ছবি আঁকত। এক অন্যন্য স্টাইলে নিজেকে মেলে ধরে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের জগতে ধীরে ধীরে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন উস্তাদ রশিদ খান।
ধ্রুপদী সঙ্গীতের মহীরুহ
এক সাক্ষাৎকারে রশিদ একবার বলেছিলেন, জীবনের যে ছোট-ছোট দুঃখ, অপ্রাপ্তি— সেইসব আমি গানের মধ্যে প্রকাশ করার চেষ্টা করি। তাঁর এই চেষ্টার ফলাফলই বিশ্বজুড়ে খাঁটি হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের দর্শকদের মোহিত করে রাখত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মহীরুহ হয়েও রশিদ কিন্তু কোনওদিনই নিয়ম মেনে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজের পরিপন্থী ছিলেন না। তাঁর মতে, শিল্পীর প্রতি ঈশ্বরের ইঙ্গিত থাকে। তার ফলেই সঙ্গীত সাধনা করেন তাঁরা। যদিও রশিদ কিন্তু শুধুমাত্র রামপুর-সহসওয়ান ঘরানায় থেমে থাকেননি। নিজেই নিজেকে প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ডুব দিয়েছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অতল অনন্ত মহাসাগরে। গজল, ঠুমরি এমনকী রবীন্দ্রসঙ্গীতেও নিজের গায়কী জাহির করেছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চিরাচরিত দম্ভ মুছে ঐতিহ্যের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সঙ্গীতজগতে পা রেখেছেন রশিদ। হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে বলিউড ও টলিউডি সঙ্গীতের চমৎকার মিশেল ঘটিয়েছেন। ধ্রুপদী সঙ্গীতকে ভিত করে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও সুফি ফিউশন নিয়ে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাণিজ্যিক ছবির গানেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ২০০৮ সালে কলকাতায় বসে রেকর্ড করা বলিউডের ‘আওগে জব তুম ও সাজনা…’ গানে রশিদের দরদমাখা কণ্ঠস্বর আজও একটা গোটা জাতিকে ভাবুক করে তোলে।
আরও পড়ুন-আজ এশিয়ান কাপে অভিযান শুরু সুনীলদের
প্রাপ্তির ব্যাপ্তি
মাত্র ৫৫ বছর বয়সেই মরণব্যাধি ক্যানসারের কাছে আত্মসমর্পণ রশিদের। কিন্তু তার মধ্যেই হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতের আকাশে হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত নক্ষত্র। দেশের দিকপাল সঙ্গীতজ্ঞরাও তাঁর কণ্ঠস্বরকে বাগ্দেবীর অধিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শুধু দেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রশিদ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্বজা উড়িয়েছেন। বিশ্বের তাবড় তাবড় সঙ্গীতজ্ঞদেরও চমকে দিয়েছেন নিজের গায়কী দিয়ে। রশিদের গলায় প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের ‘ইয়াদ পিয়া কি…’ গান শোনা স্বর্গসুখের শামিল। ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী ও ২০২২ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন রশিদ। ২০০৭ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, ২০১২ সালে বঙ্গভূষণ ও সঙ্গীত মহাসম্মান পুরস্কার পান তিনি। এছাড়াও অজস্র সম্মাননায় ছেয়ে রয়েছে রশিদের কলকাতার বাড়ি।
আরও পড়ুন-বৈঠকে থাকছে না তৃণমূল
মাটির মানুষ
কিন্তু এতকিছুর পরও মাটিতে পা রেখেই চলতে ভালবাসতেন উস্তাদ রশিদ খান। বংশপরিচয় বা ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার ছিটেফোঁটা অহংবোধও কখনও শোনা যায়নি তাঁর গলায়। সাধারণ ছাপোষা দিনযাপনই ছিল রশিদের জীবনের মূলমন্ত্র। খেতে ও খাওয়াতে বিশেষ ভালবাসতেন তিনি। নিজেই রাঁধতেন, সবাইকে ডেকে নিজে হাতেই খাওয়াতেন। জন্মসূত্রে বদায়ুনবাসী হলেও বাংলা ভাষা বলার উপর রশিদের ছিল আশ্চর্যরকমের নিপুণতা। দীর্ঘ কয়েকদশক তিলোত্তমায় কাটিয়ে কালক্রমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নিখুঁত বাঙালি। বাংলার বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গেও তাঁর সুরেলা মধুর সম্পর্ক।
আরও পড়ুন-হুথি জঙ্গিদের উপর আমেরিকা-ব্রিটেনের ক্ষেপণাস্ত্র হানা, হত ৫
শিল্পেই থাক শিল্পীর স্মৃতি
এহেন শিল্পীর প্রয়াণকে কি মহাপ্রস্থান বলব? নাকি মহাজাগতিক ক্ষতি? রবীন্দ্রসদনে যখন শিল্পীকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গান স্যালুট দিয়ে শেষ বিদায় জানানো হচ্ছে, তখন এই প্রশ্নটাই বারবার ঘুরেফিরে আসছিল। শিল্পীরা চিরকালই গুণমুগ্ধ অনুরাগীদের চোখের জলে ইহলোকের টান ছিন্ন করেন। কিন্তু হারিয়ে যান কি? জন্মসূত্রে উত্তরপ্রদেশের বদায়ুন নিবাসী হলেও ১১ বছর বয়সে কলকাতায় এসে আর কখনও জন্মভিটেয় ফিরে যাননি রশিদ। শেষ পর্যন্ত যখন গেলেন, তখন দেহে আর প্রাণ নেই। সাদা চাদরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে শরীরটা অবশেষে মিশে গেল তাঁর জন্মভূমিতেই। রয়ে গেল শুধু তাঁর রেখে যাওয়া শিল্প, তাঁর গায়কী শৈলী আর তাঁর দরদমাখা কণ্ঠের আবেগতাড়িত একটা লাইন,
সপনোঁ কা জহাঁ, হোগা খিলা খিলা; বরসে গা সাভন, বরসে গা সাভন…