বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনা, নারী বিদ্বেষ এবং ধর্মের তাস খেলে রাজনীতি করে বিভাজন বিদ্বেষ ছড়ানো।
আর কিছু না হোক, স্রেফ এই তিনটে কারণেই বিজেপি বর্জনীয়।
ওদের একটা ভোট দেওয়া মানেই ওই তিনটে বিষয়ের মধ্যে অন্তত একটা বিষয়কে সমর্থন করা। তাই, তাইই, ‘নো ভোট টু মোদি’, ‘নো ভোট ফর বিজেপি’।
আরও পড়ুন-এ সাগর ভালবাসা
বাংলার প্রাপ্য টাকা কেন্দ্র দিচ্ছে না, এই অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা, গ্রাম সড়ক যোজনা-সহ একাধিক প্রকল্পে কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে টাকা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। সবমিলিয়ে এক লক্ষ কুড়ি হাজার কোটি টাকার মতো কেন্দ্রের কাছে প্রাপ্য রয়েছে বাংলার। যার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল ১০০ দিনের কাজ। প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার উপরে প্রাপ্য রয়েছে। কিন্তু ১০০ দিনের কাজ করা শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার। তাঁদের প্রতি কেন্দ্রের কোনও সহানুভূতিশীল মনোভাব আজ অবধি দেখা যায়নি। গ্রাম বাংলার মানুষ পরিশ্রম করেও তাঁদের পকেটে জোটেনি ন্যায্য প্রাপ্য। এখনও যদি এর প্রতিবাদে বিস্ফোরিত না হয় চারিদিক, এখনও যদি নীরবতায় মূক হয়ে থাকে আমাদের বাঁচা, তবে আমাদের প্রতিবাদী অস্মিতা যে অস্তমিত, সেটাই হবে প্রমাণিত। সংকট দীর্ণ হবে বাংলার মেহনতি মানুষের যাপন। প্রতিজ্ঞা ভ্রষ্ট হবে আমাদের তাবৎ মূল্যবোধ। মা মাটি মানুষের পাশে সতত থাকার, তাঁদের হয়ে নিয়ত সওয়াল করার অঙ্গীকার আঁকড়েই তো আমাদের বিবেকের পথ চলা। তাই, বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদের প্ররোচিত করুক পদ্মে একটি ভোটও না দিতে।
আরও পড়ুন-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আলো ও অন্ধকার
দ্বিতীয়ত বিজেপি একটি আপাদমস্তক নারী বিদ্বেষী দল। সরকারে ওদের ফের আসতে দিলে দিকে দিকে আবার মহিলাদের সম্ভ্রমহানির আয়োজন মদত পাবে। সম্প্রতি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর গণধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন বিজেপি-র আইটি সেলের দুই সদস্য। এর পাশাপাশি, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তারা ফের কারান্তরালে। মণিপুরের অশান্ত পরিস্থিতি কথা সকলেরই জানা। নারী জাতীর উপরে সেখানে কীভাবে লাঞ্ছনা, নির্যাতন হয়েছে তা গোটা দেশ দেখেছে। তা ছাড়া উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা-সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে নারীদের অসম্মান, লাঞ্ছনা-বঞ্চনার ধারাবাহিক কাহিনি এখন সর্বজন জ্ঞাত বিষয়। বিজেপি নেতারা বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও-এর কথা বলেন। অন্যদিকে নারীদের উপরই নেমে আসে নির্যাতন। ফলে বিজেপি নারী বিদ্বেষী। তদুপরি, রাম-সীতার প্রসঙ্গ স্মর্তব্য। আমরা সবাই রামকে সম্মান করি। শুধু হিন্দুরা নয়, মুসলমান ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিরাও। স্বয়ং আলম্মা ইকবাল, ‘সারে জাহাঁসে আচ্ছা’র স্রষ্টা লিখেছেন রামের প্রশস্তি। লিখেছেন, “লাবরেজ হ্যায় শরাব-এ হকিকৎ সে জাম-এ-হিন্দ / সব ফলসফি হ্যায় খিত্তা-ই-মগরীর কে রাম-ই-হিন্দ / ইয়ে হিন্দুয়োঁ কে ফিকর-ই-ফলক রাস কি হ্যায় আসর / রিফাত মেঁ আসমান সে ভি উঁচা হ্যায় রাম-ই-হিন্দ / ইস দেশ মেঁ হুয়ে হ্যায় হাজারোঁ মালাক শরিসত / মশুর যিনকে দম সে হ্যায় দুনিয়া মেঁ নাম-ই-হিন্দ / হ্যায় রাম কে উজুদ পে হিন্দোস্থান কো নাজ / আহেলে নজর সমঝাতে হ্যায় উসকো ইমাম-ই-হিন্দ!” অর্থাৎ, হিন্দের পেয়ালায় সত্যের শরাব উপচিয়ে পড়ছে / পশ্চিমা দার্শনিকরা হলেন এর ভক্ত / হিন্দের দার্শনিকদের অতীন্দ্রিয়বাদ হিন্দকে নক্ষত্রমালার ওপরে স্থান দিয়েছে / দুনিয়ার সামনে হিন্দের নাম উজ্জ্বল করার জন্য হাজার হাজার ফরিস্তা এসেছেন নেমে / আর গর্ববোধ করেছেন রামের অনুসন্ধানী নয়নে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়ে।
উল্লিখিত ‘নাজম’-এ উর্দু কবির দৃষ্টিতে নরচন্দ্রমা শ্রীরাম হলেন ‘ইমাম-এ-হিন্দ’, অর্থাৎ ভারতবর্ষের আধ্যাত্ম পুরুষ। এসব আমরা জানি ও মানি। কিন্তু বিজেপি রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠায় সীতার নাম নিচ্ছে না। কারণ তারা নারী বিরোধী। এই নারী বিদ্বেষটারই প্রতিবাদ করা দরকার। মাতৃ গর্ভের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই তাই বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। ওদের একটি ভোট দেওয়া চলবে না।
আরও পড়ুন-বইমেলার ছবি
বিজেপির সর্বাধিক নোংরামি হল ধর্মের নামে রাজনীতি। রাজনৈতিকভাবে যখনই বিজেপি পেরে উঠছে না তখন ধর্মকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চাইছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নাগরিকত্ব প্রদানের ইস্যুকে সামনে রেখে মতুয়াদের ভোটব্যাঙ্ক আদায় করেছিল বিজেপি। কিন্তু তারপর থেকে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগেও বিজেপি টের পেয়ে গিয়েছে তাদের রাজনৈতিক জমি মোটেও শক্তিশালী নয়। তাই এমতাবস্থায় রামকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবার চেষ্টা করছে। আমাদের স্পষ্ট কথা, রাজনীতির ময়দানে লড়াই হোক কিন্তু ধর্মকে হাতিয়ার করে নয়। বিজেপি ধর্মের নামে রাজনীতি করছে। এর যোগ্য জবাব এবার দিতে হবে। তাই বিজেপিকে একটি ভোটও নয়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
গত পরশু চলে গেল সাধারণতন্ত্র দিবস। যাদের জন্য এই দিবস উদযাপন, তাঁরা প্রজা নন, নাগরিক, দেশের সমান অংশীদার। এই কারণেই নাগরিকদের দায় প্রজাতন্ত্রের অন্তর্নিহিত সমাসনের ধারণাটিকে বহমান রাখার। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী যখন দোল-দুর্গোৎসবে নাগরিকদের ‘উপহার’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন— কখনও মহিলাদের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার, কখনও পেট্রলের দামে ছাড়, কখনও কৃষকদের জন্য মাসোহারা— তখন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া বিধেয় যে, এটা রাজতন্ত্র নয়, প্রজাতন্ত্র। উপহার বিলি করার অধিকার তাঁর নেই, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অছি এবং দেশের জনসাধারণের বেছে নেওয়া প্রতিনিধি হিসাবে তিনি নাগরিকের অধিকার রক্ষা করতে পারেন মাত্র। সেটা তাঁর বদান্যতা নয়, অবশ্যকর্তব্য। নেতারা মানুষের প্রশ্নের উত্তর না দিলে, প্রশ্ন শুনতে না চাইলে, তাঁদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে, ‘মন কি বাত’ একতরফা হয় না। নাগরিকের মনের কথা শোনা প্রজাতন্ত্রে ঐচ্ছিক নয়, আবশ্যিক। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের প্রাপ্য কম নয়। সেই প্রাপ্যকে ‘রেউড়ি’ বলে অপমান করার অধিকার কারও নেই। অনুগ্রহকারী-অনুগৃহীতের সম্পর্ক নয়, নাগরিকের সঙ্গে নাগরিকের সমান সম্পর্কই প্রজাতন্ত্রের অভীষ্ট। কেবলমাত্র এই স্বত্বেই দেশের পরিচালকদের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক রচিত হতে পারে। ক্ষমতাবানরা সে কথাটি ভুলতে চাইবেন, ভোলাতে চাইবেন— কিন্তু এই মৌলিক সত্যটি বিস্মৃত না হওয়া নাগরিকের কর্তব্য।
আর সেজন্যই আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে একটা ভোটও দেবেন না। ওদের ঔদ্ধত্যের জবাব দিতে ওদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করুন। ওদের নোংরামির জবাব দিতে ওদের গদি থেকে ছুঁড়ে ফেলুন। ওদের বাংলার প্রতি বঞ্চনা, নারী বিদ্বেষ এবং ধর্মের তাস খেলে রাজনীতি করে বিভাজন বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ওদের রাজনৈতিকভাবে বর্জন করুন। আপনার আমার সকলের স্বার্থে, দেশের আজ ও আগামীর স্বার্থে ওদের একটা ভোটও দেবেন না। জয় বাংলা। জয় হিন্দ।