কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট বা ভোট অন অ্যাকাউন্ট পেশ করেছেন। সংজ্ঞামাফিক বলতে গেলে এটি নতুন সরকার যতদিন না গঠিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসমূহে খরচ করার জন্য সংসদের অনুমোদন গ্রহণ, এতে নতুন কোনও বড় প্রকল্প ঘোষণা করার কথা নয়। এবারের বাজেট এই সংজ্ঞা লঙ্ঘন করেনি। তদসত্ত্বেও এবারের বাজেট বক্তৃতায় আর্থিক ঘাটতি, কর রাজস্ব এবং ব্যয়ভারের মতো বড় বড় বিষয়ে উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন-পাঁচ বছরে ১২ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ৩ লক্ষ কোটির জালিয়াতি, অভিষেকের প্রশ্নে স্বীকার কেন্দ্রের
এবারের বাজেট বক্তৃতা কেন্দ্রীয় সরকারের সাফল্য কাহিনি পেশ করেছে। সেই সাফল্য কেবল গত বছরের নয়, ২০১৪-তে মোদি জমানা শুরু হওয়ার পর্ব থেকে সফলতার বিবরণী। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী জনসংখ্যার চারটি বিভাগে সাফল্যের কারণে ভারত উন্নত দেশ হওয়ার পথে অগ্রসরমান। দরিদ্র জনগণ, মহিলা, যুবক আর কৃষক, জনগণের এই চারটি বিভাগে ২০১৪-তে সাফল্য সূচিত হয়েছে বলেই নাকি দেশ এগিয়ে চলেছে।
সত্যিই কি তাই?
দরিদ্র জনগণের কথাই ধরা যাক। ২০১৪-র আগে তাদের অবস্থার সঙ্গে ২০১৪-র পরবর্তী তাদের অবস্থার তুলনা টানাটা অনেকটা আপেলের সঙ্গে কমলা লেবুর তুলনার চেষ্টা। ২০১৪-র আগে ন্যাশনাল সার্ভে অর্গানাইজেশন (এনএসও) সমীক্ষা চালিয়ে দেখত জাতীয় দারিদ্র্য সীমার নিচে কত লোক আছে। আর এই দারিদ্র্য সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে মাপকাঠি ছিল ভোগব্যয়। এই দারিদ্র সীমা নির্ণয় করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোকেও গণ্য করা হত। যেমন, রোজ মাথা পিছু আয় এক ডলার হচ্ছে কি না, সেসবও বিচার করা হত। তখনও ভারতের দারিদ্রের পরিমাপ করার বিষয়ে বিতর্ক ছিল সেটা খাদ্যগ্রহণের পরিমাণের ভিত্তিতে নির্ণীত হবে না অন্যান্য বিষয়সমূহ বিবেচনা করবে তা নিয়ে। সেসব সত্ত্বেও একটা ব্যাপারে সবাই ঐক্যমত্যে পৌঁছেছিল যে ১৯৯১-এর পর থেকে দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকা জনগণের সংখ্যা কমেছে আর বৃদ্ধির হার বেড়েছে। ২০০৪-এ যেখানে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী ভারতীয়র সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৩৭.২ শতাংশ, ২০১১-তে সেটা কমে হয় মোট জনসংখ্যার ২১.৯ শতাংশ। এখন আর এরকমভাবে স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ, গত ১৩ বছর ধরে জনসংখ্যা গণনা এবং ভোগব্যয় সংক্রান্ত সমীক্ষা বন্ধ আছে। সুতরাং, পূর্ববর্তী দু’দশকের তুলনায় বিগত নয় বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাসকারী জনগণের সংখ্যা দ্রুততর হারে কমছে কি না, সেট সুস্পষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন-কৃত্রিম মানবভ্রূণ
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের দাবি, ২০১৪ থেকে দেশের ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচ থেকে উপরে উঠে আসতে পেরেছেন। এই তথ্য তিনি নীতি আয়োগের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসূচক (এমপিআই)-এর ভিত্তিতে প্রদান করেছেন। নীতি আয়োগের এই সূচকে ১২টি বিষয় বিবেচিত হয়— পুষ্টি, শিশু-কিশোরদের মৃত্যু হার, গর্ভকালীন সময়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিদ্যালয় শিক্ষা, রান্নার জ্বালানি, শৌচাগার, বিদ্যালয় হাজিরার হার, পানীয় জল, বিদ্যুৎ সংযোগ, আবাস, সম্পত্তির পরিমাণ এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। এই বিষয়গুলির দ্বারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান— এই তিনটি ক্ষেত্রের হাল হকিকত বোঝা যায়। এই বহুমুখী দারিদ্র্যসূচক পূর্ববর্তী মাথাপিছু দারিদ্র্য অনুপাতের সঙ্গে উপমিত হওয়ার উপযোগী নয়। তবে একথা বললে ভুল হবে না, ২০২২-২৩-এ মাথাপিছু দারিদ্র্যের অনুপাত (এইচসিআর) কমে হয়েছিল ১১.২৫ শতাংশ। ২০১৩-১৪-তে এই হার ছিল ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ, যত দ্রুত হারে দারিদ্র্য কমছে বলে অর্থমন্ত্রী দাবি করছেন তত দ্রুত হারে ব্যাপারটা ঘটছে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে।
আরও পড়ুন-পাঁচ বছরে ১২ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ৩ লক্ষ কোটির জালিয়াতি, অভিষেকের প্রশ্নে স্বীকার কেন্দ্রের
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী দেশের লোকের প্রকৃত আয় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটা যদি মেনেও নিই তাহলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে ২০১৪-র আগে ও পরে আয় বৈষম্যের ছবিতে কী কী বদল হয়েছে, সে বিষয়ে। কারণ, আমরা জানতে পারছি, কোভিড পরবর্তী পর্যায়ে দেশে আয় বৈষম্য প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের উচ্চ আয় সম্পন্ন ১০ শতাংশের সুবাদে জিডিপি-র হাল বদলাতে পারে, তাতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ে, কিন্তু গরিবের আয় বাড়ে না। অথচ অর্থমন্ত্রী মাথাপিছু জিডিপির হার দেখে বলে দিলেন, দেশের লোকের প্রকৃত আয় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরও পড়ুন-২০২৬ বিশ্বকাপের ফাইনাল হবে আমেরিকায়, শুরু মেক্সিকোয়
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মহিলাদের উন্নতির চিত্র তুলে ধরেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে যোগদানকারীর সংখ্যাবৃদ্ধি এবং আশা কর্মীদের দারুণ কাজের ভিত্তিতে। কিন্তু আশা কর্মী ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের কারণে কি পূর্ণ সময়ের সরকারি কর্মচারীদের মতো বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার কথা কেন্দ্রীয় সরকার ভাবছেন? তা যদি না হয়, তবে এত হইচই আদিখ্যেতা করে লাভ কী?
যদি এসব প্রশ্ন, পরিসংখ্যান ইত্যাদি সরিয়ে রেখে ধরে নিই যে, ২০১৪ থেকে ভারত সর্বক্ষেত্রে দারুণ অগ্রগতির নজির স্থাপন করে চলেছে। তাহলেও কিন্তু এই বাজেটের পর একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এতই যদি হুড়মুড়িয়ে অগ্রগমন, তাহলে ভিজিট ইন্ডিয়া@২০৪৭-এর জন্য অপেক্ষা কেন? আগামী সিকি শতাব্দী আমাদের আর কোন বাধা অতিক্রম করতে লেগে যাবে? তবে কি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক অর্থাৎ মহিলারা সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করতে অসমর্থ থেকে যাবেন? তাঁদের কাজের জন্য তাঁরা এভাবেই কোনও টাকা-পয়সা পাবেন না? যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতেই থাকবে আর তার মোকাবিলায় কেটে যাবে আরও ২৫ বছর? তবে কি কৃষিক্ষেত্রে আয় বাড়ছে না? না কি সার্বিক বৃদ্ধির ধারণাটা কোথাও ঠোক্কর খাচ্ছে? আগামীতে বৃদ্ধির প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে চলেছে চূড়ান্ত আয়বৈষম্য? সত্যিই কি শিশুদের তাদের প্রয়োজনমতো স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে?
এসব অনেক প্রশ্নের উত্তর বাজেটের জনমোহিনী ভাষণে কিন্তু পাওয়া গেল না। আমাদের কপালের ভাঁজ গভীরতর হচ্ছে।