যমুনা পুলিনে অবস্থান ব্রজভূমের। কৃষ্ণ জন্মস্থানে প্রথম বৈষ্ণব মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে। অর্থাৎ, ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের কাছে কৃষ্ণ-জন্মস্থান হিসেবে মথুরার (mathura) অনবদ্য আকর্ষণ সত্ত্বেও সেখানে কোনও কৃষ্ণ কিংবা বিষ্ণু কিংবা কেশবের মন্দির খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী অবধি গড়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে, আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে এখানে একটি বড় বৈষ্ণব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই বিক্রমাদিত্য নামে মানুষের কাছে অধিক পরিচিত।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই) মনে করে, এই জন্মস্থানটিতে আদিতে বৌদ্ধ বিহার ছিল। তারই ধ্বংসাবশেষ ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল হিন্দু মন্দিরটি। খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দ অবধি মথুরা বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছেও ধর্মস্থান হিসেবে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে এসেছে। ফা হিয়েন (৩৩৭-৪২২ খ্রিঃ) ও হিউয়েন সাঙ (৬০২-৬৬৪ খ্রিঃ)-এর মতো চৈনিক পর্যটকরা তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তে সেকথা লিখে গিয়েছেন। এমনকী পরবর্তীকালে ভারতে আগত মুসলমান ইতিহাসবেত্তারাও তাঁদের বিবরণীতে মথুরাস্থিত বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহারের উল্লেখ করেছেন।
ইতিহাসবেত্তা মহম্মদ কাশিম ফেরিস্তার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, গজনির সুলতান মামুদ মথুরা আক্রমণ করেন ১০১৭/১০১৮ খ্রিস্টাব্দে। তখন মথুরাতে তিনি প্রায় ২০ দিন ছিলেন। এই সময় লুঠপাট, ধ্বংসকার্যের পাশাপাশি মথুরাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহারগুলি, সেই সঙ্গে জৈন মন্দিরসমূহও। কিন্তু তাতেও বিনষ্ট হয়নি মথুরায় কৃষ্ণভক্তির প্রবাহ। এই হানাদারির কয়েক বছর পরেই ভারতে এসেছিলেন আলবিরুনি। তিনি লিখছেন, মথুরা (mathura) তখনও ভারতের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান, জায়গাটা ব্রাহ্মণদের ভিড়ে ঠাসা।
এখন যেখানে কাটরা কেশবদেব মন্দির সেখানেই নাকি একটি বিষ্ণু মন্দির অবস্থিত ছিল। একটি সংস্কৃত শিলালিপিতে তেমনটাই বলা আছে। শিলালিপিটি আনুমানিক ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে খোদিত। শিলালিপি অনুসারে সেই অভ্রংলিহ মন্দিরটি ছিল উজ্জ্বল শ্বেতপাথর দ্বারা নির্মিত।
আরও পড়ুন- সংস্কার হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন, শহর জুড়ে বাড়বে সরবরাহ
এই মন্দিরটির ধ্বংসসাধন করেন দিল্লির সুলতান সিকন্দর লোদি (১৪৫৮-১৫১৭)। এন্টউইসল লিখছেন, মথুরার আবহমান ধর্ম সংস্কৃতির অপরিসীম ক্ষতি করেছিলেন দিল্লির সুলতানরা ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দুদের তৈরি করা মন্দির ও ধর্মস্থানগুলো হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল নয় পরিত্যক্ত হয়েছিল। মূর্তিগুলি বিনষ্ট করেছিল মূর্তিপূজা-বিরোধী ইসলাম ধর্মাবলম্বীর দল।
অথচ আশ্চর্যজনক বিষয় হল, একদিকে যখন ধ্বংসের উৎসব চলছে মথুরার (mathura) বুকে, ঠিক তখনই সমান্তরাল প্রবাহে নিম্বার্ক, বল্লভ, শ্রীচৈতন্যের কারণে ব্রজভূমে পুনঃবিকশিত হচ্ছিল বৈষ্ণব ধর্মের ভক্তি আন্দোলন। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারত থেকে আগত বৈষ্ণব ধর্মগুরুরা কৃষ্ণ ভজনায় নীরস শাস্ত্রসম্মত আচার-উপচারে যোগ করলেন প্রাণের ছোঁয়া, হৃদয়ের স্পর্শ, আবেগের স্ফুরণ। মন্দিরের দেবতাকে তাঁরা শাস্ত্রের বিধানে না বেঁধে রেখে রাগানুরাগা ভক্তির অর্ঘ্যে তাঁর অর্চনা করলেন।
১৫২৬ খ্রিঃ পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদি পরাস্ত হলেন বাবরের বাহিনীর কাছে। মুঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হল। বাবর ও হুমায়ুনের শাসনকালে ব্রজভূমে বৈষ্ণব ধর্মান্দোলন অব্যাহত রইল। বিরাট বিস্ফোরণ না ঘটলেও ঢিমে তালে প্রবহমানতা জারি ছিল। রাষ্ট্রনায়করা আর্থিক সহায়তা দিতেন না মন্দির ইত্যাদি নির্মাণকল্পে। তাই, মথুরা (mathura) এবং পার্শ্ববর্তী বৃন্দাবনে সেসময় কোনও সুবৃহৎ চোখ ধাঁধানো মন্দির গড়ে ওঠেনি। তবে, বড় না হলেও ছোট ছোট অজস্র কৃষ্ণমন্দির নির্মিত হয়েছে এই দুই মুঘল বাদশাহের শাসনকালে।
ছবিটা বদলে গেল আকবরের দীর্ঘ রাজত্বকালে, ১৫৫৬-১৬০৫-এর মধ্যে। তারাপদ মুখার্জি থেকে ইরফান হাবিব, সকল ইতিহাসবিদই স্বীকার করেছেন, আকবরের আমলে মথুরার বৈষ্ণব মন্দিরগুলো জমি ও আর্থিক অনুদান পেত বাদশাহর কোষাগার থেকে। ১৯৮৭-তে ভারতের ইতিহাস কংগ্রেসের কার্যবিবরণীতে এ-কথার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
এহ বাহ্য! আকবর নিজেই তিন-তিনবার মথুরা ও বৃন্দাবনে হাজির হয়েছিলেন সশরীরে। দেখা করেছিলেন, কথা বলেছিলেন স্বামী হরিদাসের মতো বৈষ্ণব সন্তদের সঙ্গে। মুঘল প্রশাসন ও সৈন্যবাহিনীতে রাজপুত ও অন্য যেসব হিন্দু উচ্চপদে আসীন ছিলেন তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রজভূমিতে একদিকে যেমন নতুন নতুন মন্দির গড়ে উঠল, অন্যদিকে তেমনই পুরোনো ভেঙে-পড়া মন্দিরগুলোর সংস্কার সাধন সম্ভব হল। অবশেষে, জাহাঙ্গিরের আমলে রাজপুত শাসক রাজা বীর সিংহদেব নির্মাণ করলেন এক বিশাল কৃষ্ণমন্দির। ১৬১৮-তে মন্দিরটি মথুরার কাটরাতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৬৫০-এ এই মন্দিরটি মথুরায় দেখেছিলেন ফরাসি পর্যটক জ্যঁ ব্যাপিন্তে তাভার্নিয়ার। তাঁর দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী মন্দিরটি ছিল অষ্টভুজাকৃতি এবং লালরঙা বেলে পাথরে তৈরি। ইতালীয় পর্যটক নিকোলো মানুচিও ওই ১৬৫০ দশকের শেষ পাদে মথুরায় আসেন। তাঁর দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, আগ্রা থেকে ওই সুউচ্চ মন্দিরের ধাতুতে মোড়া চূড়া দেখতে পাওয়া যেত।
১৬৬৯-এ আওরঙজেব তাঁর রাজ্যে অবস্থিত সকল হিন্দু মঠ-মন্দির ধ্বংস করার আদেশ জারি করলেন। সেই ফরমান মেনেই ভেঙে ফেলা হয় কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। পরের বছর, ১৬৭০-এ মথুরার কেশবদেব মন্দির ভেঙে ফেলে শাহি ইদগাহ নির্মাণের ফরমান জারি করলেন আওরঙজেব। যদুনাথ সরকার লিখছেন, মন্দিরের দেবমূর্তিগুলিকে আগ্রায় নিয়ে গিয়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়। অড্রে ক্রুস্কে অবশ্য জানাচ্ছেন, কেবল ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারণে আওরঙজেব এরকম পদক্ষেপ করেননি। ১৬৬৬-তে শিবাজিকে আগ্রা থেকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন মথুরাবাসী (mathura) ব্রাহ্মণরা। তা ছাড়া কেশবদেব মন্দির আওরঙজেবের পরম শত্রু দারাশিকোর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। ফলে, মন্দিরটির সম্পর্কে তাঁর মানসিক বিতৃষ্ণা ছিলই। এ ছাড়াও, আরও একটি ঘটনায় আওরঙজেবের কেশবদেব মন্দিরের প্রতি ক্রোধ ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৬৬৯-১৬৭০-এ মথুরা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জাঠ অভ্যুত্থান ঘটে। সেই অভ্যুত্থানের পরিণতিতে নিহত হন আবদুল নবি খান, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় মুঘল শিবিরের। আওরঙ্গজেবের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ওই অভ্যুত্থান কেশবদেব মন্দিরের পূজারি ও ভক্তদের সমর্থনলাভে পুষ্ট হয়েছিল। ত্র্যহস্পর্শে, হিন্দুদের প্রতি এমনিতেই অসহিষ্ণু আওরঙজেব আরও ক্ষোভে বিস্ফোরিত হয়ে কেশবদেব মন্দিরের ধ্বংস নিশ্চিত করেন।
১৮৩০-এ মথুরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন হয়। ১৮১৫-তে কোম্পানি নিলাম করে কাটরা কেশব মন্দিরের ১৩.৩৭ একর জমি তুলে দিল রাজা পাটনিমলের হাতে। ১৯৪৪-এ জমিটা কিনে নেন শিল্পপতি যুগলকিশোর বিড়লা। ১৯৫১-তে তিনিই গঠন করেন শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি অছি। উদ্দেশ্য, ওখানে একটি কৃষ্ণমন্দির নির্মাণ। শাহি ইদগাহ মসজিদের লাগোয়া জমিতে গড়ে উঠল কেশবদেব মন্দির।
এই হল ইতিহাস।
সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছে, মথুরায় মন্দির ভাঙার প্রহরে মসজিদ না-ভাঙা সত্ত্বেও ভক্তিবাদী বৈষ্ণব আন্দোলন সেখানে পাল্টা হানাহানি করে শ্বাসবায়ু খোঁজেনি এবং তা সত্ত্বেও ফুরিয়ে যায়নি, বরং বিকশিত হয়েছিল আপন অম্লজানে। অযোধ্যা স্রিফ ঝাঁকি হ্যায়। কাশী মথুরা বাকি হ্যায়। এই স্লোগানের চিৎকৃত উল্লাসে কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়নি মথুরায় কৃষ্ণ জন্মভূমির ভাবগাম্ভীর্য।
বিশেষ করে আজকের দিনে এই কথাটা মনে রাখা এবং মনে করানোটা জরুরি।